অর্থনীতিভারত

প্রতিকূলতায়ও টাটার বড় শক্তি প্রাতিষ্ঠানিক সামাজিক ভিত্তি

শুধু ভারত নয়, গোটা এশিয়াতেই শীর্ষস্থানীয় কনগ্লোমারেটগুলোর অন্যতম টাটা গ্রুপ। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও প্রশাসনিক শক্তির দিক থেকেও গোটা বিশ্বেই ঈর্ষণীয় সুনাম অর্জন করেছে শতাব্দী প্রাচীন কনগ্লোমারেটটি। বলা হয়, টাটার প্রাতিষ্ঠানিক গঠনের সঙ্গে ভারত সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যাপক মিল রয়েছে। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী ও ব্যবস্থাপক নিয়োগ কর্মসূচিটিও গড়ে তোলা হয়েছে ভারত সরকারের লোকপ্রশাসন সেবার (আইএএস) আদলে।

টাটা গ্রুপের নির্বাহী ও ব্যবস্থাপক নিয়োগে বিশেষায়িত এ কর্মসূচি চালু রয়েছে ১৯৫৬ সাল থেকে। টাটা অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস (টিএএস) শীর্ষক এ কর্মসূচি চালু হয় গ্রুপের সাবেক চেয়ারম্যান জেআরডি টাটার হাত ধরে। এরপর প্রায় সাত দশক ধরে টিএএসের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রচুর নির্বাহী ও ব্যবস্থাপক তৈরি করেছে টাটা গ্রুপ। তাদের অনেকেই পরিচিতি পেয়েছেন ভারতের সবচেয়ে তুখোড় করপোরেট মস্তিষ্ক হিসেবে। তাদের মেধা ও কর্মশক্তির ওপর ভর করেই ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের ধারা অব্যাহত রেখেছে টাটা গ্রুপ।

নিজস্ব ওয়েবসাইটে টাটা গ্রুপ জানাচ্ছে, টিএএস হলো মূলত বর্ষব্যাপী নিবিড় প্রশিক্ষণ কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের জন্য নির্বাচিত তরুণ নির্বাহীদের বেছে নেয়া হয় দুটি উৎস থেকে—টাটা গ্রুপের অধীন বিভিন্ন কোম্পানি ও ভারতের শীর্ষ বিজনেস স্কুলগুলোয় পরিচালিত ক্যাম্পাস রিক্রুটমেন্ট কার্যক্রম। এ কার্যক্রমের উদ্দেশ্য হলো দ্বিমুখী। প্রথমত, কোম্পানির মধ্যে একগুচ্ছ দক্ষ ব্যবস্থাপক গড়ে তোলা। দ্বিতীয়ত, তাদের সম্ভাবনার পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহারের সুযোগ তৈরি করা।

টিএএসের আওতায় নিয়োজিত এ দক্ষ ও মেধাবী নির্বাহীদের কল্যাণে প্রশাসনিক সক্ষমতার দিক থেকে স্বতন্ত্র এক অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে টাটা গ্রুপ। কনগ্লোমারেটটির প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ব্যবসা ও সামাজিক শিক্ষার পণ্ডিতদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে বারবার।

এমন ঈর্ষণীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো থাকা সত্ত্বেও টাটা গ্রুপের সবচেয়ে বড় শক্তি ধরা হয় প্রতিষ্ঠানটির সামাজিক ভিত্তিকে। বিষয়টিতে একমত পোষণ করছেন ঐতিহাসিক মার্সিয়া রায়ানুও। এজন্য টাটা গ্রুপ-সংশ্লিষ্ট পুরনো অনেক নথিও ঘেঁটে দেখেছেন তিনি। তার ভাষ্যমতে, ভারতীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে জনকল্যাণমূলক কাজের দিক থেকে টাটা অপ্রতিদ্বন্দ্বী। সমাজের দুর্নীতি জর্জরিত পরিবেশের মধ্যেও টাটা হয়ে উঠেছে ‘বিশুদ্ধতা ও মাহাত্ম্যের’ প্রতিমূর্তি। এ বিষয়ে মার্সিয়া রায়ানুর একটি বইও সম্প্রতি প্রকাশ হয়েছে।

টাটা গ্রুপের সামাজিক ভিত্তির সবচেয়ে বড় উদাহরণ শিল্পনগরী জামশেদপুর। কনগ্লোমারেটটির প্রতিষ্ঠাতা জামশেদজি টাটা ১৯০০ সালে ভারতের প্রথম পরিকল্পিত শিল্পনগরী হিসেবে জামশেদপুরের নির্মাণ শুরু করেন। তবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয় তার মৃত্যুর পর ১৯১৯ সালে। নগরীটি গড়ে তোলা হয়েছিল টাটাদের মালিকানাধীন ইস্পাত শিল্প প্রতিষ্ঠানে কর্মরতদের আবাসন সুবিধা দেয়ার জন্য।

বলা হয়, জামশেদজি টাটার এ নগরী গড়ে তোলার পেছনে প্রধান অনুপ্রেরণা ছিল গার্ডেন সিটি মুভমেন্ট। এটি মূলত নগর পরিকল্পনার বিশেষ এক পদ্ধতি, যার মূল লক্ষ্য হলো সবুজ বেষ্টনীর মধ্যে স্বনির্ভর একটি নগর গড়ে তোলা। এক্ষেত্রে নগরে আবাসিক, শিল্প ও কৃষি এলাকা গড়ে তোলা হয় নির্দিষ্ট আনুপাতিক হারে। টাটা গ্রুপের ইস্পাত শিল্পে নিয়োজিত কর্মীদের জন্য গার্ডেন সিটির নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্য থেকেই জামশেদপুরের পত্তন ঘটানো হয়েছিল বলে কনগ্লোমারেটটির বিভিন্ন নথি ও ঐতিহাসিকদের বক্তব্যে উঠে এসেছে। পরবর্তী সময়ে এখানে আরো অনেক শিল্প গড়ে ওঠে। তবে নগরের নাগরিক সেবা ও সুবিধাদি পরিচালনার ভার থেকে যায় টাটা গ্রুপের হাতে। নাগরিক সুযোগ-সুবিধা দেখভালের দায়িত্বে রয়েছে টাটা আয়রন অ্যান্ড স্টিল কোম্পানি লিমিটেডের (টিসকো) সাবসিডিয়ারি জামশেদপুর ইউটিলিটি সার্ভিসেস কোম্পানি (জেইউএসসিও)। টিসকোর কর্মীদের ভালো আবাসন ও জীবনমান উন্নয়নের জন্য এ নগরী এখন অনেকটাই সম্প্রসারিত হয়েছে। এখানে গড়ে উঠেছে অন্যান্য আরো অনেক শিল্প।

তবে নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দিক থেকে নগরীটি ভারতের অন্যান্য শহরের তুলনায় এখনো বেশ আকর্ষণীয় অবস্থানেই রয়েছে। পরিণত হয়েছে ভারতীয় মধ্যবিত্তদের ঈপ্সিত শহরে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশটিতে বেশ কয়েকটি শহরকে প্রযুক্তিনির্ভর স্মার্ট নগরী হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিল। দ্য মিন্ট জানাচ্ছে, ওই তালিকায় না থাকলেও প্রযুক্তি ও ইন্টারনেট সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে সেসব শহরের আগেই স্মার্ট নগরীতে রূপ নিয়েছে জামশেদপুর। একই সঙ্গে জীবনমানের উন্নয়ন ঘটেছে নগরীর ১০ লাখেরও বেশি বাসিন্দার। শুধু নগর গড়ে তোলা নয়, কর্মী কল্যাণ-সংশ্লিষ্ট প্রতিটি বিষয়েই ভারতীয় কনগ্লোমারেটগুলোর মধ্যে অগ্রগামী টাটা গ্রুপ।

কনগ্লোমারেটটির সামাজিক ভিত্তির আরেকটি বড় অনুষঙ্গ হলো চিকিৎসা খাতে টাটা পরিবারের অবদান। ভারতে টাটা পরিবারের গড়ে তোলা হাসপাতালগুলো পরিচালিত হচ্ছে দোরাবজি টাটা ট্রাস্টের অধীনে। জামশেদজির ছেলে দোরাবজি টাটা স্ত্রী মেহেরবাইয়ের মৃত্যুর পর ১৯৩২ সালে ট্রাস্টটি গড়ে তুলেছিলেন। এটি গড়ে তোলার সময়ে নিজের মালিকানাধীন বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ারসহ সম্পদের বিশাল এক অংশ ট্রাস্টে দান করে দিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্যে তার স্ত্রীর মালিকানায় থাকা বিখ্যাত জুবিলি হীরাও ছিল। সে সময়ই হীরাটির মূল্য ছিল প্রায় ১ কোটি রুপি, যা বর্তমান ৫০ কোটি রুপির সমপরিমাণ।

দোরাবজি টাটা ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল। ১৯৪১ সালে মুম্বাইয়ে গড়ে তোলা হাসপাতালটিকে ধরা হয় এ গোলার্ধের ক্যান্সার চিকিৎসার সবচেয়ে বড় কেন্দ্রগুলোর অন্যতম হিসেবে। ক্যান্সার চিকিৎসার পাশাপাশি রোগটি নিয়ে গবেষণা ও শিক্ষায়ও বড় অবদান রাখছে টাটা মেমোরিয়াল হসপিটাল। এর বাইরেও ভারতের বিভিন্ন স্থানে বেশ কয়েকটি হাসপাতাল গড়ে তুলেছে টাটা পরিবার। এছাড়া ট্রাস্টের মাধ্যমে রোগতত্ত্ব নিয়ে গবেষণায় গড়ে তোলা হয়েছে স্যার দোরাবজি টাটা সেন্টার ফর রিসার্চ ইন ট্রপিক্যাল ডিজিজেস। একই নামে বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সে আরেকটি গবেষণা কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। কলকাতার রাজারহাটে গড়ে তোলা হয়েছে টাটা মেডিকেল সেন্টার।

এছাড়া শিক্ষা ও গবেষণা খাতেও বড় অবদান রাখছে ট্রাস্টটি। ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে টাটা ইনস্টিটিউট অব সোস্যাল সায়েন্স, টাটা ইনস্টিটিউট অব ফান্ডামেন্টাল রিসার্চ (টিআইএফআর, মুম্বাই), ন্যাশনাল সেন্টার ফর দ্য পারফর্মিং আর্টস, দ্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজ, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স, দ্য জেআরডি টাটা সেন্টার ফর ইকোটেকনোলজি, দ্য টাটা এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ট্রেনিং সেন্টার ফর দ্য ব্লাইন্ড, দি ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ডেমোগ্রাফিক স্টাডিজ, টিআইএফআর সেন্টার ফর অ্যাপ্লিবল ম্যাথমেটিকস, টিআইএফআর হায়দরাবাদ ইত্যাদি। এছাড়া বিভিন্ন খাতে দান-অনুদানের পাশাপাশি শিক্ষামূলক, চিকিৎসা ও ভ্রমণ কার্যক্রমে যোগ্য বিবেচিত ব্যক্তিদের বৃত্তিও দিয়ে থাকে ট্রাস্টটি।

পণ্ডিত গবেষকরা বলছেন, টাটা পরিবারের ব্যবসায়িক সম্প্রসারণের পেছনে শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা ও জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন কার্যক্রমের মাধ্যমে গড়ে তোলা সামাজিক ভিত্তি সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। এ প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক ভিত্তিকে কাজে লাগিয়েই রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও সমৃদ্ধ থেকে সমৃদ্ধতর হয়ে উঠেছে কনগ্লোমারেটটি।

এর প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসেও। এতে দেখা যাচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর সূচনাকালে ভারত বন্দি ছিল ব্রিটিশ শাসনের বেড়াজালে। পরের অর্ধশতক কেটেছে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ডামাডোলে। দেশভাগ ও স্বাধীনতার পরের অর্ধশতকেও রাজনৈতিক নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গিয়েছে দেশটি। দাঙ্গা-হাঙ্গামা থেকে শুরু করে জরুরি অবস্থাসহ নানা গোলযোগও মোকাবেলা করতে হয়েছে। ব্যবসায়িক পরিবেশের ক্ষতি হলেও এসব গোলযোগের মধ্যেই প্রায় বিনা বাধায় ব্যবসায়িক কার্যক্রম চালিয়ে গিয়েছে টাটা গ্রুপ। ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছে বিশ্বের অন্যান্য দেশেও।

কনগ্লোমারেটটির পুরনো দলিল ও পারিবারিক নথির ভিত্তিতে ঐতিহাসিকরা জানাচ্ছেন, ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে শাসকদের সঙ্গে টাটা গ্রুপের সম্পর্ক কিছুটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। সে সময় প্রতিষ্ঠানটি মহাত্মা গান্ধীর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ডাকে সাড়া দিয়েছে। জওহরলাল নেহরুর সমাজতান্ত্রিক গোছের রাষ্ট্র ব্যবস্থা চালু থাকা অবস্থায়ও ব্যবসা চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। আবার নেহরুর বৃহৎ শিল্প জাতীয়করণ কর্মসূচির সময়েও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে টাটা গ্রুপ। ওই সময়ে টাটা গ্রুপের এয়ার ইন্ডিয়াকে জাতীয়করণ করে নিয়েছিল নেহরু সরকার। এর পরের সময়গুলোতেও ভারতে প্রতিকূল নানা রাজনৈতিক পরিবেশের মুখোমুখি হতে হয়েছে টাটা গ্রুপকে। টাটা পরিবারের জনকল্যাণে অবদান রাখার মাধ্যমে গড়ে তোলা সামাজিক ভিত্তি এসব প্রতিকূলতা মোকাবেলায় বরাবরই বড় ভূমিকা রেখেছে।

ভারতীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান হুরুন রিসার্চ ও এডেলগিভ ফাউন্ডেশনের হিসাব অনুযায়ী, গত শতকে বিশ্বব্যাপী দাতা প্রতিষ্ঠান হিসেবে শীর্ষে ছিল টাটা গ্রুপ। এ সময় বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠানটির বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক কাজে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৮৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ।

তবে অন্যান্য অনেক বড় করপোরেটের মতো টাটারও অন্ধকারাচ্ছন্ন ইতিহাস রয়েছে। এ ইতিহাস গোপন করতে চায় কনগ্লোমারেটটিও। বর্তমান ঝাড়খণ্ডে জামশেদপুর নগরীর প্রতিষ্ঠা হয়েছিল স্থানীয় আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে। সে সময় টাটা গ্রুপের ব্যবস্থাপকদের বিরুদ্ধে বেশকিছু নিপীড়ন-নির্যাতনেরও অভিযোগ ওঠে। টাটাদের পূর্বপুরুষরা একসময় আফিম ব্যবসায়ও জড়িত ছিল। এছাড়া শিল্পাঞ্চলের জন্য জমি দখল, বনাঞ্চলের ও গ্রামীণ জমি দখল এবং বর্মি সামরিক জান্তার সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপনসহ বিভিন্ন সময়ে আরো অনেক অভিযোগ উঠেছে টাটাদের বিরুদ্ধে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension