আঞ্চলিকবাংলাদেশ

সিলেট এমসি কলেজে গণধর্ষণ: ৮ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

আগে বাসায় নিয়ে ধর্ষণ করে দুজন, ৬ জন সরাসরি অংশ নেয়,

সিলেট এমসি কলেজ হোস্টেলে স্বামীকে বেঁধে রেখে গৃহবধূকে গণধর্ষণের ঘটনায় ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমানকে প্রধান আসামি করে আটজনের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দাখিল করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।

বৃহস্পতিবার আমলি আদালতে পৃথক দুটি চার্জশিট দাখিল করা হয়। চার্জশিট অনুযায়ী ধর্ষণে ছয়জন সরাসরি অংশ নেয়।

এছাড়া ধর্ষণে সহযোগী দুইজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়, কলেজ হোস্টেলে ধর্ষণের আগে একটি বাসায় নিয়ে ওই গৃহবধূকে মিসবাউল ইসলাম রাজন ও বহিরাগত মো. আইনুদ্দিন আইনুল ধর্ষণ করে।

বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (দক্ষিণ) মো. সুহেল রেজা জানান, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি চার্জশিট এবং প্যানেল কোড অনুযায়ী আরেকটি চার্জশিট দাখিল করা হয়। তাদের অভিযোগপত্র অনুযায়ী ধর্ষণের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত আসামিরা হলো: ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মিসবাউল ইসলাম রাজন ও বহিরাগত মো. আইনুদ্দিন। এছাড়া ধর্ষণে সহযোগী হিসেবে ছাত্রলীগ কর্মী রবিউল হাসান ও মাহফুজুর রহমান মাসুমকে চার্জশিটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আটজনের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অপরাধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

চার্জশিটে বলা হয়, হোস্টেলে গণধর্ষণের আগে গৃহবধূকে টিলাগড় এলাকার রাজপাড়া আবাসিক এলাকার ১নং রোডের ২১নং বাসায় কৌশলে ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে রাজন ও আইনুল। সেখান থেকে বের হয়ে রাজন ও আইনুল মোবাইল ফোনে মেয়েটির অবস্থান সাইফুরসহ অন্যদের জানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে এমসি কলেজ গেটে গৃহবধূর গাড়ির গতিরোধ করে সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, অর্জুন লস্কর, মাহফুজুর রহমান মাসুম ও রবিউল হাসান। এরপর তার স্বামীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে তারা ৫০ হাজার টাকা চাঁদা দাবী করে। টাকা দিতে অস্বীকৃত জানালে সাইফুর, অর্জুন, তারেক ও রনি গাড়িতে তাদের তুলে নেয়। গাড়ি চালায় তারেক। মাসুম ও রবিউল মোটরসাইকেল নিয়ে গাড়িকে অনুসরণ করে। হোস্টেলের ৭নং ব্লকের ৫ম তলার নীচে নিয়ে আসে। সেখানে স্বামীকে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিয়ে যায় মাসুম ও রবিউল। ভবনের একদিকে নিয়ে তাকে তারা মারধর করে। এ সময় গাড়িতে গৃহবধূর ওপর প্রথমে পাশবিক নির্যাতন চালায় সাইফুর। এরপর তারেক, রনি ও অর্জুন পাশবিক নির্যাতন চালায়। গাড়িটি রেখে ভয় দেখিয়ে হোস্টেল থেকে তাদের বের করে দেয়।

চার্জশিটে আরও বলা হয়, পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে বাদীর গাড়িটি হোস্টেলের ভেতর দেখতে পায়। ভবনের দোতলার প্রত্যক্ষদর্শী ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করে ধর্ষণকারীদের নাম জানতে পারে পুলিশ। এছাড়া হোস্টেলের অন্য ছাত্রদের ছবি দেখিয়ে আসামিদের চিহ্নিত করে বলে চার্জশিট উল্লেখ করা হয়।

উল্লেখ্য, ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের শিকার হন গৃহবধূ। এরপর পুলিশ নির্যাতিতা নারীকে উদ্ধার করে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করলে ওসিসিতে তিনদিন চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরে যান তিনি। ওই রাতেই ধর্ষণের শিকার গৃহবধূর স্বামী বাদী হয়ে মহানগরের শাহপরাণ থানায় আওয়ামী লীগ নেতা রঞ্জিত সরকারের অনুসারী ৬ ছাত্রলীগ নেতার বিরুদ্ধে মামলা করেন। এ ঘটনার পর সিলেটসহ সারা দেশে তোলপাড় শুরু হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আসামিদের ধরতে বিভিন্ন স্থানে অভিযানে চালায়। র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব-৯) ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকায় চারজনকে গ্রেফতার করে। এছাড়া সিলেট জেলা পুলিশ দুইজনকে, সুনামগগঞ্জ ও হবিগঞ্জ পুলিশ দুইজনকে গ্রেফতার করে।

গ্রেফতারের পর আট আসামিকে পর্যায়ক্রমে পাঁচদিন করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। রিমান্ড শেষে আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তারা। জবানবন্দিতে প্রধান আসামি সাইফুর, তারেক, রনি ও অর্জুন ধর্ষণের কথা স্বীকার করেন। রবিউল ও মাহফুজুর ধর্ষণে সহায়তা করার কথা স্বীকার করেন। সন্দেহভাজন আসামি মিসবাউর রাজন ও আইনুলও জবানবন্দি দেন। এছাড়া ২৯ নভেম্বর আসামিদের ডিএনএ প্রতিবেদন হাতে পান তদন্ত কর্মকর্তা। ৪৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি, ঘটনাস্থলে পাওয়া আলামত, আসামিদের জবানবন্দি বিচারবিশ্লেষণ করে ঘটনার ৯৮ দিনের মাথায় বৃহস্পতিবার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য।

দুপুরে উপকমিশনার কার্যালয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকদের জানান এসএমপির দক্ষিণ বিভাগের উপকমিশনার মো. সোহেল রেজা। এ সময় এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আসামরা যাতে সর্বোচ্চ শাস্তি পায়, সেই দিকেই নজর ছিল তাদের। তারা প্রত্যাশা করেন চার্জশিটে কোনও ত্রুটি নেই।

এ সময় তিনি জানান, তদন্তকালে তারা ৪৯ জন সাক্ষীর জবানবন্দি নিয়েছেন। প্রতক্ষদর্শী এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী রয়েছে, যা আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণের সময় উপস্থাপন করবেন। এ সময় তিনি জানান, দুইটি অভিযোগপত্র ধর্ষণ ও অন্যসব অপরাধে আট আসামির বিরুদ্ধে। অন্যটি সাইফুরের কক্ষ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় ২ আসামির বিরুদ্ধে।

সোহেল রেজা বলেন, তদন্তে তারা পুলিশের কোনও গাফিলতি খুঁজে পান নি। তবে হোস্টেলে ঢোকার অনুমতি পেতে দেরী হয়েছে বলে তিনি স্বীকার করেন। এছাড়া আসামিদের সঙ্গে ভিকটিমের সমঝোতার বিষয়ে পুলিশের ভূমিকার কথাও অস্বীকার করেন তিনি।

এ মামলার ৮ আসামির কাউকেই এসএমপি ধরতে না পারা ব্যর্থতা কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, মূলত আসামি ধরাই ছিল তাদের লক্ষ্য। সব আসামির অবস্থান নাকি তারাই নিশ্চিত করেছেন। পরে সিলেট রেঞ্জের ডিআইজি ও র‌্যাব-৯ এর পরিচালককে অনুরোধ করেছেন এসব আসামিকে ধরে দিতে। এরপরই তাদের দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে আসামিদের গ্রেফতার করা হয়েছে বলে তিনি দাবী করেন।❐

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension