নদী কথা
নারদ নদী পুরো নাটোরটা শহর আর তার আশপাশের অনেক গ্রাম নিয়ে বিস্তৃত। নদীটির গ্রাম দিকের অংশে কখনও স্রোত দেখি নি। তবে শহর দিকের অংশে যখন সুগারমিলের ময়লা ছাড়ত, স্রোতের দেখা মিলত। তখন নদীর মাছেদের জীবনের এমন অবস্থা হতো!…
একবার চন্দ্রকলা হাইস্কুলের আনন্দ স্যার সেটার উদাহরণ দিয়ে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরের পৃথিবীর বর্ণনা দিয়েছিলেন। তবে
চিরস্থায়ী স্লুইসগেট দেয়ার আগে নাকি এই নদীতে স্রোত ছিল। পালতোলা নৌকাও যেত, বয়োজ্যেষ্ঠরা বলেন। গ্রামের দিকের নদীর পানি থাকে প্রায় পরিষ্কার। গ্রাম থেকে শহরে আসতাম। নারদেরই এক তীর থেকে আরেক তীরেই। মৃত তীর। জীবনের শুরুর দিকের আমার জীবনের সাথে মিশে থাকা নদীটির নাম ‘নারদ।’
জয়পুরহাটের আক্কেলপুর উপজেলায় আমার পরিচয় তুলসীগঙ্গা নদীর সাথে। নদীটির পাশ দিয়ে মানে বাধের ওপর দিয়ে মামা বাড়ি যাওয়ার রাস্তা। বর্ষায় নদীর পানি একদম রাস্তা ছুঁই ছুঁই। সে কি স্রোত! আবার শীতে যখন নদীর পানি একদম তলায় তখন নদীর পাড় ঘেষে দৃশ্যমান হতো বটগাছের লম্বা লম্বা পেঁচানো শেকড়। ওই অঞ্চলের মাটির রঙ লাল।
তুলসীগঙ্গা দেখতে ছোটখাটো একটা দৈত্য প্রকৃতির নদী। প্রায়ই এই নদীতে মরা মানুষ ভেসে আসত। জীবনের প্রথম শ্যালো নৌকায় চড়েছিলাম এই নদীতেই। প্রথমে এত বড় নদী দেখে তুলসীগঙ্গায় তীর বেয়ে চোরাবালির ভয়ে ভয়েও হেঁটেছিলাম। নাম নাজানা একটা ছোট শাখা নদী এসে তুলসীগঙ্গায় এসে মিলেছিল।
মোহনার একটু আগে সেই ছোট নদীর ওপারে একটা স্কুলে আমার মা পড়াতেন। স্কুল শেষে স্কুলের বাচ্চারাই নৌকায় করে নদী পারাপার করে দিয়ে যেত। আমার মা শরৎচন্দ্রের নতুনদার মতো নৌকায় বসে নদী পার হতেন। মা বাড়ি ফিরে সে আনন্দের গল্প বলতেন। আক্কেলপুরের পারঘাটি থেকে স্রোতের দিকে নৌকা ভাসাতে আমার এখন খুব ইচ্ছে জাগে। অথচ যখন সেখানে ছিলাম তখন তার পাড় ঘেষে শুধু সাইকেলই চালিয়েছি।
তারপর গেলাম পদ্মায়। রাজশাহী থাকি তখন। একই শহরে আমার প্রেমিকাও থাকে। বয়ঃসন্ধিকালের প্রেমে প্রেমিকার রাগ ভাঙানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ আর প্রেমময় একটা ব্যাপার। আমি তার রাগ ভাঙাতাম পদ্মা পাড়ে নিয়ে।অথবা প্রায় বিকেলে বন্ধুর সাথে পদ্মাপাড়ে হাঁটতে যাওয়া একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে রাজশাহীর ওই ভরা পদ্মার পাড়ে বসলে যে কোনও মানুষের মন ভালো হয়ে যাবে বলে আমরা দুজনে বিশ্বাস করতাম। আমি এখনও করি।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনটা খুলনায়। কাছেই ভৈরব নদী। খুলনায় যাওয়া মাত্রই কাছেই একটা নদী পাওয়াতে অভ্যাসটা সচল থাকল। ভৈরব, সেখানে প্রথম বড় হয়েছি। সাহস বেড়েছে। গভীর রাতে নদী পাড়ে যাওয়ার
সাহস। শেষ রাতে ফিরে আসার সাহস। ভৈরবের পাড়েই ঘুমিয়ে পড়ার পর রাত তিনটেয় পুলিশ এসে উঠিয়ে দেবে। এরপর পুলিশের সঙ্গে তর্ক করার সাহস। আরও অনেক কিছুর সাহসই বাড়তে থাকল তখন। ‘ফ্রাস্ট্রেশন’, ‘ডিপ্রেশন’ নামের শব্দগুলোর সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করলাম। নদীর ওপারের গ্রাম মানেই সুন্দর একটা গ্রাম। ভৈরবের ওপারে গিয়ে সেটা আরও ভালো করে বুঝলাম। ভৈরবের ওপারের গ্রামটির নাম ছিল দিঘলিয়া। যে গ্রামটির ধানক্ষেত রাস্তার দু’পাশে খেজুর গাছের সারি। যে গ্রামটির শরীর ছুঁয়ে ভৈরব নদী। শীতের ভোরে ভৈরব পার হয়ে খেজুর রস খেতে গিয়ে দেখেছিলাম দিঘলিয়া।
বিশ্ববিদ্যালয় শেষে ঢাকায় এসে চাকরিতে এসে ঢুকলাম। ফ্যাক্টরি, নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ।
শীলতক্ষ্যা শুরুর দিকে পল্টন থেকে রূপগঞ্জ যেতাম। কাঁচপুর অথবা ডেমরার সুলতানা কামাল ব্রিজ দিয়ে শীতলক্ষ্যা পার হতাম। তারপর উত্তরা থেকে রূপগঞ্জ । তিনশ’ ফিট হয়ে কাঞ্চন ব্রিজ। ব্রিজের নীচেই একটা সবুজ চর। মাঝে মাঝে যেতাম রূপগঞ্জ ফেরিঘাট হয়ে। যে পথেই যাই শীতলক্ষ্যা ছুঁয়ে যেতেই হবে। ফেরিঘাটেই একজন বয়স্ক এক লোক ডালপুরি বানাত। পুরির ভেতর পরিমিত পরিমাণে ডাল রাজশাহীর পর রূপগঞ্জে এসেই পেয়েছিলাম। ফেরিঘাট দিয়ে গেলেও আমি প্রায়ই নৌকায় পার হতাম। কেননা পারপারের জন্য সেখানে আছে ডিঙি নৌকা, যা সচরচার এখন আর দেখা যায় না। তিন বছরেরও বেশী সময় ধরে রূপগঞ্জ আসা-যাওয়া পর রূপগঞ্জ নিয়ে আমার বচন— ‘রূপগঞ্জের যত রূপ, সবই শীতলক্ষ্যায়।
নারদ, তুলসীগঙ্গা, পদ্মা, ভৈরব, শীতলক্ষ্যা। পাঁচটি নদী জীবনের সঙ্গে কত কত ভাবে মিশে আছে!
এসব ভাবার সময় কোথায়! জীবন অনেক বড়।❐