
নজরুল এখনও কেন এত প্রাসঙ্গিক
আজও কাজী নজরুল ইসলাম প্রাসঙ্গিক কেন, এ প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরেই আসে। নজরুল তার ‘আমার কৈফিয়ত’ কবিতায় লিখেছেন : তিনি ভবিষ্যতের ‘কবি’ নন, বর্তমানেরই ‘কবি’।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকালে তিনি ডাক দিয়েছিলেন: ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোন জন,/কাণ্ডারি বল ডুবিয়ে মানুষ সন্তান মোর মার’; রাজনৈতিক নেতাদের আপসকামী মনোভাব দেখে ডাক দিয়েছিলেন: ‘ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়’; শাস্ত্রধারীদের বাড়াবাড়ির প্রতিবাদে লিখেছিলেন : ‘মানুষ এনেছে গ্রন্থ/গ্রন্থ আনে নি মানুষ কোনো।’
নজরুল-সমকালে এসবইতো ছিল মুক্তির ডাক! সামন্তযুগের লেখক লেভ তলস্তয়কে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নেতা ভ. ই. লেনিন অভিহিত করেছিলেন ‘রুশ বিপ্লবের দর্পণ’ বলে। কারণ, নিজে ধনী হলেও এবং সামন্তসমাজে বসে লিখলেও তলস্তয়ের লেখায় লেনিন পেয়েছিলেন সমাজ-অগ্রগতির চাবি, যে চাবি দিয়ে রুশ জনতা মুক্তির দরজা উন্মোচন করতে পেরেছিল। তেমনি, বিশের শতকে লিখলেও উপযোগিতার বিচারে নজরুলের জীবন ও রচনা আজকের একুশ শতকের বাঙালি জীবনেও সমানভাবে আদরণীয়। কারণ সময় এগোলেও সমাজ থেকে বিশ শতকের আবিলতা একুশ শতকেও তিরোহিত হয় নি।
নজরুলকে শুধু ‘বিদ্রোহী’ বলে মানুষের মনে ভয় ধরিয়ে দেয়ার শঙ্কা নজরুল নিজেই করেছিলেন। তার লেখা কিন্তু শুধু একপথে বা সরল পথে অগ্রসর হয় নি। যে সংগ্রাম করে সে প্রেমও করে। লেনিন কবিতা পাঠ করতেন, মার্কস কবিতা রচনা করেছেন, মাও সেতুং নিজেও কবিতাপ্রেমী ছিলেন। নজরুলও তেমনি যুদ্ধের কথা বলেও প্রেমের কথা বলেছেন।
নজরুলের সাহিত্য ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একটি ‘পলিটিক্যাল এসথেটিক্স’ তৈরি করা যেতে পারে- এটি তৈরি হয় নি, হলে খুব বড় কাজ হতো। সেই ‘পলিটিক্যাল এসথেটিক্স’-এর সঙ্গে তার পুরো জীবনকে যুক্ত করে যদি আমরা ভাবি, তাহলে একটি নতুন পথের দিশা মিলবে এবং সেটি এই একুশ শতকেও দিব্যি প্রয়োজন।
নজরুল আধুনিক কবি কিনা- এ প্রশ্নটি সেকালে যেমন উঠেছে, একালেও মাঝে মাঝেই ওঠে। কারণ নজরুলের পরই জীবনানন্দ-সুধীন্দ্রনাথ-বুদ্ধদেব-অমিয়-বিষ্ণু দে’রা যে অত্যুগ্র আধুনিকতাবাদী আন্দোলন করে বাংলার কাব্যমুক্তির পথ দেখান, নজরুল তাদের থেকে পেছনে কিনা, আর পেছনে থাকলে তা কতটুকু সে নিয়ে তর্ক-প্রতর্কের অভাব নেই। নির্দ্বিধ হওয়া প্রয়োজন, নজরুলের আধুনিকতা এ পঞ্চকবির আধুনিকতা নয়।
নজরুল আধুনিকতার মধ্যে বাস্তবতা ও প্রত্যক্ষতার সম্মিলন ঘটানো কবি। এ যুগের কবিকুল, বিশেষ করে একবিংশ শতাব্দীর কবিরা শব্দ নিয়ে যে জাদুকরী খেলায় মত্ত, নজরুলের চেতনা এখানে যে কার্যকর, সেটা ভাবাই যায়। আধুনিক পঞ্চকবিদের আগেই যিনি সূচনাটা করলেন এবং যাকে অনুসরণ করছেন উত্তর-আধুনিক কবিকুল, তার ‘আধুনিকতা’ নিয়ে তাই প্রশ্ন তোলা অবান্তর।
নজরুল দুঃখকে জয় করা এক প্রবল পুরুষ। তবে তিনি দুঃখের সাগরে সাম্পান নিয়ে সাফল্যের মুক্তো খুঁজেছেন। আর এক্ষেত্রে তিনি সঙ্গে নিয়েছেন রক্তমাংসের প্রেমিকাকে। তিনি সরাসরি একটি রক্তমাংসের দেহী নারীকে চেয়েছেন। এই দেহী নারীর কথাই কি আমরা গত শতকের পঞ্চাশের, ষাটের, সত্তরের দশকে দেখি না? এরও আগে ছিল। জীবনানন্দ দাশ থেকে শুরু করে পরের কবিকুলেও।
শামসুর রাহমানের মধ্যে তো দেহহীন নারী একেবারেই নেই- তিনি বরং নারীদেহকে ‘অবজেকটিভলি’ দেখেছেন। যেন, নারীদেহ হল একটি ‘অবজেক্ট’- এই নারীদেহে কী কী দেখা যাচ্ছে না যাচ্ছে- সেটাই মুখ্য বিষয়। এই যে দেহকে ফিরিয়ে এনে মানুষকে সত্যিকার অর্থেই মূল্য দেয়া, এটা নজরুল করতে পেরেছিলেন। নজরুল তার লেখাতে কিন্তু এ ভিক্টোরীয় চেতনাবিরোধী। নির্মল জল আর চাঁদের খেলা যেন নারী আর পুরুষের। কিন্তু দুটো একসঙ্গেই কি সুন্দর নয়?
এ সৃষ্টিজগতে বিরাজিত আছে এক অনিঃশেষ কামভাবনা। এটা যৌনতা নয়, সৃষ্টির এষণা। সৃষ্টির এষণা আছে বলেই পৃথিবী সুন্দর এবং চলমান। এটি বন্ধ হয়ে গেলে পৃথিবী থমকে যাবে। দার্শনিক এ গূঢ়সত্য নজরুল ঠিকই অনুধাবন করতে পেরেছিলেন এবং তাই তিনি তার লেখায় বারবার নারী-পুরুষের সম্মিলিত সত্তাকে ভারতীয় চিরায়ত অনুভাবনার আলোকে তুলে ধরেছেন এবং ইংরেজ ভিক্টোরীয় মূল্যবোধকে অস্বীকার করেছেন। এ নন্দনতত্ত্ব নতুনভাবে চর্চিত হচ্ছে উত্তর-আধুনিক লেখকদের মধ্যে। নজরুলে আছে এর আধার।
ভাবতে হবে, নজরুল সংবর্ধনা পাচ্ছেন একেবারে তরুণ বয়সে, ঊনত্রিশ বছর বয়সে। এটি একটি বিরল দৃষ্টান্ত। এত কম বয়সে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঙালিজনের মন হরণ করেছিলেন, আর করেন নজরুল। এ বয়সে এত বড় সংবর্ধনা পাওয়ার কথা নয়; কিন্তু পেয়েছিলেন। তাহলে কী ছিল নজরুলে? তার চেহারায়, চলাফেরায়, সব অবয়বে যে একটি দ্রোহীভাব প্রকাশ হয়েছিল- তা সত্যি অবাক করার মতো। শুধুই কি বিদ্রোহ ছিল? না। তার ছিল রোমান্টিসিজম।
এটি রোমান্টিসিজমের আধুনিকতা আছে, এই রোমান্টিসিজমের মধ্যে রেনেসাঁ আছে এবং এ রোমান্টিসিজম আমাদের স্বকীয় রোমান্টিসিজম, পাশ্চাত্যের রোমান্টিসিজম নয়। যে রোমান্টিসিজম আমরা জন্মগত, সহজাতভাবে অর্জন করি জীবনধারা থেকে- একেই কি বলব না- ‘এলিমেন্ট অব লাইফফোর্স’? নিশ্চয়। এটি নজরুলের মধ্যে ছিল এবং এটি নজরুল ইউরোপ থেকে পাননি- এটি তিনি শেলি, কিটস্, বায়রন থেকে পাননি- এটা তার ভেতর থেকে এসেছে। এসেছে দুটো পথে : একটি হচ্ছে- তিনি যে পর্যায় থেকে উঠে এসেছেন, দরিদ্র কাজী পরিবারে তার জন্ম- এ পরিবারের মধ্যে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্য ছিল; তা ছাড়া তিনি যখন করাচিতে ছিলেন সে সময়ও তিনি ইরান, তুরান, আরবি সাহিত্যসমূহ পাঠ করেছেন। মধ্যপ্রাচ্যের যে রোমান্টিসিজম, মানে সুফি ভাবধারার মাধ্যমে জীবনকে ভালোবাসা- তা নজরুলকে প্রভাবিত করেছে।
আর একটি ধারা হচ্ছে, ভারতীয় লোকায়ত সমন্বয়বাদী ধর্ম। আমাদের লোকজীবনে এক সমন্বয়বাদী পথ আছে এবং সেখানে মাতৃকেন্দ্রিক নিবেদন আছে- মায়ের কাছে শরণ প্রার্থনা করা, স্নেহতল প্রার্থনা করা- সব সন্তান সেখানে অবনত হচ্ছে। নজরুলও সে পথ অনুসরণ করেন। ভারতীয় পুরাণে নারীরা যে ক্ষমতা ও মমতার আধার, এটি নজরুল মনে মনে ধারণ করেছেন এবং সমীহ করেছেন।
তাই ‘কালো মায়ের পায়ের তলায় দেখে যা রে আলোর নাচন’- এই বলে তিনি, সেই বিদ্রোহী নজরুল, করুণাময়ী মায়ের পদতলে আশ্রয় নিয়েছেন, নত করেছেন নিজেকে। এই নত ভাব মানে পরাজয় নয়, আত্মসাঁকো বন্ধন। এ প্রণত ভাবটিই হল রোমান্টিসিজম। আর এটি এসেছে লোকায়তধারা ঐতিহ্য থেকে।
নারীর পায়ে নিজেকে সমর্পণ- হোক তিনি মা বা প্রিয়া- এ সমর্পণের ব্যাপারটি নজরুলের মধ্যে আছে ব্যাপকভাবে। তাই নজরুল পাশ্চাত্যের ঘরানায় নন, এদেশীয় ধারায় রোমান্টিক। অন্ধ পাশ্চাত্যানুসরণ নয়, স্বদেশিচেতনায় রোমান্টিক হওয়ার প্রেরণার জন্যও এ যুগে বারবার নজরুলকে স্মরণ করতে হয়।
নজরুলের কবিতা ‘বিদ্রোহী’- আমরা কে না জানি? সেখানে তিনি কী বলেছেন? আমিত্বের চাইতে কি অন্যকে উদ্বুদ্ধ করা নয়? মনে তো হয়। তিনি বলেছেন: ‘বল বীর-’। এই দিয়ে শুরু। তিনি নিজেকে বীর বলছেন না, বলছেন অন্যকে- বলছেন বাঙালিকে- বলছেন ভারতীয়দের- তোমরা বল: তোমরা ‘বীর’! ‘বল উন্নত মম শির।’ দুর্বল বাঙালি বা ভারতীয়দের জাগ্রত করতে চাইছেন তিনি। বলছেন- তোমরা দুর্বল নও- বল, তোমরা বীর এবং তোমাদের দেখে পর্বতও মাথা হেঁট করে আছে।
এভাবেই কিন্তু বড় বড় লড়াইয়ে নেতা তার অনুসারীদের অনুপ্রাণিত করেছেন। যেমন পৌরাণিক-সাহিত্যিক, তেমনি ঐতিহাসিক লড়াই। শ্রীমদ্ভাগবত ‘গীতা’য় কৃষ্ণ অর্জুনের মধ্য দিয়ে পাণ্ডব পক্ষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন; রাবণ তার অনুগত সৈন্যদের বলেছে : ‘জন্মভূমি রক্ষা হেতু কে ডরে মরিতে, যে ডরে ভীরু সে মূঢ়, শত ধিক তারে’। লেনিন বলশেভিক বিপ্লবের সময় রাশিয়ানদের উদ্দেশে ঐতিহাসিক অনুপ্রেরণামূলক বাণী কিংবা অনুগতদের জন্য হিটলারের বচন- নজরুলের এই ডাক এহেন চেতনার সঙ্গে তুলনা করা চলে।
প্রাসঙ্গিকভাবে নজরুলের আর একটি বচন খুব করে মনে পড়ে, যেখানে তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন : ‘আমাদের এমন একটি ছেলে দাও, যে বলবে আমি ঘরের নই আমি পরের, আমি আমার নই আমি দেশের।’ কী অসাধারণ কামনা! আত্মোৎসর্গের এমন কামনা এর আগে কি বাঙালি পেয়েছে? এটাকে অনেকে মুসলিম কমিউনিটিকে জাগানো কথা হিসেবে বলেন। হ্যাঁ, প্রথম জীবনে মুসলিম জাগরণের প্রতি নজরুলের আগ্রহ ছিল। কিন্তু অতি অল্প পরই তিনি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়চিন্তার বাইরে চলে গেলেন।
শুধু মুসলিম নয়, সব বাঙালি, সব ভারতবাসী তার লক্ষ্য হল। আর সারাজীবন এই বোধ তিনি লালন করতেন। ১৯২৬ সালে নজরুল যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে বক্তৃতা দিতে আসেন, তখন মুসলিম ছাত্রদের অনেকেই আশা করেছিলেন, নজরুল মুসলিম উম্মাহকে জাগানোর আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য দেবেন।
আবদুল কাদিরের লেখাতে এ আকাঙ্ক্ষাটি প্রকাশ পায়। নজরুল কিন্তু তা করেননি। বরং তিনি ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন, যে কবিতা পরমভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারী। ফলে বোঝাই যায়, পরিস্থিতির চাপের কাছেও নজরুল আদর্শিক পথ থেকে বিচ্যুত হন নি, আজ অনেকের মধ্যেই যে বিচ্যুতি দেখা যায়।
নজরুলের আর একটি বড় গুণ হল, তিনি সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন- ভারতীয় সংস্কৃতি, মধ্যপ্রাচ্যের সংস্কৃতি, এমনকি গ্রিক সংস্কৃতির সমন্বয় ঘটিয়েছেন তার লেখায়। এর প্রভাব কিন্তু পরে তিনি রেখে যেতে পেরেছিলেন।
যেমন, গত শতকের নব্বই দশকের যে আন্তঃসাংস্কৃতিক বয়ান কবিরা করেছেন, তার সঙ্গে কিন্তু নজরুলেরই সরাসরি মিল পাওয়া যায়- অন্য কারও নয়। ষাট বছর বা তারও একটু বেশি পরে এমন মিল পাওয়া সত্যি আশ্চর্যের। প্রভাবক শক্তি কতটা শক্তিশালী হলে এটি সম্ভব! নজরুল এমনটি করতে পেরেছিলেন। আর এসব কারণেই নজরুল আজও প্রাসঙ্গিক আমাদের সমাজে।
লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়