করোনাপ্রধান খবরবাংলাদেশ

লকডাউনের ফেরে পেট চালানো ভার

রাজধানীর পুরানা পল্টন এলাকায় ডিজাইন ও ছাপার কাজ করে সংসার ভালোই চলছিল সাইফুল আলমের; দুবেলা দুমুঠো খাবারসহ জীবিকার সংস্থান হচ্ছিল তার দুই কর্মীর। খবর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের।

কিন্তু এপ্রিলের শুরু থেকে করোনাভাইরাস মহামারী নিয়ন্ত্রণে যে লকডাউন চলছে, তাতে পেট চালানোই বড় দায় হয়ে গেছে। অফিস ও বাসা ভাড়াসহ পরিবারের আরও খরচ তো আছেই।

সংসার চালাতে হিমশিম সাইফুলকে ধারদেনা করতে হয়েছে অনেক। ধার করে কর্মীদের দুয়েক মাস বেতন দিলেও আর না পেরে কয়েক মাস আগে তাদের ছুটি দিয়েছেন।

দফায় দফায় লকডাউনে বিপাকে পড়ার কথা জানিয়ে এই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একটা লকডাউনের শেষে কাজকর্ম শুরু করলে আবারও লকডাউন আসছে। আমরা গুছিয়ে উঠারই সুযোগ পাচ্ছি না।”

মাঝখানে ঈদুল আজহার আগে লকডাউন উঠে যাওয়ায় কয়েকদিনের জন্য সুযোগ পেলেও অফিস আর খোলেননি সাইফুল; পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে পুনরায় ব্যবসা শুরু কথা বলেছেন তিনি।

করোনাভাইরাসের মৃত্যু ও শনাক্তের হার বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ঘোষিত লকডাউন ঈদের বিরতি দিয়ে শুক্রবার আবার শুরু হয়েছে, যেটাকে সরকার বলছে ‘কঠোরতম লকডাউন’।

এই লকডাউনে অতি জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাসা থেকে বের হতে নিষেধ করা হয়েছে। বিধিনিষেধ মানাতে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবির সঙ্গে সেনাবাহিনীও মাঠে আছে।

শপিংমল, মার্কেটসহ সব ধরনের দোকানপাট বন্ধ। জরুরি সেবার দপ্তর বাদে অফিস-আদালত আর শিল্পকারখানাও বন্ধ রাখা হয়েছে। ৫ অগাস্ট মধ্যরাত পর্যন্ত এই বিধিনিষেধ চলবে।

বাংলাদেশে গত বছরের ৮ মার্চ প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে। মার্চের শেষ সপ্তাহে সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে।

তবে এর আগে ১৭ মার্চ থেকেই দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ২৬ মার্চ থেকে সব অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখে সারা দেশে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

জীবন ও জীবিকার এই অসম সমীকরণ মেলাতে গিয়ে অন্য অনেক দেশের মতো বাংলাদেশেও মে মাসের শেষ দিকে বিধিনিষেধ শিথিল করা শুরু হয়।

টানা ৬৬ দিনের লকডাউন ওঠার পর ৩১ মে থেকে অফিস খোলার পাশাপাশি গণপরিবহন চলাচালের অনুমতি দেয় সরকার। ধীরে ধীরে শুরু হয় ফ্লাইট চলাচল। অগাস্টে বিনোদন কেন্দ্রও খুলে দেওয়া শুরু হয়।

এ বছরের শুরুতে সংক্রমণের হার কমে যাওয়ায় বিধি-নিষেধও শিথিলতা আসে। ২০২১ সালের শুরুতে সংক্রমণের নিম্নগতিতে বিধি-নিষেধ ছিল না বললেই চলে। সরকার ওই সময় স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া পরিকল্পনাও করেছিল।

তবে গত মার্চ মাসের শেষে সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ পরিস্থিতি নাজুক করে তুললে ৫ এপ্রিল থেকে আবার বিধি-নিষেধ ফিরতে থাকে।

পরিস্থিতির সাময়িক উন্নতিতে সেই বিধি-নিষেধ পর্যায়ক্রমে শিথিল করা হয়েছিল। গণপরিবহনসহ দূরপাল্লার বাস চলাচল শুরু হয় অর্ধেক যাত্রী নিয়ে। ২৩ এপ্রিল থেকে দোকানপাট খোলার সুযোগও তৈরি করে দেয় সরকার।

কিন্তু ভারতে পাওয়া কোভিডের ডেল্টা ধরনের সংক্রমণে জুনের মাঝামাঝি সময়ে সীমান্ত জেলাগুলোতে পরিস্থিতি নাজুক হয়ে পড়ে। পরে সেই সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে। তাতে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপের পথে হাঁটতে হয় সরকারকে।

ব্যবসায়ী সাইফুলের চেয়ে মিরপুরের উত্তর পীরবাগের বাসিন্দা হাওয়া বিবির দুশ্চিন্তা আরেকটু বেশি। নিজেদের জীবিকার পাশাপাশি কলেজপড়ুয়া মেয়ের শিক্ষাজীবনও যোগ হয়েছে তাদের দুর্ভাবনায়।

রাজধানীর একটি কলেজে স্নাতক শেষ বর্ষে পড়ছেন তার দ্বিতীয় মেয়ে; লকডাউনের কারণে বন্ধ থাকায় শেষ ‍মুহূর্তে গিয়ে পড়াশোনায় দীর্ঘ ছেদ পড়েছে এই শিক্ষার্থীর।

স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে ওই এলাকায় একটি চায়ের দোকান চালান হাওয়া বিবি; কষ্টেশিষ্টে পরিবার চালিয়ে তারা মেয়ের পড়ালেখার খরচ যোগান সেখান থেকে।

লকডাউনের মধ্যে মাঝেমধ্যে দোকান খুললেও পুলিশ আসার ভয় আছে হাওয়া বিবির মনে। তবুও খাবার যোগাতে ঝুঁকি নিয়ে দোকান খোলার কথাই বলছেন তিনি।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পুলিশ আসলে আগে খাবার দিতে বলব, তারপর দোকান বন্ধ করব। এছাড়া আমাদের কিছু করার নাই।

”লকডাউন না হলে এতদিন মেয়ের পড়ালেখা এতদিন শেষ হয়ে যেত। ও কিছু একটা করতে পারত। এখন তো মনে হচ্ছে লকডাউনের কারণে ওর চাকরির বয়সও শেষ হয়ে যাবে।”

প্রথম দফায় ২০২০ সালের ২৭ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণার ১০ দিন আগেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছিল সরকার। এখনও তা খোলেনি।

বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্তি লেগে গেলেও করোনাভাইরাসের বিস্তার রোধে তা মেনে নেওয়ার কথা বলেন শান্তিনগর এলাকার বাসিন্দা সাদিয়া বিনতে সিদ্দিকী।

লকডাউনের কথা বিবেচনায় নিয়ে এক-দেড় মাসের মাছ-মাংস এক সঙ্গে কিনে ফেলেন তারা। তার ব্যবসায়ী স্বামী আসা-যাওয়ার পথে অন্যান্য কাঁচা বাজার সেরে নেন।

সাদিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার অবস্থা খুবই খারাপ। বাসায় থাকতে থাকতে বিরক্তি লেগে যাচ্ছে। আগের লকডাউনগুলোতে একদিনও বাইরে যাই নাই। মাঝে ঈদ উপলক্ষে একটি পরিবারিক গেট টুগেদার হয়েছিল, এই যা। আবার ঘরে ঢুকে পড়লাম।”

ঈদে কুষ্টিয়ায় শ্বশুর বাড়ি যাওয়ার ইচ্ছা থাকলেও ফেরার পথে ঝক্কি ঝামেলা বিবেচনায় পরিকল্পনা বাদ দেওয়ার কথা জানান তিনি।

লকডাউনে খেটে খাওয়া মানুষের কষ্ট বিবেচনায় নিজের ভালো থাকার কথা জানিয়ে সাদিয়া বলেন, “অনেক মানুষের কাজ নাই, খাবার পাচ্ছে না। সবাই তো ঈদও করতে পারে নাই। অনেক মানুষ আজকে ফিরতে গিয়ে কত কষ্ট করল, তা তো দেখলেনই।”

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension