মুবিন খান
৩ মার্চ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে মঞ্চায়িত হয়ে গেল সাড়া জাগানো হাস্যরসের কঞ্জুস নাটকটি। এটি ছিল ‘কঞ্জুস’ নাটকের ৭১২তম মঞ্চায়ন। এতগুলো মঞ্চায়নের পর নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার দরকার পড়বে না যে ‘কঞ্জুস’ নাটকটি বাংলাদেশের প্রতিথযশা নাট্যদল লোকনাট্য দলের।
ফরাসি নাট্যকার ও অভিনয় শিল্পী মূল নাট্যকার জ্যঁ-ব্যাপ্টিস্ট পোকেলিন, যিনি মঞ্চে মলিয়ের নামেই পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। পশ্চিমা সাহিত্যের সেরা হাস্য-রসাত্মক লেখকদের অন্যতম একজন হিসেবে তাঁকে বিবেচনা করা হয়।এই মলিয়ের রচিত কমেডি ‘দ্য মাইজার’ অবলম্বনে কঞ্জুস নাটকটি বাংলা ভাষায় রূপান্তর করেছেন নাট্যজন তারিক আনাম খান। নির্দেশনা দিয়েছেন কামরুন নাহার চৌধুরী।
‘কঞ্জুস’ মূলত পুরনো ঢাকার বাসিন্দাদের বৈশিষ্ট্যপূর্ণ জীবনধারার ওপর রচিত ও নির্মিত। নাটকটি একটি নিরীক্ষাধর্মী আঙ্গিকে মঞ্চায়িত হয়ে থাকে। ‘কঞ্জুস’ নাটকটিকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ হাসির নাটক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ১৯৮৭ সালে প্রথম মঞ্চায়নের পর থেকে ইতোমধ্যেই সাতশ’ তম মঞ্চায়ন অতিক্রম করে লোক নাট্যদলের এই নাটকটি বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় মঞ্চ নাটক হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করেছে। লোক নাট্যদলের এই প্রযোজনা দেশ-বিদেশেও বিপুল প্রশংসিত ও পুরস্কৃত হয়েছে। নাটকের শিল্পী কলাকুশলীরা দীর্ঘদিন নিরবিচ্ছিন্নভাবে এই প্রযোজনার সঙ্গে জড়িয়ে থেকে ‘কঞ্জুস’কে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় নাটকে পরিনত করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখে এসেছেন।
নাটকের গল্পে হায়দারের বয়স বয়স ষাট পেরিয়ে সত্তরের ঘরে।এই হায়দারই কেন্দ্রীয় চরিত্র ‘কঞ্জুস।’ ভয়াবহ রকমের কিপ্টে। তার তার এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে কাযিম ও মেয়ে লাইলি বেগম। কোনও এক সমুদ্র ভ্রমণে গিয়ে তার মেয়ে লাইলির সঙ্গে পরিচয় হয় বদি মিয়ার সঙ্গে। বদি আর লাইলীর মধ্যে গড়ে ওঠে ভালোবাসা। লাইলীকে নিজের করে পেতে বদি মিয়া কঞ্জুস হায়দারের খাস চাকর হয়ে।
এদিকে, হায়দারের ছেলে কাযিম প্রেমে পড়ে পাশের বাড়ির মর্জিনার। কাযিমের সঙ্গে মর্জিনার প্রেম যখন তুঙ্গে, তখন কাযিমের পিতা হায়দারের চোখ পড়ে মর্জিনার ওপর। গোলাপজান ঘটকের মাধ্যমে লাইলীর সঙ্গে হায়দারের বিয়ের কথাবার্তা চলতে থাকে। কাযিম তার পিতা এমন আচরণে খুব বিস্মিত ও বিরক্ত হয়। শুরু হয় পিতা-পুত্রর মাঝে এক অন্যরকম লড়াই। হস্যরসের ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে এগুতে থাকে নাটকের গল্প।
‘কঞ্জুস’ নাটকটির মঞ্চায়নের বয়স তিরিশ বছর পেরিয়েছে। তিরিশ বছর আগে যারা মঞ্চে নাটকটি তুলেছিলেন তারা কেউ এখন মঞ্চে নেই। নাটকের সকল চরিত্রই একাধিক অভিনয় শিল্পী ফুটিয়ে তুলেছেন। কিন্তু সার্বিকভাবে যখনই ‘কঞ্জুস’ নাটকের কথা আসে, সঙ্গে আসে তিরিশ বছরের মঞ্চায়নের ঋদ্ধতা। ফলে নাটকের ওই ঋদ্ধতা ধরে রাখবার দায়িত্ব বর্তমানদের ওপরেই বর্তায়। বর্তমান প্রযোজনায় আলোর প্রক্ষেপণে কিছুটা দুর্বলতা লক্ষ্য করা গেছে। যখন যে দৃশ্যে যেখানে যে আলোর প্রয়োজন ছিল সেখানে সে আলোটুকু অনেক সময়ই পাওয়া যায় নি। আলো প্রক্ষেপণে সবচেয়ে বেশি দুর্বলতা দেখা গেছে পুলিশ চরিত্রে তৌহিদুল ইসলাম যখন মঞ্চে পদার্পণ করলেন। হতে পারে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটারের মূল আলো প্রক্ষেপণের জায়গাটিতেই সমস্যা রয়েছে। সেক্ষেত্রে বিষয়টি শিল্পকলা একাডেমি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর করা বাঞ্ছনীয়। মূল সমস্যাটা আলোক পরিকল্পক জি.এম.সিরাজুল ব্যাখ্যা করতে পারবেন।
নাটকের কলাকুশলীদের প্রত্যেকেই অসাধারণ অভিনয় করেছেন। কেউ কেউ আশাতীত অভিনয় উপহার দিয়েছেন। তাদের মধ্যে হায়দার চরিত্রে রূপদানকারী আব্দুল্লাহ আল হারুন এবং গোলাবজান চরিত্রে সামসাদ বেগমের কথা উল্লেখ করতে হয়। এঁদের দুজনের অভিনয়ই খুব প্রাণবন্ত। অন্যদিকে বদী চরিত্রে রূপায়নের বদী দারুণ অভিনয় করেও কিছু অংশে খুব দ্রুত সংলাপ উচ্চারণের ফলে সংলাপ জড়িয়ে গিয়ে অর্থবহ হয়ে দর্শকের শ্রবণে পৌঁছে নি। মনে হয় তাঁর আরেকটু মনযোগী হওয়া দরকার।
তবে ‘কঞ্জুস’ নাটক তার রস দিয়ে এসব ছোটখাটো দুর্বলতা ঠেলে সরিয়ে ঠিকই এগিয়ে গেছে। ফলে দর্শকেরও সে রস আস্বাদনে কোনও প্রতিবন্ধক তৈরি হয় নি। আর ‘কঞ্জুস’কে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এর কলাকুশলী আর অভিনয় শিল্পীরাই। ‘কঞ্জুস’ নাটকের চরিত্রের রূপদানকারিরা হলেন, মনিকা বিশ্বাস, আনোয়ার কায়সার, দ্বীপ মিনহাজুল হুদা, আব্দুল্লাহ আল হারুন, হাফিজুর রহমান, সামসাদ বেগম, জান্নাতুল ফেরদৌস মিমি, ইউজিন গোমেজ। লোক নাট্যদলের প্রযোজনায় প্রযোজনা অধিকর্তা ছিলেন আবদুল্লাহ আল হারুন। নির্দেশনা দিয়েছেন কামরুন নূর চৌধুরী।