
অবহেলায় বাংলা
১৯৮৪ সালে এক নির্বাহী আদেশে বলা হয়েছিল, ‘সব সাইনবোর্ড এবং গাড়ির ফলক বাংলায় হতে হবে। তবে কেউ প্রয়োজন মনে করলে নিচে ছোট করে ইংরেজিতে লিখতে পারবে।’ এটা সত্য, গাড়ির নম্বর ফলক এখন শতভাগই বাংলায় হচ্ছে।
কিন্তু সাইনবোর্ড লেখার ক্ষেত্রে বাংলা ভাষার ব্যবহার পুরোপুরি কার্যকর হয় নি। ছোটখাটো দোকান, হোটেল বা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বাংলায় সাইনবোর্ড দেখা গেলেও অভিজাত হোটেল-রেস্তোরাঁ, বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান কিংবা শিল্প-কারখানার সাইনবোর্ড এখনও ইংরেজিতে লেখা হয়।
অভিজ্ঞ মহল মনে করে, কঠিন আইন ও জরিমানার মাধ্যমে এ অনিয়মের পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব। ১৯৮৭ সালে দেশের সব রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাধ্যতামূলক করা হয়। সংবিধানেও বলা হয়েছে, রাষ্ট্রের ভাষা ‘বাংলা’।
সচিবালয়সহ সরকারি অধিদপ্তরগুলোতে বাংলার ব্যবহার অনেকাংশে চালু হয়েছে। কিন্তু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে নির্দ্বিধায় ব্যবহার হচ্ছে ইংরেজি। মোট কথা, এখনও সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু করা সম্ভব হয় নি।
বাংলা ভাষা নিয়ে দেশে এখন আরেকটি সমস্যা হচ্ছে। বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে এক অদ্ভুত ভাষা তৈরি হচ্ছে। আমাদের দৈনন্দিন কথোপকথনে এখন সম্বোধন হিসাবে ‘ব্রো’ (ভাই), ‘সিস’ (বোন), ‘মেট’ (বন্ধু) ইত্যাদি শব্দ বেশি ব্যবহার করা হচ্ছে। এগুলো ভাষাদূষণ। শিক্ষাবিদ ও কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম লিখেছিলেন-‘ভাষাদূষণ নদীদূষণের মতোই বিধ্বংসী।’
তার মতে, বাংলাদেশে নদীদূষণ ও ভাষাদূষণ দুটোই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে এবং ক্রমাগত বাড়ছে। যে ভাষার জন্য আমাদের রক্ত দিতে হয়েছে, আমরা কি সেই বাংলা ভাষার চর্চা সঠিকভাবে করতে পেরেছি? বর্তমান বানানরীতি নিয়েও রয়েছে নানা সমস্যা। বাংলা বানানের ভুল প্রয়োগ চলছে তো চলছেই।
এ ভুলের কারণে যে অনেক শব্দের অর্থ পরিবর্তন হয়ে যায়, তা সবাইকে বুঝতে হবে। অন্যদিকে, বাংলার সঠিক উচ্চারণেও রয়েছে অনেক সমস্যা। এটি নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক ও লজ্জাজনক।
শুধু আনুষ্ঠানিকতা নয়, ভাষাকে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে হবে। জ্ঞান অর্জনের জন্য আন্তর্জাতিক ভাষা ইংরেজিকে রপ্ত করতে হলেও আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে ভুলে গেলে চলবে না। এর সঠিক প্রয়োগ বা ব্যবহার অবশ্যই করতে হবে। ইংরেজি ভাষার মাধ্যমে আমরা জ্ঞান অর্জন করতে পারি; কিন্তু আমাদের মনের ভাব প্রকাশের একমাত্র মাধ্যম অবশ্যই বাংলা।
বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য এর সঠিক ব্যবহার ও প্রচলন দরকার। গোটা জাতি যেন রক্তের বিনিময়ে আনা বাংলা ভাষাকে অন্তর থেকে সঠিকভাবে ব্যবহার ও রক্ষা করতে পারে, সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। তবে সমস্যাটা হচ্ছে আমাদের মানসিকতায়। বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য আমাদের ইচ্ছাটাই প্রধান। আমাদের আইন আছে, সুযোগ আছে। তারপরও আমরা বাংলাকে অবহেলা করি।
ফেব্রুয়ারি মাস আমাদের ভাষার মাস-আবেগের মাস। বলতে বাধ্য হচ্ছি এবং আমার সঙ্গে অনেকেই একমত হবেন যে, শুধু এ মাসটি এলেই আমরা বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা করার অঙ্গীকার করি এবং ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করি। এরপর আবার যেমন চলছিল, তেমনি চলতে থাকে। প্রশ্ন হলো, বাংলা ভাষাকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করা, বাংলাকে অবহেলা করা কিংবা অন্য ভাষার প্রতি ব্যাপক আগ্রহ আমাদের কি আদৌ সঠিক পথে নিয়ে যাচ্ছে?❐