মনের প্রতিধ্বনিমুক্তমত
প্রবাসীর বঙ্গবন্ধু
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এগার শ' মাইল দূরত্বে নিয়ে গিয়েও, নয়টি মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রেখেও, হত্যা করতে চেয়েও তারা তাঁকে ছুঁতেও পারে নি। ফিদেল ক্যাস্ট্রো যেমন বলেছিলেন হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব। সেই হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের কাছে কেবল ভুট্টো নয়, পরাজিত হলো আসলে পুরো পশ্চিম পাকিস্তান।
কদিন আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক বক্তৃতায় বলেছেন, ‘আব্বাকে আমার মা বলতেন, ‘আপনি যখন জেলে যান, তখন সাজানো বাগান রেখে যান কিন্তু জেলখানায় যাওয়ার পরই এ বাড়ি (ধানমন্ডি ৩২) বিরানভূমি হয়ে যায়। কেউ আসে না, যদি আমাদের সহায়তা করতে হয়। আবার আপনি যখন আসেন, তখন বাগান ভর্তি হয়ে যায়।’
প্রধানমন্ত্রী কথাগুলো কেবল অন্তরের ক্ষোভ থেকে বলেন নি। ক্ষোভ তো ছিলই। সে ক্ষোভের সঙ্গে আরও ছিল কষ্ট। ক্ষোভের সঙ্গে কষ্ট মিশে গিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে উচ্চারণ করিয়েছিল, ‘এত উৎসাহী থাকলে ‘৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতাকে হত্যার পর লাশ সেখানে পড়ে থাকত না। আমার মা (বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব) এবং পরিবারের সদস্যদের রেড ক্রিসেন্টের শাড়ি দিয়ে দাফন করা লাগত না। এখন আমি মারা গেলে কী হবে, তাও জানি। কাজেই কোনও বাড়াবাড়ি নয়।’
গেল কবছর ধরে একুশে বইমেলায় দেখি বাংলা একাডেমী প্রাঙ্গণ জুড়ে শতাধিক স্টল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিয়ে বসে। তাঁদের অনেক প্রকাশনাও আছে। আছে বিশাল পরিসরের গ্রন্থ। সেসব গ্রন্থ গবেষণা গ্রন্থ হিসেবেই পরিচিত আমাদের কাছে। তবে অনেকের কাছেই শুনেছি, ওসব গ্রন্থ নাকি যতটা গবেষণা, তারচেয়ে বেশী অতিরঞ্জিত করা। আমার অবশ্য ধারণা নেই। পড়া হয়ে ওঠে নি। তবে একুশে বাংলা একাডেমীর প্রাঙ্গণ জুড়ে গড়া স্টলগুলো দেখবার পর চকিতে মনের কোণে যে ভাবনাটি উঁকি দিয়েছিল, সেটি প্রধানমন্ত্রীর ক্ষোভ আর কষ্ট মিশ্রিত উচ্চারণের সঙ্গে খুব মিলে গিয়েছিল।
সত্যিই তো! ‘৭৫ থেকে ‘৯০ পর্যন্ত এরা কোথায় ছিল?
আমি দেশে থাকি না অনেক বছর। সেকারণে দেশের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের খবরটি রাখলেও প্রত্যক্ষ করা হয়ে ওঠে না। ফলে ‘৭৫-এর পরের যে বাংলাদেশ, ‘৮০ থেকে ‘৯০-এর যে বাংলাদেশ, তার সঙ্গে এখনকার বাংলাদেশের ভেদাভেদটা হঠাৎ যখন চোখে পড়ে, বড় প্রকট লাগে। মেলাতে পারি না। তখন বিস্মিত হওয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
‘৭৫-এর ১৫ আগস্টে একদল বিপথগামী সেনা সদস্য যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে শহীদ হন। বিদেশে থাকায় তাঁর দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যান।
৭ মার্চের ভাষণে মানুষ হয়েছিল দশ লক্ষ। এই দশ লক্ষ মানুষই জয় বাংলা ধ্বনি দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই দশ লক্ষ মানুষই ‘এবার স্বাধীনতার সংগ্রাম’- বলে সুতীব্র চিৎকারে গলার রগ ফুলিয়ে ফেলেছিল। অথচ ‘বত্রিশ নম্বরের বাড়িটি বিরানভূমি হয়ে যায়। কেউ আসে নি, যদি আমাদের সহায়তা করতে হয়!… জাতির পিতাকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পর লাশ সেখানেই পড়েছিল। বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব এবং পরিবারের সদস্যদের রেড ক্রিসেন্টের শাড়ি দিয়ে দাফন করতে হয়েছিল। সে সময়ের নোবেল বিজয়ী উইলিবান্ট বলেছিলেন, ‘মুজিব হত্যার পর বাঙালীদের আর বিশ্বাস করা যায় না,যারা মুজিবকে হত্যা করেছে তারা যে কোনও জঘন্য কাজ করতে পারে।’
বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির রূপকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যেদিন তিনি ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ উচ্চারণ করলেন, বস্তুত সেদিন থেকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটির উদ্ভব হলো। ৭ মার্চের তাঁর ওই উচ্চারণের কারণেই ভুট্টো ২৫শে মার্চ নামে একটা চিরস্থায়ী ক্ষত দিয়ে দিল বাঙালি জাতিকে। সে রাতেই তাঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে গেল পাকিস্তানে। কিন্তু চাইলেও তাঁকে হত্যা করবার মতো দুঃসাহস অর্জন করতে পারে নি।
এদিকে বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ওই উচ্চারণকে প্রতিষ্ঠা করতে অবতীর্ণ হলো যুদ্ধে। সে যুদ্ধ বাঙালির মুক্তির যুদ্ধ। শোষক পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মুক্তি। শোষক আর শোষিতর রক্তক্ষয়ী সে যুদ্ধে বিজয়ী শোষিতেরই হলো। বিজয়ী হলেন শোষিত মানুষদের নেতাও। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এগার শ’ মাইল দূরত্বে নিয়ে গিয়েও, নয়টি মাস কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে বন্দি করে রেখেও, হত্যা করতে চেয়েও তারা তাঁকে ছুঁতেও পারে নি। ফিদেল ক্যাস্ট্রো যেমন বলেছিলেন হিমালয়সম ব্যক্তিত্ব। সেই হিমালয়সম ব্যক্তিত্বের কাছে কেবল ভুট্টো নয়, পরাজিত হলো আসলে পুরো পশ্চিম পাকিস্তান।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে লন্ডনে যান ৮ জানুয়ারি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী লন্ডন থেকে দিল্লি, এরপর দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছুতে এয়ার ইন্ডিয়ার ব্যবস্থা করতে চাইলেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান এই প্রস্তাবটি গ্রহণ করে নি। তিনি ব্রিটিশ বিমানকে বেছে নিলেন। কেননা তাঁর মনে হয়েছে এতে ভারতের ওপর নির্ভরশীল বলে একটা জনমনে ধারণা জন্মাতে পারে।
মুক্তিযুদ্ধের সময়টাতে লন্ডন শহরটার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে। লন্ডনে থেকে প্রবাসী বাঙালিরাও মুক্তিযুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। অস্ত্র হাতে নয়, বিবেক হাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে রাজপথে নেমেছিলেন তারা। লন্ডনের রাজপথে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস ধরে বিক্ষোভ, মিছিল, মিটিংয়ের কর্মসূচি পালন করে গেছেন। নাড়িয়ে দিয়েছিলেন বিশ্ব বিবেককে।
তারা লন্ডনে পাকিস্তান হাইকমিশন কার্যালয় ঘেরাও করেন। পাকিস্তানি পতাকা ও স্বৈরশাসক ইয়াহিয়ার প্রতিকৃতিতে আগুন দেন। স্বাধীন বাংলার স্মারকলিপি পাকিস্তানের হাইকমিশনারের হাতে তুলে দেন। ২৫ মার্চের কালরাতে শুরু হয় অপারেশন সার্চলাইট নামের সে ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ। হতাশ, মুষড়ে পড়া স্বদেশিদের চাঙা করতেই মানুষের কানে কানে পৌঁছানো হয় সে অমোঘ মন্ত্রটি, ‘দেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে’। এর সবই তারা করছিলেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের মতোই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সদ্য ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশ ও তাঁর নেতৃত্ব মেনেছিলেন বলেই।
প্রবাসীদের ওপর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এই যে প্রভাব, সেটি আজও সমানভাবে বিদ্যমান। তখন থেকে এখনও মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, বিজয় কিংবা বাঙালিয়ানার ব্যাপারগুলো যখনই সামনে আসে, সকল প্রবাসীরা পরম উদ্বেলতায় বিপুল উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সকল ব্যস্ততা মুলতবী করে ছুটে এসে যুক্ত হন। কেননা মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, বিজয় কিংবা বাঙালিয়ানা মানেই তো শেখ মুজিব। যে মানুষটি বাঙালিকে বর্ণবৈষম্যের শিকার হতে দেখে ফুঁসে উঠেছিলেন। সাংবিধানিকভাবে সকল অধিকারের দাবীদার হলেও কার্যত বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেনির নাগরিক করে রেখেছিল বলে শাসকদেরকে তর্জনী তুলে শাসিয়ে দিয়েছিলেন।
বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কতটা জরুরি সেটা খুব করে উপলব্ধি করেন প্রবাসী মানুষেরা। কিন্তু সকলে সে প্রতিবাদটা করে উঠতে পারেন না। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের আদর্শ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর চাইতে যোগ্য কে আছে?
শুরুতে বাংলা একাডেমীর স্টলগুলোয় বঙ্গবন্ধুর নাম ব্যবহারে আধিক্যের কথা বলেছিলাম। আমার সঙ্গী বলছিলেন ওসব প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলোই নাকি ভুঁইফোড়। রাজনৈতিক সুবিধা পেতে আর ক্ষমতার রসাস্বাদনের লক্ষ্যেই নাকি ওসবের উৎপত্তি। দেশে থাকি না বলে এ ব্যাপারগুলো জানিও না। হতে পারে এর অনেকগুলোই হয়ত ভুঁইফোড়। কিন্তু যারা প্রবাসে আছেন, তাদের তো রাজনৈতিক ক্ষমতা অথবা সরকারি সুবিধা- কোনটিই ভোগ করবার সুযোগ নেই। ফলে তারা যখন মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ, স্বাধীনতা, বিজয় আর বাঙালিয়ানাকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে একাকার করে ফেলেন, সেটা তারা নাড়ির টানেই করেন।◉
লেখক: সম্পাদক, রূপসী বাংলা
প্রচ্ছদের ছবি এঁকেছেন বিপ্লব দত্ত