মূল লেখাঃ ইকবাল বাহার
ইংরেজি থেকে অনুবাদঃ মুবিন খান
আপনি কি বিয়ে ব্যাপারটাকে পাগলামি মনে করেন? কিংবা প্রেম বিষয়টাকে পাগলামি ভাবেন, নাকি শুধু সম্পর্ক ব্যাপারটাকেই পাগলামি বলে মনে হয়?
‘প্রতিশ্রুতি’ বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন? আপনি যতটা দৃঢ়তায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে একজন নারীকে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেছেন, এই সম্পর্কটাকে আপনার কি মনে হয়? অথবা একজন নারী যখন সম্পূর্ণ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে আপনাকে স্বামী হিসেবে গ্রহণ করেলেন, এটিকেই বা আপনি কিভাবে দেখেন?
আসলে বিয়ে ব্যাপারটাই হল প্রতিশ্রুতি, একতা, বিশ্বস্ততা, বন্ধুত্ব, স্নেহ, সম্মান আর সর্বোপরি ভালোবাসা; এবং অসম্ভব সুন্দর একটা সম্পর্ক, যা সম্পর্কর আদান প্রদানে সম্পর্ককে অমূল্য করে তোলে।
এই ব্যাপারটিই প্রতিশ্রুতি। প্রতিশ্রুতির ধারণাটিকে এই কারণেই সম্পর্কর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আজকের পৃথিবীতে সম্পর্কর এই প্রতিশ্রুতির ধারণাটিই পাল্টে গেছে। বর্তমানে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সামান্য ভুল বোঝাবুঝিকেও প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হিসেবে অভিহিত করে, বৈবাহিক দ্বন্দ্বর সমাধান হিসেবে বিয়েবিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফেলছে।
এই লেখায় আমরা আপনি আপনার স্বামী বা স্ত্রীর প্রতি সত্যিকারভাবেই কতটা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং সেসব প্রতিশ্রুতিতে আপনাদের বিয়ের প্রভাব কতটা, সেটি জানার চেষ্টা করব।
একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী খুঁজে পাওয়া যদি কঠিন হয়, সেক্ষেত্রে বিয়ে ঝুঁকি হয়ে যায় কিনা সেটাও একটু অনুসন্ধান করে দেখা যাক। একজন বিশ্বস্ত সঙ্গী খুঁজে পাওয়া কি সত্যিই কঠিন?
এখানে অবিশ্বস্ততার কারণ হিসেবে আমরা বিনোদনের প্রভাবকে একটা কারণ হিসেবে উল্লেখ করতে চাই। হ্যাঁ, বিনোদনের একটা ভূমিকা থাকতে পারে। আপনার বাসার টেলিভিশনে আপনি যেসব অনুষ্ঠান এবং নাটক, সিনেমা দেখেন সেগুলো বিয়ের পবিত্রতাকে কতটা সমর্থন করে? এক মিনিটের জন্য একটু ভাবুন তো, সেখানে প্রতিশ্রুতি সাধারণত কিভাবে চিত্রিত হয়? পরকীয়া, মিথ্যাবাদীতা, মানসিক নিষ্ঠুরতা এবং বিয়ের বাইরে শারীরিক সম্পর্ক সেখানে খুবই সাধারণ ঘটনা। এগুলো আমাদের মনস্তত্ত্বকে এমনভাবে নির্মাণ করে দিচ্ছে যে, আমরা এই জঘন্য ব্যাপারগুলো খুব সহজেই মেনে নিচ্ছি। এবং আমরা যাদেরকে ভালোবাসি, তাদেরকে প্রতিনিয়ত হতাশ করে চলেছি- বিশেষত আমাদের স্বামী বা স্ত্রীকে।
এইরকম বাস্তবতায় কেউ কেউ সম্পর্ককে এমন একটি মাত্রায় পৌঁছে দেন যেখানে অবিশ্বস্ততা, আস্থাহীনতা আর সহাবস্থানকে নিরুৎসাহীত করে। তাহলে সেই সম্পর্কটি কি করে প্রত্যাশিত সম্পর্ক হবে!
যৌনতা মানে নিছক শারীরিক মিলন নয়। সেখানে ভালোবাসার আবাস থাকে। তাকে এড়িয়ে নিছক শারীরিক মিলন দুজন মানুষকে মানসিক, এমনকি আধ্যাত্মিক দায়বদ্ধতার দিক থেকেও আলাদা করে ফেলে। এইভাবে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার, এভাবেই একসঙ্গে থাকবার ধারণাগুলোকে সহজ আর গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এইভাবে বসবাস করাটাকে মানুষ তখন যৌক্তিক ভাবতে শুরু করে।
তত্বগতভাবে মানুষের এমন কোন সম্পর্ক নেই যেটাতে আবেগ জড়িত নয়। আর এখানে সম্পর্কটা শুধুই শারীরিক-অতঃপর তারা যে সম্পর্কটির কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, সেটি ভুলে গিয়ে দিন শেষে সেই নিজের নিজের স্বামীটি বা স্ত্রীটির কাছে, শরীরবৃত্তিয় সম্পর্কটির কাছে ফিরে যায়। আর তাদের এই প্রতারণা ধরা পড়ে গেলে খুব বিস্মিত কন্ঠে বলে, ‘আরে এটা কিছুই নয়। ওটা নিছকই যৌনতা ছিল। আমি তো তোমাকেই ভালোবাসি।’
তবে সকলেই এই মানসিকতা নিয়ে সম্পর্ক নির্মাণ করেন, সেটা আমি বিশ্বাস করি না। কিন্তু প্রশ্ন করতেই পারি, কজন দম্পতি বিশ্বাস করেন যে ‘প্রতিশ্রুতি’ শুধুমাত্র নিছক একটি শব্দ নয়?
হ্যাঁ, আমি জানি, অসংখ্য স্বামী-স্ত্রী এখনও তাদের বিয়ের প্রতিজ্ঞাকে সম্মান জানিয়ে একসঙ্গে বসবাস করছেন, সুখে-দুঃখে, প্রাচুর্যে-দারিদ্রে পরম বিশ্বাস আর আস্থায় তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে চলেছেন।
কিন্তু কেন?
হ্যাঁ, কারও কারও জন্যে এটা ভালোবাসা। কিন্তু অন্যেরা যারা একসঙ্গে থাকছেন, তারা একসঙ্গে থাকবার প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ বলে, ভালোবাসা কিংবা শ্রদ্ধাবোধ থেকে নয়। ব্যাপারটা অনেকটা রুমমেট বা ব্যবসায়ি অংশীদারের প্রতিশ্রুতির মতই।
আজ দাম্পত্য জীবনের প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকারের অধঃপতন, সম্পর্কর গভীরতার এমন উপেক্ষা সত্যিই খুব দুঃখজনক। ফলে বিয়ে ব্যাপারটা তার গভীরতাকে হারিয়ে একটা ‘দেখানোপনা’ ব্যাপারে পরিণত হয়ে উঠেছে, আর ‘আস্থা’ রূপ নিয়েছে ‘বলিদান’-এ।
কিন্তু তারপরও, এখনও অসংখ্য বিয়ে নামের পবিত্র সম্পর্কটি সত্যিকার প্রতিশ্রুতির ওপরেই টিকে আছে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি আপনি নিজেও এই মুহূর্তে তেমনই কিছু সম্পর্কের কথা ভাবছেন। তাদেরকে আপনি প্রকৃত স্বামী বা স্ত্রীর প্রতিশ্রুতির দৃষ্টান্ত হিসেবে ধরতে পারেন।
উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, কোন কোন যুগল বিশ্বাস করেন, বিয়ের আগে সবচেয়ে ভালো বন্ধু হতে পারলে তাদের দাম্পত্য জীবনে পরস্পরের প্রতি একটা বোঝাপড়া তৈরি হবে, এর ফলে তারা পরস্পরের প্রতি সহানুভূতিশীল, যত্নশীল কিভাবে হতে হবে সেটা তারা জেনে যাবেন- আর তাদের এই বন্ধুত্বর ভিতটি নির্মিত হয় পরস্পরের প্রতিশ্রুতি এবং আস্থায়।
অথবা এমন একজন স্বামীর কথাই ধরুন, যিনি তার স্ত্রী ও সন্তানদের হারাবার ভয়ে, সম্পর্কটিকে মূল্যায়ন করতে অনৈতিক একটা সম্পর্কে জড়ানোর কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারেন না। অথবা একজন স্ত্রীর কথা ভাবুন যিনি ঈশ্বরের কাছে জবাবদিহীতার ভয়েই প্রলোভন এড়িয়ে চলেন।
অনেক মানুষই এরকম প্রতিশ্রুতি ফোবিয়ায় আক্রান্ত। তারা নিজেকে কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়াতে ভয় পায়। সম্পর্ক তৈরি হওয়ার আগেই তারা সম্পর্কর অনিশ্চয়তা নিয়ে ভীত থাকে।
এমন অনেক মানুষ আছেন যারা মনে করেন যদি তিনি একটা কাউকে ভালোবাসেন, একটা সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন তবে ভালোবাসার মানুষটি হয়ত তাকে ছেড়ে একদিন চলে যেতে পারে। সম্পর্কটা টিকবে কিনা- এটা নিয়ে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন। কিন্তু অন্তরের অন্তঃস্থলে তারা যদি নিজেদের সঙ্গে সৎ থাকেন, আশাবাদী মানুষ হন এবং নিজেদের কাছেই বিশ্বস্ত থাকবেন সিদ্ধান্ত নেন তাহলে হয়ত তারা এমন কাউকে খুঁজে পেতেও পারেন যে কিনা নিশ্চয়তা হিসেবে কোন প্রতিশ্রুতি খুঁজবে না। এখানে তখন ভালোবাসাটাই প্রতিশ্রুতি। সেই সম্পর্ক হয়ে উঠবে আস্থার, বিশ্বাসের আর সত্যিকার ভালোবাসার।
প্রতিশ্রুতি আসলে কি।
প্রতিশ্রুতির একটা আলাদা অর্থ আছে।প্রতিশ্রুতির অর্থ অনেকটা যেমন আপনি কঠোর পরিশ্রম করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন কিন্তু সে পরিশ্রম আপনাকে কোন ফলাফল এনে দিচ্ছে না। এখানে প্রতিশ্রুতি হল, হয়ত আপনি এর সুফল পাবেন, আবার হয়ত কিছুই পাবেন না।
এর মানে হল, একটি সুখি দাম্পত্য জীবন গড়তে যা যা করা দরকার হয় আপনি সবই করবেন। বিয়ে তেমনই একটা সম্পর্ক যাতে বিনিয়োগ করতে হয় স্নেহ, সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস এবং ভালোবাসা। এ এমন এক অভিজ্ঞতা যা গভীর আনন্দর সৃষ্টি করে, নিরাপত্তাবোধ তৈরি করে এবং স্বতন্ত্রতা বজায় রেখে তাদের এমন এক মাত্রায় নিয়ে যায়, যে যাই ঘটুক না কেন, পরস্পরের প্রতিশ্রুতির প্রতি যদি শ্রদ্ধাবোধ থাকে তাহলে সে সম্পর্কটা তাদেরকে নিয়ে যাবে একটি সুন্দর আর চমৎকার পরিণতির দিকে, টিকে থাকবে জীবনের শেষ কাল পর্যন্ত।