প্রতিক্রিয়ামুক্তমত
কিন্ডারগার্টেনে কেন বেশি আগ্রহ
অলোক আচার্য
যুগোপযোগী সব ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার পরও প্রাথমিক শিক্ষা আজও কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি লাভ করতে পারে নি। সম্প্রতি প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর প্রকাশিত এক তথ্যে দেখা গেছে, প্রতি বছরই প্রাথমিকে শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমছে।
তথ্যমতে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণীতে ২০১৫ সালে ভর্তি হয়েছে ১ কোটি ৯০ লাখ ৬৭ হাজার ৭৬১ জন। পরের বছর ২০১৬ সালে ১ কোটি ৮৬ লাখ ২ হাজার ৯৮৮ জন এবং ২০১৭ সালে ভর্তি হয়েছে ১ কোটি ৭২ লাখ ৫১ হাজার ৩৫০ জন। অর্থাৎ শেষ বছরে ভর্তি কমেছে আগের বছরের চেয়ে ১৩ লাখ ৫১ হাজার ৬৩৮ জন। তবে এর মধ্যে আশার কথা হল, শিক্ষার্থী ভর্তির হার কমলেও গত তিন বছরেই কমেছে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার হার।
শিক্ষাথী ভর্তির হার কমতে থাকায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপর অভিভাবকদের আস্থাহীনতা বাড়ছে কিনা সেই প্রশ্ন উঠেছে। কারণ দেশে অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠছে। এই হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন নিয়ন্ত্রণে কোনও নজরদারি নেই। বছরের শুরুতে নানা সুযোগ-সুবিধার কথা বলে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে দেখা যায় এসব প্রতিষ্ঠানকে। কিন্ডারগার্টেনগুলোর মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা- কে কার চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিতে পারে। আর অভিভাবকরা তো আজকাল কেবল ভালো ফল পেতেই আগ্রহী। যে প্রতিষ্ঠানে ভালো ফল হয়, সেখানে নিজের সন্তানকে ভর্তি করাতে উঠেপড়ে লেগে যায়। ডোনেশন দিয়ে হলেও ভর্তি করাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে, বিশেষ করে মফস্বল এলাকার অনেক বিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রীর আসন ফাঁকা থাকে।
সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো ডিজিটাল করার লক্ষ্যে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ল্যাপটপ, প্রজেক্টর পৌঁছে দিচ্ছে। তাছাড়া সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মিড ডে মিল চালুর পরিকল্পনা করছে এবং ইতিমধ্যেই অনেক এলাকায় তা বাস্তবায়িত হয়েছে। আর শিক্ষকের কথা বললে, প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে এখন যারা নিয়োগ পাচ্ছে, তারা উচ্চশিক্ষিত। বিনা বেতনে লেখাপড়া করার সুযোগ ছাড়াও বৃত্তিও দেওয়া হয়।
এছাড়াও প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ, স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতকরণসহ আরও সুযোগ-সুবিধা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে রয়েছে। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? কেন নানা সুযোগ-সুবিধা সত্ত্বেও প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো কাঙ্ক্ষিত সাফল্য অর্জন করতে পারছে না? অপরদিকে কিন্ডারগার্টেনগুলোতে লেখাপড়া করা শিশুদের মাসে মোটা টাকা বেতন দিতে হয়, অতিরিক্ত বই কিনতে হয়। কিন্তু তারপরও কিন্ডারগার্টেনের প্রতি যে আস্থা, তা প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রতি নেই কেন?
প্রথমেই একটা প্রশ্ন আসে- প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যারা চাকরি করেন, তাদের সন্তানরা সবাই কি সরকারি স্কুলে লেখাপড়া করে? এমনও দেখা যায়, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকের সন্তান এলাকার নামিদামি কোনও কিন্ডারগার্টেনে লেখাপড়া করে। অন্যের আস্থা অর্জন করতে হলে প্রথমে নিজেকেই করে দেখাতে হয়। শিক্ষকরা কিন্ডারগার্টেনের ওপর ভরসা করলে অন্যরাও করবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সময়সূচি অনেকটা দীর্ঘ বলে মনে হয়। সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত। অপরদিকে দেশের কিন্ডারগার্টেনের সময়সূচি সকালে। দুপুর বারোটার আগেই এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীরা বাড়ি ফেরে। এসব ছাত্রছাত্রী যখন খেলাধুলা করে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা তখন স্কুল শুরু করে। সময়সূচি নিয়ে শিক্ষাবিদরা গবেষণা করতে পারেন। সময়সূচি নতুন করে নির্ধারণ করা যেতে পারে। আর একটা বিষয় হচ্ছে- অন্য সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির সুযোগ যতটা রয়েছে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ততটা নেই। সহকারী শিক্ষক থেকে প্রধান শিক্ষকে উন্নীত হওয়া গেলেও সেই প্রক্রিয়া খুব দীর্ঘ। প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর এসব সমস্যার দিকে নজর দেওয়া দরকার।
লেখক: সাংবাদিক।