
ভাস্কর্য ও মূর্তি বিতর্ক সাংস্কৃতিক দৈন্যতারই বহিঃপ্রকাশ
শিতাংশু গুহ
জাস্টিশিয়া যেদিন সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে পেছনে গেছেন, বাংলাদেশ সেদিন আপস করেছিল, ধর্মীয় সুড়সুড়ি দিয়ে মৌলবাদকে আস্কারা দিয়েছিল। লালন শাহ’র ভাস্কর্য যখন ভাঙা হয়েছিল, তখনও দেশমাতৃকা কিছু বলে নি। যখন হিন্দুদের দেবীমূর্তি ভাঙছে, জন্মভূমি তখনও চুপ থাকতে পছন্দ করছে। এখন ওঁরা যখন বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ভাঙতে উদ্যত, দেশ তখন কথা বলার চেষ্টা করছে। তবে সুর বড়ই নরম। দু চারজন বাদে সবাই মিনমিন করছেন। বলার চেষ্টা করছেন, ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। সোজা বাংলায় এর অর্থ, ভাস্কর্য ভাঙা যাবে না, মূর্তি ভাঙলে ক্ষতি নাই? শেষ পর্যন্ত আপসটা কি এভাবে হবে? ৬০টি সংগঠন ভাস্কর্য ভাঙার প্রতিবাদে মাঠে নেমেছেন। কঠিন হলেও প্রশ্নটি যথার্থ, দেশে মূর্তি ভাঙছে, আপনাদের দেখা মেলেনা কেন?
মূর্তি হোক বা ভাস্কর্য হোক কোনটাই ভাঙা যাবে না, একথা বলতে কি লজ্জা লাগে, নাকি ভয়? কেন বলেন না, দেশে ভাস্কর্য থাকবে, মূর্তি থাকবে, রবীন্দ্রসংস্কৃতি থাকবে, গজল থাকবে, জারিসারি পালা গান থাকবে, নাটক, সিনেমা, ফেইসবুক, ইউটিউব থাকবে, নামাজ, ওয়াজ, পূজা, পহেলা বৈশাখ, মন্দির, মসজিদ, প্যাগোডা, চার্চ সবই থাকবে। পছন্দ হয়? পছন্দ হলে দেশে থাকুন, না হলে ‘পছন্দসই’ কোনও দেশে গিয়ে থাকুন। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে বাংলাদেশের জন্ম সে দেশে ফতোয়া চলবে না। ফতোয়ায় দেশ স্বাধীন হয় নি, হয়েছে বঙ্গবন্ধুর ডাকে। যে গোষ্ঠী ভাস্কর্য ভাঙার ডাক দেন, একাত্তরে এদের পূর্বসূরিরা ছিলেন স্বাধীনতাবিরোধী, রাজাকার। অর্ধ-শতাব্দী পরও এঁরা রাজাকারই আছেন। এ এক আজব দেশ, এখানে মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হয়, রাজাকার মানুষ হয় না!
এখন যাঁরা ভাস্কর্য ভাঙতে উদ্যত, একদা এঁরা কবি নজরুলকে কাফের বলেছিল, বেগম রোকেয়াকে গালাগাল করেছিল, আরজ আলী মাতুব্বর বেঁচে থাকলে হয়ত তাঁকে ‘লালমনিরহাটের’ ঘটনার মতো আগুনে পুড়িয়ে মারত। কেউ কি বলতে পারেন, এই গোষ্ঠী বাংলাদেশের পঞ্চাশ বছরের ইতিহাসে কোনও ভালো কাজটা করেছেন? ধ্বংস ছাড়া এঁরা কি কিছু গড়েছেন? ভাঙা সোজা, গড়া কঠিন। উন্মাদের উন্মত্ততা কোনও কিছু ভাঙার জন্যে যথেষ্ট। গড়ার জন্যে চাই, সাধনা।
এক সময় এঁরা ইংরেজি শিক্ষাকে ‘হারাম’ বলেছিল। টেলিভিশনকে ‘শয়তানের বাক্স’ বলত। তবে এবার মনে হয় এঁরা একটু ভুল করে ফেলেছে, বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলেছে। ‘চৈত্র মাসের ওয়াজ মাঘ মাসে করে ফেলেছে। তাই হয়তো গেল ৪ ডিসেম্বর পুলিশ এদের লাঠিপেটা করেছে।
লন্ডনের হারাধন ভৌমিক ভাস্কর্য নিয়ে একটি কবিতা লিখেছেন, ‘এ নয় মৃত্তিকা, নহে পাথর,/ নহে সামান্য কোনো সৃষ্টি/ এ যে মোদের মাটি মানুষের/ সংস্কৃতি, সভ্যতা আর কৃষ্টি।’
যারা ভাস্কর্য এবং মূর্তি পার্থক্য নির্ণয়ে ব্যস্ত, তাঁরা প্রকারান্তরে মূর্তি ভাঙাকে উসকে দিচ্ছেন। ভাস্কর্য যেমন মূর্তি হতে পারে, তেমনি মূর্তিও ভাস্কর্য হতে পারে। সুবিখ্যাত ‘নটরাজ’ ভাস্কর্য হিসাবে স্বীকৃত, সুইটজারল্যান্ডের বিশ্বখ্যাত ল্যাবরেটরির সামনে ‘নটরাজ’ একটি ভাস্কর্য; কিন্তু ‘নটরাজ’ যখন শিব হিসাবে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বাড়িতে পূজিত হন, তখন তিনি দেবমূর্তি। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে মাটি খুঁড়ে বা পুকুরের নীচে বহু মূল্যবান দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়, সেগুলো ভাস্কর্য হিসাবে মিউজিয়ামে রক্ষিত থাকে, মন্দিরকে তা ফেরত দিলে ব্রাহ্মণ তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলে, তিনি মূর্তি হয়ে যান।
কথাটা এভাবে বলা যায়, ‘সকল মূর্তিই ভাস্কর্য, কিন্তু সকল ভাস্কর্য মূর্তি নয়।’ মহামতি বুদ্ধ অনেকের বাড়ীতে ভাস্কর্য হিসাবে সাজানো থাকে, বৌদ্ধদের কাছে বা বৌদ্ধ বিহারে তিনি বুদ্ধমূর্তি হিসাবে পূজিত হন। ভাস্কর্য ও মূর্তি বিতর্ক আমাদের সাংস্কৃতিক দৈন্যতার বহিঃপ্রকাশ।
মৌলবাদীরা ৪ঠা ডিসেম্বর ভাস্কর্যবিরোধী যে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল, সেটি ছিল ‘ভাস্কর্যের নামে দেশব্যাপী মূর্তি স্থাপনের প্রতিবাদে’ বিক্ষোভ (কালের কণ্ঠ)। এ থেকে পরিষ্কার যে এদের কাছে ভাস্কর্য ও মূর্তির অর্থ একই। অথচ এই সহজ বিষয়টি প্রগতিশীলদের মাথায় ঢোকে না? বিষয়টি তা নয়, এঁরা জ্ঞানপাপী, এটি ‘ভাস্কর্য ও মূর্তি’ বিতর্ক, আপসের নতুন ফর্মুলা। অক্সফোর্ড বাংলা ডিকশনারির নতুন সংস্করণে ভাস্কর্য ও মূর্তিকে অভিন্ন বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, মূর্তিই হোক, বা ভাস্কর্য হোক, সমস্যা কি? মূর্তি বা ভাস্কর্য তো মানুষ মারে না, রাজাকাররা মারে, একাত্তরে মেরেছে, আবার সুযোগ পেলে মারবে। এ সময়ে মহামারী করোনা ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব যখন ‘ভ্যাকসিন’ আবিষ্কার, উৎপাদন ও বন্টন নিয়ে ব্যস্ত, আমরা তখন কবি নজরুলের ভাষায়, ‘ফতোয়া খুঁজছি ফিকাহ ও হাদিস চষে’ – ভাস্কর্য হালাল না হারাম?
সমস্যা তো বোঝা গেল, সমাধান কি? আগে শ্লোগান ছিল, ‘আপস না সংগ্রাম; সংগ্রাম, সংগ্রাম।’ কৌতুকাভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি বিখ্যাত সংলাপ, ‘দুনিয়ার নিয়ম বিস্তর পাল্টাইছে…।’ পুরনো শ্লোগান পাল্টে এখন হয়েছে, ‘আপস, আপস।’ ভাস্কর্য প্রশ্নেও আপস হবে, উভয় পক্ষ উপলদ্ধি করছেন, ‘আপসই একমাত্র সমাধান।’
আমাদের দেশে বাম আন্দোলন ব্যর্থ হবার একটি অন্যতম কারণ হচ্ছে, কমিউনিস্টরা ইসলামের সাথে আপস করে মরেছে। ঠিক একইভাবে প্রগতিশীলরা দীর্ঘদিন মৌলবাদের সাথে আপস করতে করতে নিজেদের ভরাডুবি ডেকে আনছে। এ সময়ে দেশে সৈয়দ আশরাফের মতো রাজনীতিবিদের অভাব বেশ অনুভূত হচ্ছে। মানুষ অযথা ঝামেলা চায় না, শান্তি চায়, তাই ভাস্কর্য নিয়ে এই গোঁজামিলের একটা সুরাহা হবে, হবেই, মধ্যখান থেকে বাঁশ যাবে মূর্তির, বা হিন্দু ও বৌদ্ধের।❐
নিউ ইয়র্ক থেকে