
মুবিন খান
সেলিম আল দীন যখন তাঁর প্রথম নাটক ‘জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ লিখলেন, মূলত ‘জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটক দিয়েই সেলিম আল দীনের নাসির উদ্দিন ইউসুফকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা থিয়েটারের পথচলার শুরু। অনেকেই ওই নাটকটিকে বাংলাদেশের আধুনিক নাটকের গোড়াপত্তন হিসেবে অভিহিত করেন। অদ্ভুত নাটক ছিল সেটি। সংলাপের পরম্পরা নেই, দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরের কোনও ধারাবাহিকতা নেই। বাংলা নাটকের প্রচলিত ধারাকে ভেঙে, ঔপনিবেশিক ধারাকে পরিহার করে সেলিম আল দীন সম্পূর্ণ নতুন একটি ধারার প্রবর্তন করেছিলেন সে নাটকে। অনেকটা অ্যাবসার্ড থিয়েটারের মতো।
সেলিম আল দীনের বিশেষত্বটাই এই, নাটকের যে প্রচলিত ঔপনিবেশিক ধারণা সেটার গোড়াটাকে একেবারে নাড়িয়ে দিয়ে সরিয়ে দিয়ে ভেঙে দিয়ে নতুন ধারা তৈরি করা। এমন কি নাটকের নাম নির্বাচনের ক্ষেত্রেও সেলিম আল দীন তাঁর প্রথাবিরোধী ভাবনার পরিচয় তুলে ধরেছিলেন। ‘জণ্ডিস ও বিবিধ বেলুন’ নাটকটি আজ আমাদের আলোচ্য নয়। তবুও নাটকটির কথা আসবার কারণ হলো সেটি ছিল একই সঙ্গে সেলিম আল দীন-নাসির উদ্দিন ইউসুফ-ঢাকা থিয়েটার আর বাংলা নাটকের প্রচলিত ধারার বাইরে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম নাটক। সেলিম আল দীন নাটকের উপস্থাপনা, বক্তব্য, স্ক্রিপ্ট লেখার ধরণ, অভিনয়ের ধারাবাহিকতা, নাটকের আলাদা ভাষিক কৌশল সবই বদলে দিতে শুরু করেছিলেন।
সেলিম আল দীনের এই প্রথা ভাঙার ধারার আরেকটি এবং অন্যতম নাটক ‘মুনতাসীর ফ্যান্টাসি।’ অনেক পরে অবশ্য সেলিম আল দীন নিজেই নাটকে ব্যবহার করা ‘মুনতাসির ফ্যান্টাসি’র শেষাংশ অর্থাৎ ‘ফ্যান্টাসি’ শব্দটি বাদ দিয়েছিলেন। আমরা জেনেছিলাম নামকরণে নতুনত্ব আনার লক্ষ্যেই ‘ফ্যান্টাসি’ শব্দটি বাদ দিয়েছিলেন। এই নাটকটিও তাঁর প্রথা ভাঙবার শুরু করবার সময়কার। সেলিম আল দীনের নাটক বলতে আমরা ঢাকা থিয়েটারের নাটকই বুঝতাম। কিন্তু এবারে এই প্রথাটিও ভাঙা হলো। এবং প্রথাটি ভাঙলো মঞ্চনাট্য দল ‘নাট্যজন।’
‘নাট্যজন’ তাদের দশম প্রযোজনা হিসেবে নির্বাচিত করেছে নাট্যাচার্য সেলিম আল দীনের ‘মুনতাসির।’ নাটকটি প্রথম মঞ্চায়িত হয়েছিল ১৯৭৩ সালে। ‘মুনতাসীর’কে বলা হয় বাংলাদেশের প্রথম মিউজিক্যাল কমেডি। এর আঙ্গিকটা লক্ষ্য করবার মতো। নাটকের শুরু থেকেই একদল বাদ্য বাজাতে বাজাতে মঞ্চে আবির্ভূত হয় এবং নাম ভুমিকা চরিত্রটির সম্পর্কে আমাদেরকে তথ্য সরবরাহ করতে থাকে। প্ল্যাকার্ড নিয়েও কজন পুরো নাটক জুড়েই মঞ্চে আসা যাওয়া করতে থাকে। তাদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডগুলোতেও নাম ভুমিকা চরিত্রটির সম্পর্কে তথ্যে পূর্ণ। নাটকের গল্প বিন্যাসে রচনাকালের সমসাময়িক সময়টাকে পাওয়া যায়। সময়টা মুক্তিযুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশের। সেলিম আল দীন গল্পে খামখেয়ালী আর রাক্ষসের মতো সর্বভুক এক চরিত্র এঁকেছেন। এই চরিত্রটিই পুরো মঞ্চটাকে নিয়ন্ত্রণ করে চলে। এই চরিত্রটিই মুনতাসির। ওই সময়ের সৃষ্টি, বস্তু থেকে শুরু করে সৃজনশীলতা, প্রেম, দ্রোহ, ইতিহাস, আন্দোলন সবই খেয়ে ফেলার তাড়না নিয়ে মুনতাসির মঞ্চে চলমান থাকেন। ঘুমের ঘোরে হাঁটাহাঁটি করেন। লক্ষ্যহীন এলোমেলো দৃষ্টি আর চলাচল মুনতাসিরের। সমাজ, রাষ্ট্র, অফিস, আদালত, এমনকি হাসপাতালের মতো মানবিক চেতনায় উন্মুখ থাকার জায়গাটিও হয়ে ওঠে অবহেলা আর উদাসীনতার প্রতীক।
হাসপাতালের এক ডাক্তার আমাদের জানালেন, মুনতাসির মাল্টিমিলিওনার। এবং জাতীয়তাবাদী নেতাও। বাঙালি জাতির ইতিহাসে মুনতাসির সেই বিশ্রুত ব্যক্তি যাঁর রাজনৈতিক ইতিহাস তাঁর ব্যাংক ব্যালেন্সের অঙ্কের মতোই প্রচুর চাঞ্চল্যকর ঘটনায় পূর্ণ। যুদ্ধের আগে মুনতাসির দুটা ছোট লজেন্স ও শিশুতোষ খেলনা তৈরি কারখানার মালিক ছিলেন। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনে লক্ষ লক্ষ মানুষ মুনতাসিরের কারখানার লজেন্স খেয়েই নাকি মার্চের খর রোদে স্লোগান আর সংগ্রাম করবার প্রথম প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন।
কিন্তু যুদ্ধ শুরু হলে মুনতাসির হঠাৎ করেই নিশ্চুপ হয়ে যান। তাঁর কারখানা দুটোও বন্ধ হয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েকদিন আগে পয়লা ডিসেম্বরে মুনতাসির পশ্চিমা শোষকদের হাতে ধরা পড়েন। ধরা পড়বার পর একটানা ষোলদিন মুনতাসিরকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। তখন থেকেই মুনতাসিরের অসুখটার শুরু। মুনতাসিরের অসুখটার নাম এপেটাইট। এ অসুখ মুনতাসিরকে রাক্ষসের মতো সর্বভুক বানিয়ে ফেলে। তিনি শুধু খাই খাই করেন। কোনও কিছুতেই তাঁর অরুচি নেই। তিনি শিল্প খেয়ে ফেলেন, সমাজ খেয়ে ফেলেন, অর্থনীতি খেয়ে ফেলেন, মনুষ্যত্ব খেয়ে ফেলেন, পুরো দেশটাই যেন মুনতাসির তাঁর পেটে ঢুকিয়ে ফেলতে চান। অতৃপ্ত হিংস্র পুঁজির রাক্ষুসে ক্ষুধায় মুনতাসির সবকিছুই নিঃশেষ করে দিতে চান, কিছুই বাদ দেন না, সবই তিনি চান গোগ্রাসে খেয়ে ফেলতে।
অবশেষে অস্ত্রোপচার হয় মুনতাসিরের পেটে। অস্ত্রোপচারের টেবিলে মুনতাসিরের পেট থেকে বের হয় টিসিবির শাড়ি, গামছা, দলিলপত্র, শিল্প-সঙ্গীত, নারীর আব্রু, দড়িসহ আরও অনেক কিছু। মুনতাসির অস্ত্রোপচারের সময় মারা যান। তবে এখানেই এই মিউজিক্যাল কমেডি শেষ হয় না।
আমরা জানতাম, মুক্তিযুদ্ধের পরের বাংলাদেশটাতে রাক্ষুসে ক্ষুধার মুনতাসিরদের দৌরাত্ম্য বেড়ে গিয়েছিল। সে সময়ের পত্রপত্রিকা, কথাসাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্রগুলোও আমাদের সেই তথ্যই দেয়। কিন্তু সেলিম আল দীন মুনতাসিরকে দিয়ে জানালেন, মুনতাসিরদের দৌরাত্ম্য আসলে তখন শুরু হয়েছিল। মুনতাসিরের পেট থেকে বের হওয়া সুদীর্ঘ দড়িটি ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের স্বার্থপর আর লোভী লোকেদের মুনতাসিরের রিপু নিয়ে বেঁধে ফেলতে শুরু করেছিল। সেলিম আল দীন ‘মুনতাসির’ দিয়ে আমাদের সচেতন করতে চাইলেন। আমরা ‘কমেডি’ নিলাম, সচেতন হওয়ার বারতা নিলাম না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের তালিকা আমাদের জানাচ্ছে, আজকের বাংলাদেশে ২০১৩-১৪ সালের করবর্ষের সম্পদ বিবরণীর তালিকা অনুযায়ী বাংলাদেশের শীর্ষ সম্পদশালী ৫০ ব্যক্তির তালিকায় দেখা গেছে ১০০ কোটি টাকার বেশি নিট সম্পদের মালিক রয়েছেন ২৭ জন। আর ৫০ কোটি টাকা বা তার চেয়ে বেশি টাকার নিট সম্পদের মালিক রয়েছেন এমন সম্পদশালীর সংখ্যা ৪৬ জন। গেল পাঁচ বছরে এঁদের সম্পদের পরিমাণ আরও বেড়েছে। বেড়ে গেছে ধনী লোকের সংখ্যাও। বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে বঞ্চিত করে অল্প কিছু মানুষ দেশের সম্পদকে কুক্ষিগত করে ফেলছে। ঠিক এই বার্তাটিই মানুষের কাছে পৌঁছে দিতেই নাট্যমঞ্চদল ‘নাট্যজন’ নতুন করে নতুন আঙ্গিকে নিয়ে এল মঞ্চে। কাজটি সফলভাবে করতে পারার জন্যে ‘নাট্যজন’ অবশ্যই ধন্যবাদ আর প্রশংসার দাবীদার।
‘নাট্যজন’-এর সকল অভিনয় শিল্পীরাই ভালো কাজ করেছেন। উল্লেখ করবার মতো অভিনয় করেছেন দল প্রধান তবিবুল ইসলাম (বাবু)। তিনি অভিনয় শৈলী দিয়ে তাঁর বয়সকে অতিক্রম করে ফেলেছেন। নির্দেশক সেলিম কামাল এবং বিজন সরকারের অভিনয়ও উপভোগ্য ছিল। আলো প্রক্ষেপণ শতভাগ নির্ভুল না হলেও আলো নিয়ে অভিযোগ করবার মতো কারণ তৈরি হয় নি। অভিযোগ তৈরি হয়েছে শব্দ ব্যবস্থা ও নিয়ন্ত্রণ নিয়ে। আবহ সঙ্গীত আর দৃশ্য ও সংলাপের মাঝে মাঝে হঠাৎ হঠাৎ যেভাবে ‘তথাকথিত কমেডি শব্দ’ বেজে উঠছিল সেটি নাটকের জন্যে সহায়ক হয় নি। আচমকা ওই ‘কমেডি শব্দে’ দর্শক চমকে উঠছিল। দর্শকের বুকে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছিল। সঙ্গীত নিয়ন্ত্রণে রাজীব মল্লিক রাজুর আরও সচেতন হওয়া জরুরি। প্রত্যাশা রইল পরবর্তী মঞ্চায়নে নির্দেশক সেলিম কামাল এই বিষয়টির দিকে মনোযোগ দেবেন।
আমরা দেখেছি ‘নাট্যজন’-এর নাটক উপস্থাপনার ক্ষেত্রে সবসময় নির্মল হয়। তাদের মঞ্চায়িত নাটকের তালিকার দিকে চোখ মেললেই এর সত্যতা পাওয়া যায়। ৮ মার্চ ছিল ‘মুনতাসির’ নাটকের উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। আমরা আশা করছি ‘মুনতাসির’ মঞ্চায়নে ‘নাট্যজন’ ‘ঢাকা থিয়েটার’কেও ছাড়িয়ে যাবে। ‘মুনতাসির’ ও ‘নাট্যজন’ পরিবারের জন্যে শুভ কামনা।