মুক্তমত

‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া’

‘‘আবার ফুটেছে দ্যাখো কৃষ্ণচূড়া থরে থরে শহরের পথে/কেমন নিবিড় হয়ে। কখনো মিছিলে কখনো-বা/একা হেঁটে যেতে যেতে মনে হয়- ফুল নয়, ওরা/শহীদের ঝলকিত রক্তের বুদ্বুদ, স্মৃতিগন্ধে ভরপুর।’’
 
একুশের কৃষ্ণচূড়া আমাদের চেতনার রঙ। অমর একুশের চেতনায় রচিত কবি শামসুর রাহমানের এই কবিতাটি এখন নগরবাসী অনেকেরই স্মৃতিতে ভেসে ওঠে। কেননা শহরজুড়ে আবার ফুটেছে কৃষ্ণচূড়া।
 
রাজধানীর রমনা, বিজয়নগর, নাটক সরণি (বেইলিরোড), হাইকোর্ট প্রাঙ্গণ, মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, মিন্টো রোড, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর, গুলশান, হাতিরঝিল, বনানী, বারিধারা, উত্তরাসহ শহরের বিভিন্ন স্থানে এখন কৃষ্ণচূড়ার লাল আগুন চোখে পড়ে।
 
কৃষ্ণচূড়ার এই মায়াবী আহ্বান পথচারী সব বয়সের মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করে। কেননা- দুঃখ, যন্ত্রণা, বঞ্চনা, হতাশা ও সংশয়ে ভরা আমাদের যাপিত জীবনে ফুল ও বৃক্ষ আনন্দ আর প্রেমের এক অফুরান উৎস।
 
 
ফুল— আনন্দ, ঐশ্বর্য, প্রেম, সৌন্দর্য ও সংগ্রামের প্রতীক। লিলির হলুদ পরাগ কৌমার্যের, পদ্ম সৃষ্টি ও স্থিতির, সাদা ফুল পবিত্রতার, নীল আনুগত্যের, গোলাপ প্রেমের, ডেইজি সূর্যের, ঘাস প্রয়োজন এবং প্রাচুর্যের, পপি বিস্মৃতির, ঘৃতকুমারী দুঃখ ও বেদনার, আইভি স্বৈর্যের আর দোপাটি অস্থিরতা এবং কৃষ্ণচূড়া সংগ্রামের প্রতীক। তবে স্থান এবং কালভেদে এসব প্রতীকের অর্থ এক থাকেনি। যেমন- গোলাপ দূরপ্রাচ্যে সদগুণ, মিশরে নৈঃশব্দ, রোমে উচ্ছলতা এবং আমাদের দেশসহ অন্যান্য বহুদেশে প্রেম ও সৌন্দর্যের প্রতীক।
 
কৃষ্ণচূড়া— এ দেশে সুপরিচিত এবং ঢাকার প্রধানতম ফুলের গাছ। গ্রীষ্মের খরার্দীন আকাশের নিচে প্রচণ্ড তাপ ও রুক্ষতায় এর আশ্চর্য প্রস্ফুটনের তুলনা নেই। পাতাহীন শাখায় প্রথমে কুঁড়ি ধরার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সারা গাছ ফুলে ফুলে ভরে যায়। এত উজ্জ্বল রং, এত অক্লান্ত প্রস্ফুটন তরুরাজ্যে দুর্লভ। কৃষ্ণচূড়া ফুলের বর্ণ-বৈচিত্র লক্ষণীয়। গাঢ় লাল, লাল, কমলা, হলুদ এবং হালকা হলুদের এক দীর্ঘ বর্ণালীতে বিস্তৃত এর পাপড়ির রং। প্রথম ফোটার উচ্ছ্বাস আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসলেও বর্ষার শেষ পর্যন্ত কৃষ্ণচূড়ার গাছ থেকে ফুলের রেশ হারিয়ে যায় না।
 
 
শুধু ফুল নয়— পাতার ঐশ্বর্যেও কৃষ্ণচূড়া অনন্য। এই পাতার সবুজ রং এবং সুক্ষ্ণ আকৃতি অতিশয় আকর্ষণীয়। গ্রীষ্মের খেয়ালি হাওয়ায় নম্র, নমনীয় পাতাদের নৃত্য বড়ই দৃষ্টি শোভন। এই গাছে ছায়ার নিবিড়তা নেই তবুও এর লঘু আস্তরণ রৌদ্রশাসনে সক্ষম। কৃষ্ণচূড়ার কচি ফলেরা পাতার মতোই সবুজ- তাই পাতার ভিড়ে সহজে তাদের দেখা যায় না।
 
বড়ই পলাতক জীবনের তাদের। শীতের হাওয়ায় পাতা ঝরে গেলেই ফল চোখে পড়ে। পাকা ফল গাঢ় ধূসর। পাতাহীন কৃষ্ণচূড়ার শাখায় তখন ফল ছাড়া আর কিছুই থাকে না। বসন্তে আবার কৃষ্ণচূড়ার দিন ফেরে। একে একে ফিরে আসে পাতার সবুজ, প্রস্ফুটনের বহুবর্ণের দীপ্তি নিঃশব্দে ঝরে পরে বির্বণ ফলেরা। কৃষ্ণচূড়া ফিরে পায় তার দৃষ্টি নন্দন শোভা।
 
কৃষ্ণচূড়া আমাদের দেশে সহজপ্রাপ্য হলেও এর আদিনিবাস মাদাগাস্কারে। ১৮২৪ সালে সেখান থেকে প্রথমে মৌরিসাস পরে ইংল্যান্ড এবং শেষে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় এর বিস্তার ঘটে। গাছটিকে অনেকে রক্তচোর বলার পক্ষপাতী। কৃষ্ণচূড়া ছাড়াও গ্রীষ্মকালে ফোটে পলাশ, জারুলসহ নানা ধরনের ফুল। তবে এগুলো ঢাকা শহরে খুব একটা দেখা যায় না। যদিও ফুল ও বৃক্ষের নমনীয় প্রকৃতির প্রগাঢ় ছায়ায় আমাদের অভ্যাস, আমাদের চেতনা লালিত। গ্রীষ্মের উজ্জ্বল রোদ, বর্ষার অশ্রান্ত বারিধারা, শরতের নরম নীল আকাশ, হেমন্তের হলুদ আলো, শীতের রিক্ত মাঠ, বসন্তের উদ্ভিন্ন মুকুলের কলরব আমাদের মানস বৈশিষ্ট্যের অখণ্ড অনুষঙ্গ।
 
জীবনন্দনতত্ত্বের অজস্র আকর্ষণীয় উপদানে সমৃদ্ধ আমাদের দেশ। শাল-দেবদারুর রাজসিক সৌষ্ঠব, সেগুন-তেতুল-তালের বলিষ্ঠ গ্রথন, বিলাতি ঝাউয়ের মর্মর, নাগকেশর-ছাতিমের উদভ্রান্ত সুগন্ধি, কৃষ্ণচূড়া পলাশ শিমুলের উচ্ছল বর্ণচ্ছটা, পদ্ম শাপলার ললিত লাবণ্য, বটের দীর্ঘ শীতল ছায়া আমাদের নির্সগ-শিল্পীদের বড় প্রিয়।
 
 
এসব নিয়ে রচিত হয়েছে অনেক সাহিত্য। কেবল কালিদাসের কাব্যেই উল্লেখ আছে অর্ধশতাধিক গাছের নাম। ঐতিহ্যের এই ধারা অব্যাহত রয়েছে আমাদের বৈষ্ণবকাব্যে, লোকগীতিকায় এবং রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ, জসীম উদদীনের কাব্য কল্পনায়। প্রাচীন গ্রিস, ভারত, চীন, জাপান, পারস্য, মিশরের মন্দির, গুহা ও মনুমেন্টের খোদাই ও চিত্র থেকে শুরু করে বিশ্বসাহিত্যের বিপুল পরিসরে এই উপকরণসমূহ বিক্ষিপ্ত।
 
একসময় সুগন্ধী ফুলের মালা, চুলে তিলপাতা, কানে রিটা ফুল, হাতে পদ্মডাটার বালা ছিল প্রাচীন বাঙালির নারীর প্রিয় ভূষণ।
বর্তমানে অবশ্য এসবের ততটা সমাদর নেই। যান্ত্রিক রুচির প্রতিফলন আমাদের জীবনধারার প্রায় সবক্ষেত্রেই লক্ষণীয়। শহরের আকাশচুম্বী প্রাসাদ, উজ্জ্বল রং, কর্কশশব্দ, মানুষের ভিড়, কৃত্রিম আলো ইত্যাদি ভালো-মন্দের ভিড়ে স্বাচ্ছন্দ্য ও হতাশায় দোদুল্যমান আজ শহরের প্রকৃতিক পরিবেশ। তাই শহরের স্বাভাবিক জীবন দুঃসহ। তবু এ শহরে রমনার সবুজে আবৃত রূপের মাঝে গ্রাম বাংলার একান্ত স্পর্শ খুঁজে পাওয়ায় যায়। এখানে প্রকৃতিই মুখ্য- শহর গৌণ।
 
গ্রীষ্মের দীর্ঘ দুপুরে অশোকের প্রসারিত শীতল ছায়া, কাঠবিড়ালীর একাকী ব্যস্ত জীবন, তৃণপত্রে নির্ঝরিত শরৎ রাতের শিশিরের শব্দ, হেমন্তের গোধূলী আলোয় উজ্জ্বল তরুশীর্ষ, শীতের ঝরা পাতার ধূসর বিষণ্ণতা আর বাসন্তী প্রস্ফুটনের বর্ণাঢ্য উচ্ছ্বাস হঠাৎ মনে পড়া শৈশবের স্মৃতির মতোই আমাদের নাগরিক জীবনে স্বস্তির বাতাস বইয়ে দেয়। কেননা রমনার আকাশ এখনও অবারিত নীল। যদিও এখন দিনেরা অরণ্যের মতো নির্জন নয়- সকাল, দুপুর, বিকেল কিংবা সন্ধ্যায় মানুষের আনা-গোনার বিরাম নেই। তবুও রাত যখন গভীর হয়, সমস্ত উদ্যানজুড়ে যখন নামে গভীর নিরবতা, অবারিত স্তব্ধতা যখন চারপাশকে গ্রাস করে, তখন কৃত্রিম আলোয় রাতের পাতার রহস্যময় হয়ে ওঠে…
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension