বাংলাদেশের বন্ধু পন্ডিত রবি শংকরের জন্মদিন আজ
আজ পন্ডিত রবি শংকরের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে রবি শংকর আজ ১০১ বছর অতিক্রম করতেন। পন্ডিত রবি শংকরের জন্মেছিলেন ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল। ভারতের উত্তরপ্রদেশের বারাণসী শহরে। তাদের আদি পৈত্রিক বাড়ি ছিল বাংলাদেশের নড়াইল জেলার কালিয়া উপজেলায়। রবি শংকরের মূল নাম রবীন্দ্র শংকর। ছোটবেলায়ায় তাঁর ডাক নাম ছিল ‘রবু’। অনেকে রবি বলেও ডাকতেন।
আমরা রবি শংকরকে ভুলি নি। ভুলব না কোনোদিন। আমাদের মুক্তির যুদ্ধে রবি শংকরের অবদানের কথা আমরা ভুলে যাই নি। তিনি আছেন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে। থাকবেনও। তাঁর কাজ, তাঁর মানবিক বোধ, তাঁর বন্ধুত্ব আমাদের প্রতিনিয়ত অনুপ্রেরণা যোগাবে। তাঁর মনুষ্যত্ব আমাদের দেবে প্রেরণা।
বাংলাদেশের আরেক পরম বন্ধু জর্জ হ্যারিসন। বন্ধু তিনি রবি শংকরেরও। রবি শংকর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘রবি শংকর হলেন বিশ্ব সঙ্গীতের দেবপিতা।’ রবি শংকর সেতারবাদনের বিশ্ব সম্রাট। এই শ্রেষ্ঠত্বের জন্য তিনি বিশ্বব্যাপী সুপরিচিত। বাঙালি সঙ্গীতজ্ঞের তিনি বিংশ শতাব্দীর একজন কিংবদন্তি। রবি শংকর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য এবং ভারতীয় সঙ্গীতকে পাশ্চাত্য বিশ্বের কাছে প্রথম তুলে ধরেন। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মাইহার ঘরানার স্রষ্টা আচার্য আলাউদ্দীন খান সাহেবের শিষ্য ছিলেন রবি শংকর। তাঁর সঙ্গীত জীবনের পরিব্যাপ্তি ছয় দশক জুড়ে। রবি শংকর দীর্ঘতম আন্তর্জাতিক সঙ্গীতকর্ম জীবনের জন্য গিনেস রেকর্ডের অধিকারী।
তাঁর বাবা শ্যাম শংকর। তিনি ছিলেন একজন প্রথিতযশা জ্ঞানী, রাজনীতিবিদ এবং আইনজ্ঞ। মা হেমাঙ্গিনী। রবি শংকর ছিলেন চার ভাইয়ের মধ্যে সবচেয়ে ছোট। বড় ভাই উদয় শংকর ছিলেন বিখ্যাত ভারতীয় শাস্ত্রীয় নৃত্যশিল্পী। ওই সময়ে তাঁর বড় ভাই উদয় শংকর ছিলেন প্যারিসে। ১৯৩০ সালে রবি শংকর মায়ের সাথে প্যারিসে বড় ভাইয়ের কাছে যান এবং সেখানেই আট বছর স্কুলে লেখাপড়া করেন। বারো বছর বয়স থেকেই রবি শংকর বড় ভাইয়ের নাচের দলের একক নৃত্যশিল্পী ও সেতার বাদক। ওই বয়স থেকেই তিনি অনুষ্ঠান করে বেড়িয়েছেন ভারত ও ইউরোপের বিভিন্ন শহরে।
১৯৩৮ সালে, আঠারো বছর বয়সে রবি শংকর তাঁর বড় ভাই উদয় শংকরের নাচের দল ছেড়ে মাইহারে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অমর শিল্পী আচার্য আলাউদ্দীন খাঁ সাহেবের কাছে সেতার বাদনের দীক্ষা নেন। দীক্ষা গ্রহণকালে তিনি আচার্যের পুত্র সরোদের অমর শিল্পী ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ’র সংস্পর্শে আসেন। তাঁরা পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানে সেতার-সরোদের যুগলবন্দী বাজিয়ে শোনান।
১৯৩৮ হতে ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত। গুরুগৃহে রবি শংকর দীর্ঘ সাত বছর সেতারে সঙ্গীত শেখেন। ১৯৩৯ সালে ভারতের আহমেদাবাদ শহরে রবি শংকরের সর্বপ্রথম সাধারণের জন্য উন্মুক্ত একক সেতার পরিবেশন করেন। সেই শুরু থেকে আজ পর্যন্ত পন্ডিত রবি শংকর সঙ্গীতজ্ঞ, সঙ্গীত স্রষ্টা, পারফর্মার এবং ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের একজন পন্ডিত হিসেবে পরিচয় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
তিনি সুর সৃষ্টি, ব্যালের জন্য সঙ্গীত রচনা এবং চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা করেন। এই সময়ের বিখ্যাত ধরতি কি লাল এবং নীচা নগর চলচ্চিত্র দুটির সঙ্গীত রচনা ও সুরারোপ করেন। তিনি কবি ইকবালের সারে জাঁহাসে আচ্ছা কবিতাকে অমর সুরে সুরারোপিত করে জনপ্রিয় গান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
১৯৪৯ সালে রবি শংকর দিল্লীতে অল ইন্ডিয়া রেডিওর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে যোগ দেন। ওই সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বৈদ্যবৃন্দ চেম্বার অর্কেস্ট্রা। ১৯৫০ হতে ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত রবি শংকর অত্যন্ত নিবিড়ভাবে সঙ্গীত সৃষ্টিতে ব্যাপৃত ছিলেন। এ সময়ে তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো সত্যজিৎ রায়ের অপু ত্রয়ী (পথের পাঁচালী, অপরাজিত ও অপুর সংসার) চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনা। পরবর্তীতে তিনি চাপাকোয়া (১৯৬৬) চার্লি (১৯৬৮) ও গান্ধী (১৯৮২)সহ আরো চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালনাও করেছেন। ১৯৬২ সালে পন্ডিত রবি শংকর কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, বম্বে এবং ১৯৬৭ সালে কিন্নর স্কুল অব মিউজিক, লস এন্জেলেস স্থাপন করেন।
রবি শংকরের সঙ্গীত ব্যক্তিত্বের দুটি ভিন্ন দিক হলো, উচ্চাঙ্গ সেতার শিল্পী হিসেবে তিনি সব সময়ই ঐতিহ্যমুখী ও শুদ্ধতাবাদী; কিন্তু সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে তিনি সব সময়ই নিজের সীমাকে ছাড়িয়ে যেতে চেয়েছেন। ১৯৬৬ সালে বিটলস্-এর জর্জ হ্যারিসনের সাথে যোগাযোগের আগে থেকেই তিনি সঙ্গীতের বিভিন্ন ধারা ও তার প্রভাব নিয়ে কাজ করেছেন। এ সময় তিনি জ্যাজ সঙ্গীত, পাশ্চাত্য শাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও লোকসঙ্গীত নিয়ে কাজ করেছেন।
১৯৫৪ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে রবি শংকর ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বাহক হিসেবে তাঁর সেতারবাদনকে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে প্রথম তুলে ধরেন। ১৯৫৬ সালে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকায় সঙ্গীত পরিবেশন করেন। এ সময় তিনি এডিনবার্গ ফেস্টিভালে এবং বিখ্যাত সঙ্গীত মঞ্চ রয়াল ফেস্টিভাল হলেও বাজিয়েছেন।
১৯৬৫ সালে বিটলস্-এর জর্জ হ্যারিসন সেতারের সুর নিয়ে গবেষণা শুরু করলে রবি শংকরের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ তৈরী হয়। পরে দুজনে বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাঁদের এই বন্ধুত্ব রবি শংকরকে অতিদ্রুত আন্তর্জাতিক সঙ্গীত পরিমন্ডলে নিজস্ব অবস্থান সৃষ্টিতে সাহায্য করে। রবি শংকর পপ সঙ্গীতের গুরু জর্জ হ্যারিসনের ‘মেন্টর’ হিসেবে পাশ্চাত্য সঙ্গীত জগতে গৃহীত হন। এর ফলে রবি শংকরকে এমন সব সঙ্গীত উৎসবে সঙ্গীত পরিবেশনের আমন্ত্রণ জানানো হয় যা শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশনের উপযোগী পরিবেশ নয়।
এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘মন্টেরি পপ ফেস্টিভ্যাল’, মন্টেরি, ক্যালিফোর্নিয়া। এ অনুষ্ঠানে ওস্তাদ আল্লারাখা তবলা বাজিয়েছিলেন। ১৯৬৭ সালে তাঁর আমেরিকার অনুষ্ঠানমালা তাঁকে এক অভাবনীয় সফলতা এনে দিয়েছিল। অনুষ্ঠানের পর তাঁকে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেবার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। এছাড়াও ১৯৬৯ সালে তিনি উডস্টক ফেস্টিভ্যালে সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন।
যুদ্ধ কবলিত বাংলাদেশকে রক্ষায় ১৯৭১ সালে ১ আগস্ট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক শহরের মেডিসন স্কয়ারে আয়োজিত হয় ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ পণ্ডিত রবি শংকরের অনুরোধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন জর্জ হ্যারিসন। ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিট জেনারেশনের সৃষ্টিকারী বিটলস-এর জর্জ হ্যারিসন। কিংবদন্তী এই কনসার্ট থেকে সংগৃহীত আড়াই লক্ষ ডলার বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জীবন বাঁচানোর জন্য দেয়া হয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে, দেশে চলমান জেনোসাইডের প্রতিবাদে সেই সময়ের সারা বিশ্ব কাপানো সংগীত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন এই কনসার্টে। মুলত শরনার্থীদের আর্থিক সহযোগিতা এবং স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের সাহায্যার্থে এই কনসার্টের উদ্যোগ নিয়েছিলেন সেতার সম্রাট রবিশংকর। সেই উদ্যোগ শুধু আর্থিক সহযোগিতায় সীমাবদ্ধ থাকে নি। বরং বাংলাদেশের অস্তিত্বের কথা, চলমান গণহত্যার কথা, লক্ষ লক্ষ দেশান্তরী শরণার্থীর কথা সারা বিশ্বকে জানিয়ে দিয়েছিল ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ।’ রেখেছিল পাকিস্তানের হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে এবং বিশ্ব জনমত গঠনে ভূমিকা। সে সময় আমেরিকান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও দেশটির জনমত ছিল বাংলাদেশের পক্ষে। জাতিসংঘের ইউনিসেফ জর্জ হ্যারিসনের সেই অবদানের স্মরণে একটি বিশেষ ফান্ড তৈরি করে নাম রেখেছে ‘দ্য জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সপক্ষে প্রচার ও মানবিক সহায়তার জন্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে আয়োজিত ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ সেতার বাজিয়েছিলেন পন্ডিত রবি শংকর। মূলত তিনি এই অনুষ্ঠানের জন্য জর্জ হ্যারিসনকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এই বিস্ময়ের নির্মাতা পন্ডিত রবি শংকর। বন্ধু আমাদের। আমরা ভুলি নি তাঁকে। ভুলবো না কখনো ❐