কমলা হ্যারিসকে রানিংমেট করে জো বাইডেন তার পরাজয় নিশ্চিত করেছেন
ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী জো বাইডেন যেদিন ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি একজন মহিলাকে তার রানিংমেট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট হিসাবে মনোনীত করবেন, সেদিনই তিনি হেরে গেছেন। মঙ্গলবার ১১ আগষ্ট ২০২০ তিনি তার ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হিসাবে জ্যামাইকান-ইন্ডিয়ান কৃষ্ণাঙ্গ ক্যালিফোর্নিয়ার সিনেটের কমলা হ্যারিস’৫৫-কে মনোনয়নের কথা ঘোষণা করেছেন। আর এই ঘোষণার মধ্যে দিয়ে জো বাইডেন তার পরাজয় নিশ্চিত করেছেন।
বাইডেন ৭৭, জয়ী হলে তিনি ক্ষমতা নেবেন ৭৮ বছর বয়সে (জন্ম তারিখ ২০শে নভেম্বর ১৯৪২)। তার কিছু হয়ে গেলে কমলা হ্যারিস হবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। বাইডেনের স্বাস্থ্য খারাপ নয়, খুব ভালো তাও নয়! তাই দ্বিতীয় টার্মে তিনি নির্বাচন করবেন বা করতে পারবেন, সেটি অনেকটা অসম্ভব। সেক্ষেত্রে কমলা হ্যারিস হবেন ফেভারিট প্রার্থী। আমেরিকানরা কি একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে তাদের প্রেসিডেন্ট হিসাবে দেখতে চান? যদি না চান, তাহলে ট্রাম্প সহজ জয় পাবেন।
কমলা হ্যারিসকে স্বাগত জানিয়ে সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, আমেরিকার জন্যে একটি শুভ দিন। কমলা হ্যারিস যোগ্য, তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন নেই। সিনেটে তিনি বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। মনোনীত হবার পর তিনি বলেছেন, আমি কৃতজ্ঞ; জো বাইডেনকে ‘কমান্ডার ইন চীফ’ করার জন্যে সবকিছু করব। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, কমলা হ্যারিস প্রাথমিক নির্বাচনে মোটেও ভালো করেন নি এবং একজন বিচারপতি নিয়োগে যথেষ্ট হয়রানি করেছেন।
জো বাইডেন হয়ত যোগ্যতার কারণে কমলা হ্যারিসকে তার রানিং-মেট করেছেন। আল গোরও তাই করেছিলেন। তিনি যোগ্য প্রার্থী হিসাবে ইহুদী সিনেটর জো লিবারম্যানকে ভাইস-প্রেসিডেন্ট নিয়েছিলেন। তিনি হেরেছেন। ইহুদী বিদ্বেষী একটি গোষ্ঠী তাকে ভোট দেয় নি। কমলার গায়ে ভারতীয় ও হিন্দু গন্ধ আছে, এতে হয়ত ভোট কমবে। সব কমলা মিষ্টি নয়? ‘সুন্দরী কমলা নাচে’ গানটি বা নাচ অনেকের পছন্দ হলেও ‘কমলা’ নামে ভোট আসার কথা নয়!
বাইডেন কেন কমলা হ্যারিসকে নিলেন? কোনও কৃষ্ণাঙ্গ মহিলা এর আগে ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হন নি। বাইডেন কালো ভোট চাইছেন। প্রেসিডেন্ট রেসের শুরুতে কমলা হ্যারিস ছিলেন প্রতিদ্বন্দ্বী। তাকে নিয়ে বাইডেন জানান দিচ্ছেন, তিনি বিরুদ্ধবাদীদের সাথে কাজ করতে পারেন। আরও ইক্যুয়েশন হচ্ছে, ট্রাম্পের কাছে কমলা হ্যারিসের বিরুদ্ধে তেমন কিছু নেই। কমলা হ্যারিস হয়ত ভাইস-প্রেসিডেন্ট পেন্সের সাথে বিতর্কে ভালো করতে পারেন। বাইডেন জানান দিচ্ছেন, ‘হি ইজ ইন কন্ট্রোল।’
ভারত-আমেরিকা বা মোদী-ট্রাম্প সম্পর্ক সম্ভবত সর্বকালের চেয়ে চমৎকার। কমলা হ্যারিসকে প্রার্থী করে ডেমক্রেটরা হয়ত ভারত বা দক্ষিণ এশিয়াকে বার্তা দিতে চাইছে যে, তারা তাদের সাথে আছেন! ভারতীয় মার্কিনিরা এতে ধরা দেবেন বলে মনে হয় না। কমলা হ্যারিস কি হিন্দু? মা বিদুষী, মাদ্রাজের হিন্দু। বাবা সম্ভ্রান্ত জ্যামাইকান খৃষ্টান। স্বামী ইহুদী। কমলা হ্যারিস নিজেকে ‘কালো’ হিসাবে প্রজেক্ট করতে বেশী স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন, কারণ হয়ত রাজনৈতিক।
কমলা হ্যারিসের মা শ্যামলা গোপালন হ্যারিস উচ্চ শিক্ষিত, ক্যান্সার গবেষক ছিলেন। বিয়ে করেন ১৯৬৩ সালে, বিচ্ছেদ ১৯৭১। দুই মেয়েকে তিনি হিন্দুয়ানী শিখিয়েছেন। ভারতে নিয়ে গেছেন। কিন্তু কমলা হ্যারিস ভারতপন্থী হিসাবে পরিচিত নন, বরং কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা উঠিয়ে নেওয়ার বিপক্ষে। সিএএ বিরোধী। কখনও পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের জন্মভূমি’ বলেন নি। ইসলামী সন্ত্রাসকে শুধুই ‘সন্ত্রাস’ বলতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ক্যালিফর্নিয়ার ভারতীয়রা তাকে খুব একটা পছন্দ করেন বলে মনে হলো না।
কমলা হ্যারিসের পরিবার উচ্চ-শিক্ষিত। তিনি নিজে অ্যাটর্নি, তার ছোট বোন মায়া হ্যারিসও অ্যাটর্নি। কমলা ক্যালিফোর্নিয়ার হারভার্ড ইউনিভার্সিটির ল’ গ্র্যাজুয়েট। বিয়ে ২০১৪ সালে। স্বামী ডগলাস এমহফ। কমলার প্রথম বিয়ে, ডগলাসের দ্বিতীয় এবং দুই সন্তানের জনক। তিনি ক্যালিফোর্নিয়ার ফার্স্ট টার্ম জুনিয়র সিনেটর। জন্ম ২০ অক্টোবর ১৯৬৪। সানফ্রান্সিসকোর ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, পরে ক্যালিফোর্নিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল। ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন পেতে চেষ্টা করেছেন। সফল হন নি, নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান ৩ ডিসেম্বর ২০১৯।
বড় হয়েছেন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যাপ্টিস্ট চার্চ ও হিন্দু মন্দিরের পরিবেশে। ৭ বছর বয়সে পিতামাতার ডিভোর্স হয়, তার মা আর বিয়ে করেন নি, মেয়েদের নিয়ে থেকেছেন। মেয়েদের ওপর তাই মায়ের প্রভাব বেশী। কমলা হ্যারিস অ্যাটর্নি জেনারেল থাকাকালে কোনও খ্রিস্টান ধর্মগুরুর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানীর মামলা করেন নি। তার বোন মায়া হারভার্ড গ্র্যাজুয়েট। কমলা হ্যারিসের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে মায়া হ্যারিস ছিলেন চিফ ক্যাম্পেইন ম্যানেজার। হিলারি ক্লিনটনের নির্বাচনে তিনি ছিলেন পলিসি অ্যাডভাইজার।
সবই ঠিক আছে, কিন্তু এতে কি ভোট আসবে? কমলা হ্যারিস অতিরিক্ত কোথাকার ভোট আনবেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্যালিফোরনিয়া এমনিতে ডেমোক্রেট ঘাঁটি। কৃষ্ণাঙ্গরা সচরাচর ডেমোক্রেট। ইতোমধ্যে কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন, কালোরা তেমন উৎসাহিত হবে কেন? সামগ্রিকভাবে মাইনরিটি কম্যুনিটি তাকে ঠিক কতটা গ্রহণ করবেন? ভারতীয়রা তার পক্ষে থাকার তেমন কোনও কারণ নেই? অন্যদিকে ২০১৬ থেকে ট্রাম্পের ভোট কমে নি। বেড়েছে?
ভারতে ‘জয় শ্রীরাম’ শ্লোগানের মতো ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফাস্ট’ বা ‘মেক আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন’ শ্লোগান ভোটাররা গ্রহণ করেছেন। কোভিড-১৯ ইস্যু, দেড় লক্ষাধিক মৃত্যু নিয়ে ডেমক্রেটরা প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে ধরাশায়ী করতে চাইবেন। অর্থনীতির প্রশ্ন আসবে। তবে তেমন সুবিধা হবে না। ভোটাররা জানেন, ট্রাম্প ব্যবসা ভালো বোঝেন। অর্থনীতি ওঠানামা করছে বা তেমন খারাপ পর্যায়ে যায় নি। ছয়মাস সবকিছু বন্ধ থাকলে তা যেতে পারত, যায় নি, কৃতিত্ব ট্রাম্প নেবেন।
শুধু কালো বলে নয়, বরং ব্রিলিয়ান্ট, স্মার্ট, ভালো বক্তা হিসাবে ওবামা প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। কমলা হ্যারিস এসব গুণে গুণান্বিত। হয়ত বাইডেনের চেয়ে বেশী বা ওভারস্মার্ট, যা সমস্যা। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ইতোমধ্যে বলে ফেলেছেন, কমলা হ্যারিসের চাইতেও বাইডেন বোঝেন কম! কমলা হ্যারিস প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ ভাইস-প্রেসিডেন্ট প্রার্থী। এর আগে দুজন সাদা রিপাবলিকান সারা পলিন ও ডেমোক্রেট জেরাল্ডিন ফেরারো ভাইস প্রেসিডেন্ট মনোনয়ন পেয়েছিলেন, জয়ী হন নি। কমলার ভাগ্য কি খুলবে?
ইতোমধ্যে তার জন্ম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। কমলা হ্যারিস ক্যালিফোরনিয়ার অকল্যান্ডে জন্মছেন। একজন অধ্যাপক অ্যাটর্নি প্রশ্ন তুলেছেন, কমলার যখন জন্ম, তখন তার পিতা-মাতা দুজনে ছাত্র-ভিসায় আমেরিকা ছিলেন। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এটি লুফে নিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শুনেছি কমলা হ্যারিস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্যে যোগ্য নন, জানি না, ডেমোক্রেটদের বিষয়টি দেখা উচিত। মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট বা ভাইস-প্রেসিডেন্ট হতে জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হতে হয়। এ বিতর্ক হয়ত আরও চলবে। ওবামার নাগরিকত্ব নিয়ে দীর্ঘদিন বিতর্ক ছিল!❐