গল্পসাহিত্য

সাদাত হাসান মান্টোর গল্প: লাইসেন্স

 
 
 
আব্বু কোচোয়ান ছিল বেশ সুপুরুষ। ওর ঘোড়াও ছিল শহরের এক নম্বর। স্বভাবতই যাকে-তাকে ওর টাঙ্গায় চড়াত না ও। রোজকার বাঁধা খদ্দের থেকেই অনায়াসে রোজগার হত দিনে দশ-পনের টাকা, যা ওর জন্য ছিল যথেষ্ট। অন্য কোচোয়ানদের মত আব্বু কোনও নেশা করত না। কিন্তু শৌখিন আব্বুকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জামাকাপড় ছাড়া কখনও দেখা যেত না।
 
রাস্তা দিয়ে ঘুঙুরের আওয়াজ তুলে গেলে লোকের চোখ আটকে যেত ওর টাঙ্গায়। ‘ওই দেখ আব্বু যাচ্ছে। বসার ভঙ্গিটা দেখেছ? আর দেখ কি আশ্চর্য কায়দায় পাগড়িটা বেঁধেছে?’ রাস্তাচলতি মানুষের চোখের ভাষা বুঝে নিতে আব্বুর এক লহমাও লাগত না কোনদিন।
 
তাদের চোখের ভাষা পড়ে ওর তাকানোর ভঙ্গি যেত বদলে আর ঘোড়াটা ছুটতে থাকত আরও দ্রুত। হাতের লাগামটা সেসময়ে ও এমনভাবে বাগিয়ে ধরত যেন ওটা না ধরলেও চলে যায়। মনে হত, ঘোড়াটা যেন ওর নির্দেশ ছাড়াই দৌড়চ্ছে। যেন ঘোড়াটার কাছে ওর মালিকের হুকুমের দরকার নেই কোনও। এরকম মূহূর্তগুলিতে মাঝেমাঝেই ওর মনে হত আব্বু, ওর ঘোড়া চান্নি আর ওর টাঙ্গা, সবটা মিলিয়ে একটা মানুষ। একটা আস্ত মানুষ। আর সেই মানুষটা আব্বু ছাড়া আর কেই বা হতে পারে?
 
যেসব লোকেদের ও টাঙ্গায় চড়তে দিত না তারা মনে মনে ওকে অজস্র গালাগালি দিত, ‘আল্লাহ করুক ওর টাঙ্গাটা ঘোড়াসমেত নদীতে ডুবে যাক, তবে যদি ওর অহংকার একটু কমে!’
 
পথচলতি লোকের চোখে এসব কথা পড়তে পড়তে আব্বুর পুরুষ্টু গোঁফে ঢাকা ঠোঁটে ফুটে উঠত বিজয়ীর হাসি। শহরের অন্য কোচোয়ানরা ওকে দেখলেই ঈর্ষায় জ্বলেপুড়ে যেত। কিছুদিন পর ওর দেখাদেখি তারাও ধারদেনা করে নতুন টাঙ্গা বানাল, ওর টাঙ্গার মত করে সাজাল। তবুও আব্বুর মত ঠমক আনতে পারল না কেউই। স্বভাবতই এসবে একটুও কমল না আব্বুর টাঙ্গার জনপ্রিয়তা।
 
একদিন দুপুরবেলা আব্বু একটা অশত্থগাছের ছায়ায় টাঙ্গা থামিয়ে খানিক জিরোচ্ছিল। হঠাৎ কানে আওয়াজ এল, ‘স্টেশন যাবে?’ ও চোখ খুলে দেখল একজন অপরূপা সুন্দরী ওর টাঙ্গার সামনে দাঁড়িয়ে।
 
মহিলাকে একনজরেই দেখলেও তার দৃষ্টি যেন বুকে আটকে গেল আব্বুর। মহিলা নয়, ষোল-সতের বছরের একটা মেয়ে, রোগা অথচ মজবুত, শ্যামবর্ণ অথচ উজ্জ্বল। কানে ছোট্ট রুপোর দুল, সোজা সিঁথি, টিকালো নাক, নাকের ডানদিকে ছোট্ট তিল, লম্বা কামিজ আর ঘন নীল সালোয়ার, মাথায় ওড়না।
 
মেয়েটা নরম গলায় বলল, ‘দাদা, স্টেশন যেতে কত নেবে?’
 
ওর ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসি খেলে গেল, ‘এক টাকাও না!’
 
মেয়েটার মুখে এবার যেন একটু হাসিও, ‘কত নেবে স্টেশন যেতে?’
 
ও মেয়েটাকে চোখ দিয়ে গিলতে গিলতে বলল, ‘তোর থেকে আর কী নেব, আয় টাঙ্গায় বস।’
 
মেয়েটা নিজের কামিজ ঠিক করতে করতে বলল, ‘এরকম অদ্ভুতভাবে কথা বলছ কেন তুমি?’
 
ও হেসে বলল, ‘আয়, টাঙ্গায় বোস, যা ইচ্ছে দিস।’
 
মেয়েটা কিছুক্ষণ ভাবতে সময় নিল, তারপর টাঙ্গায় পা দিয়ে বলল, ‘জলদি স্টেশন নিয়ে চল।’
 
ও ফিরে তাকাল, ‘খুব তাড়া দেখছি সোনা?’
 
‘এ বাবা, তুমি তো’, মেয়েটা অস্ফুটে কিছু বলল।
 
টাঙ্গা চলতেই থাকল, ঘোড়ার পায়ের নিচ দিয়ে দৌড়ে গেল কত রাস্তা। ওর ঠোঁটে দুষ্টুমির হাসিটা প্রকট হচ্ছিল ক্রমশ, আর মেয়েটা সিঁটিয়ে বসেছিল। অনেকক্ষণ কেটে যাওয়ার পর মেয়েটা সন্ত্রস্ত গলায় বলে উঠল, ‘এখনও স্টেশন এল না?’
 
‘এসে যাবে। তোর আমার স্টেশন তো একটাই’, ও অদ্ভুত গলায় জবাব দিল।
 
‘তার মানে?’
 
ও মেয়েটার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, ‘সোনা, তুমি যখন আমার দিকে প্রথম তাকিয়েছিলে তখনই আমাদের স্টেশন এক হয়ে গেছিল। তুমি এটুকুও বোঝ না? তোমার দিব্যি আমি বানিয়ে বলি নি।’
 
মেয়েটা মাথার ওড়না ঠিক করতে করতে আব্বুর দিকে আড়চোখে তাকাল। ওর চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল আব্বুর কথার মানে ও বেশ বুঝেছে। তবে ওর ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছিল আব্বুর কথাটা ওর খুব খারাপ লাগে নি।
 
দুজনের স্টেশন এক হোক অথবা নাই হোক, ছেলেটা বেশ চৌকশ; তবে ও কি কথা রাখবে? আমাকে কি স্টেশনে পৌঁছে দেবে ও? মেয়েটা ক্রমশ চিন্তায় দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ছিল।
 
ঘোড়াটা নিজের ছন্দে দৌড়চ্ছিল বেশ। চারদিকে ঘুঙুরের আওয়াজ ছাড়া আর কিছুই কানে আসছিল না।
 
ও বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে মেয়েটাকে পরখ করছিল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ টাঙ্গা থামিয়ে ঘোড়ার লাগামটা জঙ্গলের একটা গাছের সঙ্গে বেঁধে একলাফে মেয়েটার পাশে এসে বসল।
 
মেয়েটা চুপ করে বসে।
 
ও মেয়েটার হাতদুটো আচমকা ধরে বলল, ‘এই হাত দুটো আমাকে দিয়ে দাও।’
 
মেয়েটা অস্ফুটে শুধু বলল, ‘আমার হাত ছাড়ো।’ কিন্তু আব্বুর হাতের ছোঁয়ায় ওর বুকের ধুকপুকানি ক্রমশ বাড়তে থাকল।
 
আব্বু খুব নরম গলায় মেয়েটাকে বলল ‘দেখ এই টাঙ্গা, ঘোড়া আমার জীবনের সবচাইতে প্রিয়। কিন্তু আল্লাহর কসম, দরকার হলে এদের বেচেও আমি তোমাকে সোনার বালা কিনে দেব। নিজে ছেঁড়া জামাকাপড় পরে থাকব কিন্তু তোমাকে সারাজীবন রাণী করে রাখব। তুমিই আমার প্রথম প্রেম। আল্লাহর কসম তোমাকে না পেলে আমি তোমার সামনেই নিজের গলা কেটে ফেলব।’ তারপর মেয়েটার হাত ছেড়ে হঠাৎ বলল ‘আজ কি হয়েছে আমার? চলো তোমাকে স্টেশনে ছেড়ে আসি।’
 
মেয়েটা অস্ফুটে বলল, ‘না, তুমি আমার গায়ে হাত দিয়েছ।’
 
ও ঘাড় নামিয়ে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও, ভুল হয়ে গেছে।’
 
‘এই ভুলটার প্রায়শ্চিত্ত করবে না?’
 
মেয়েটার গলায় একটা অদ্ভুত চ্যালেঞ্জের সুর ছিল, তা যেন আব্বুকে বলছিল ‘পারবে তোমার টাঙ্গাটাকে ওই টাঙ্গাটার আগে নিয়ে যেতে? পারবে? বলো?’
 
ও ঘাড়টা খানিক তুলে তারপর বুকে হাত রেখে বলল, ‘আব্বু তোমার জন্য জান কবুল করে দেবে।’
 
মেয়েটা এবার ডানহাতটা বাড়িয়ে বলল, ‘হাতটা ধরো।’
 
ও মেয়েটার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, ‘নিজের প্রাণের কসম খেয়ে বলছি, আব্বু আজীবন তোমার ক্রীতদাস হয়ে থাকবে।’
 
পরদিনই আব্বু আর ওই মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেল।
 
মেয়েটার নাম ইনায়ত ওরফে নীতি, বাড়ি গুজরাতের ভাবনগর জেলায়।
 
ও যে আত্মীয়দের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল, তারা যখন ওর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করছিল, সেসময় আব্বুর সঙ্গে ও ভালোবাসার নদী পার হচ্ছিল।
 
আব্বু এবং নীতি, দুজনেই বেশ আনন্দে ছিল এরপর। আব্বু তিলতিল করে টাকা জমিয়ে ওর জন্য সোনার বালা কিনল, সিল্কের সালোয়ার-কুর্তাও। নীতির কাছে এগুলো খুব কম পাওনা ছিল না।
 
সিল্কের সালোয়ার-কুর্তা পরে ও যখন আব্বুর সামনে দিয়ে হাঁটত তখন আব্বুর হৃদয় স্পন্দন বেড়ে যেত। ও তখন মনে মনে বলত, ‘আল্লাহর কসম, তোমার মত সুন্দর এই পৃথিবীতে আর কেউ নেই।’ ও নীতিকে জড়িয়ে ধরে বলত, ‘নীতি, তুমি আমার রাণী।’
 
এভাবেই ভালোবাসায়, আদরে কেটে যাচ্ছিল দিন। এরপর হঠাৎই একদিন পুলিশ এসে দরজায় কড়া নাড়ল। আব্বুকে গ্রেফতার করল তারা।
 
নাবালিকা নীতিকে ভুলিয়ে ফুসলিয়ে বিয়ে করবার জন্য আব্বুর দুবছরের জেল হয়ে গেল।
 
আদালতে আব্বুর সাজা শুনে নীতি ওকে জড়িয়ে ধরল। ও কাঁদতে কাঁদতে আব্বুকে শুধু এটুকুই বলল, ‘আমি বাবা মায়ের সঙ্গে যাব না। ওবাড়িতেই তোমার পথ চেয়ে বসে থাকব।’
 
আব্বু শুধু ওর পিঠে হাত বুলিয়ে বলল, ‘সাবধানে থেকো। আমার টাঙ্গা-ঘোড়া তোমার জিম্মায় রেখে যাচ্ছি। নিয়মিত ভাড়া তুলতে ভুলো না কিন্তু।’
 
নীতির বাবা-মা অনেক সাধ্যসাধনা করেও ওকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারল না।
 
শুরু হল ওর একলা জীবন। টাঙ্গা ভাড়া বাবদ যে পাঁচটাকা ও রোজ পেত তাতেই দিব্যি দিন কেটে যেত। সারা সপ্তাহে একদিন দেখা আর বাকি ছদিন শুধু আব্বুর অপেক্ষা, এভাবেই কাটতে লাগল ওর প্রতিদিন।
 
ওর জমানো যা টাকা-পয়সা ছিল তা আব্বুর জন্য খাবার কিনতে আর যেতে আসতেই খরচ হয়ে গেল। একদিন হঠাৎ আব্বুর চোখ ওর কানে পড়ল, ‘তোমার কানের দুল?’
 
ও একটা কমলালেবুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ‘কে জানে, হারিয়ে গেছে কোথায়।’
 
আব্বু হঠাৎ রেগে গিয়ে বলল, ‘প্রতিদিন আমার জন্য এত কিছু আনার কী দরকার? আমি যেভাবেই আছি, বেশ ভালো আছি।’
 
দেখা করার সময়ও ফুরিয়ে এসেছিল। ও আর কথা না বাড়িয়ে শুধু ম্লান হেসে বাড়ি ফিরে এল। সেদিন প্রচুর কাঁদল ও। দেখা করার সময়ে অনেক কষ্টে সামলে রেখেছিল নিজেকে। ও স্পষ্ট বুঝতে পারছিল আব্বুর শরীর ক্রমশ ভেঙ্গে পড়ছে।
 
ও ভাবল, ‘আমাকে না দেখতে পাবার কষ্টেই বোধহয় আব্বুর শরীরের এই হাল।’
 
একলা থাকার কষ্ট, জেলের পচা খাবার আর হাড়ভাঙা খাটুনি এসবই জানা ছিল ওর, শুধু আব্বুর হার্টের রোগের কথা বাদ দিয়ে।
 
হাসপাতালে শুয়ে মরবার কয়েক মূহূর্ত আগে ও বিড়বিড় করে নীতিকে বলল, ‘যদি জানতাম এত তাড়াতাড়ি আমি মারা যাব তাহলে আমি তোমাকে বিয়ে করতাম না নীতি। তোমার এই দুর্দশার জন্য শুধু আমিই দায়ী। আমাকে ক্ষমা করে দাও। তবে আমার স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে আমার টাঙ্গা-ঘোড়ার যত্ন নিও। আর চান্নির মাথায় হাত বুলিয়ে বোলো বাবা ওর জন্য ভালোবাসা পাঠিয়েছে।’
 
আব্বু মারা যাবার দিনই নীতিরও সমস্ত কিছু হঠাৎ শেষ হয়ে গেল।
 
প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা দীনা আসত পাঁচটাকা নিয়ে আর ওকে অভয় দিয়ে বলত, ‘বৌদি আল্লাহর ইচ্ছার কাছে আমরা সবাই অসহায়। আব্বু শুধু আমার বন্ধুই না, ভাইও ছিল। আমি যতখানি পারব, নিশ্চয় করব।’
 
কিন্তু এর কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন দীনা ওকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসল। ওর কথা শুনে নীতির ওকে ধাক্কা মেরে বের করে দিতে ইচ্ছে করল, কিন্তু এসব কিছুই না করে ও শুধু ঠান্ডা গলায় বলল, ‘দাদা, আমি বিয়ে করতে পারব না।’
 
সেদিন থেকেই দীনার ব্যবহারও গেল বদলে। প্রথম কিছুদিন অন্য কারোর হাতে পাঁচ টাকা দিয়ে পাঠানো শুরু করল, তারপর কখনও চারটাকা দিত, কখনও তিন। এরপর হঠাৎ শরীর খারাপের অজুহাতে কিছুদিন এলই না। তারপর বলল শরীর খারাপের জন্য কদিন টাঙ্গা চালানো হয় নি বলে রোজগারও হয় নি, আর টাঙ্গাটার মেরামত না করালেই নয়।
 
নীতি সমস্ত বুঝতে পেরে একদিন দীনাকে বলল, ‘দাদা তোমাকে আর কষ্ট করতে হবে না। আমার টাঙ্গা-ঘোড়া বরং আমাকেই ফেরত দিয়ে দাও।’
 
এর কিছুদিন পর ও আব্বুর আরেকজন প্রিয় বন্ধু মাঞ্ঝেকে টাঙ্গাটা চালাতে দিল। কিছুদিন পর সেও এসে নীতিকে বিয়ে করতে চাইলে ও স্পষ্ট না বলল। তারপর তারও ব্যবহার গেল বদলে। অসহায় নীতি এবার আব্বুর টাঙ্গা-ঘোড়া অজানা এক কোচোয়ানের হাতে তুলে দিল। এক সন্ধ্যায় সে মাতাল অবস্থায় টাকা দিতে এসে নীতির হাত ধরতে গেল। সেদিন অনেক কথা শুনিয়ে লোকটাকে বাইরে বের করে দিল নীতি।
 
এরপর সত্যিই ও বিপদে পড়ল। আট-দশদিন পর এভাবে কাটানোর পর হঠাৎ একদিন ওর মাথায় এল, ‘নিজে চালালে কেমন হয়?’ আব্বুর সঙ্গে বেরিয়ে অনেকবার ও নিজেই টাঙ্গা চালিয়েছে। আর এ শহরের সমস্ত রাস্তাও এখন ওর চেনা।
 
তারপর ওর মনে হল, ‘লোকে কী বলবে?’
 
তারপর নিজেকেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বলল, ‘মেয়েরা কি পরিশ্রম করে না নাকি?’ ‘মেয়েরা আজকাল অফিসে যায় তারপর আবার বাড়িতেও হাজার কাজ করে। খেটেই তো খাব, এতে অসুবিধা কোথায়?’
 
বেশ কিছুদিন ভাবার পর ও আল্লাহকে স্মরণ করে একদিন রাস্তায় টাঙ্গা বের করল। প্রথমদিন থেকেই বাকি সব কোচোয়ানদের চোখ টাটাল আর পুরো শহরে খবর রটে গেল এক সুন্দরী রমণী টাঙ্গা চালাচ্ছে। সব জায়গায় শুধু তাকে নিয়েই আলোচনা শুরু হল। নীতি যে রাস্তা দিয়ে টাঙ্গা চালিয়ে যেত সেই রাস্তায় অসংখ্য লোক অপেক্ষা করে থাকত সওয়ারি হবে বলে।
 
প্রথম প্রথম নীতির টাঙ্গায় চাপতে লোকে ভয় পেলেও কিছুদিনের মধ্যেই সে ভয় গেল কেটে। এরপর থেকে আর এক মিনিটও নীতির টাঙ্গা খালি পড়ে থাকত না। সব্বাই ওর টাঙ্গায় চাপবার জন্য হুড়োহুড়ি করত।
 
কিন্তু কিছুদিন এভাবে চালাবার পর ও বুঝতে পারল সারাদিন এভাবে টাঙ্গা চালালে ওর আর ঘোড়ার, দুজনেরই শরীর যাবে ভেঙে। তাই স্থির করল এবার থেকে সকাল সাতটা থেকে বারটা অবধি চালিয়ে একটু বিশ্রাম নেবে। তারপর আবার দুপুর দুটো থেকে ছটা অবধি চালাবে। এতে ওর ধকল খানিক কমল। রোজগারও খুব মন্দ হচ্ছিল না।
 
তবে ও ক্রমশ বুঝতে পেরেছিল লোকে ওর টাঙ্গায় চড়ে স্রেফ সান্নিধ্য পেতেই। উঠে অকারণেই খানিক এদিক-ওদিক ঘোরে, অশ্লীল রসিকতা করে, অদ্ভুত সব কথা বলে তারপর কোথাও একটা নেমে পড়ে।
 
ও এটাও টের পাচ্ছিল যে ও নিজেকে না বিক্রি করলেও লোকে একটু একটু করে প্রতিদিন ওকে কিনে নিচ্ছিল। ও এও বুঝতে পারছিল যে শহরের বাকী কোচোয়ানরা আজকাল ওকে নোংরা মনে করে। কিন্তু এত কিছু সত্ত্বেও এ লড়াই ছাড়ার কোনও বিকল্প ওর মাথায় এল না।
 
কিন্তু একদিন হঠাৎ সেই শহরের কমিটি ওকে ডেকে বলল, ‘তুমি টাঙ্গা চালাতে পারবে না।’
 
ও জিজ্ঞাসা করল, ‘কিন্তু কেন হুজুর?’
‘লাইসেন্স ছাড়া টাঙ্গা চালানো অপরাধ। আর লাইসেন্স না নিয়ে এবার রাস্তায় বেরোলে টাঙ্গা-ঘোড়া দুই বাজেয়াপ্ত হবে।’
 
ও প্রশ্ন করল, ‘তাহলে বলুন হুজুর কিভাবে পাব এই লাইসেন্স?’
 
তারা সাফ জবাব দিল, ‘মেয়েদের লাইসেন্স দেওয়া হয় না।’
 
ও আবার প্রশ্ন করল, ‘হুজুর আমার টাঙ্গা-ঘোড়া সব কেড়ে নিন। কিন্তু আমাকে বলুন মেয়েরা যদি চরকা চালাতে পারে, কয়লা কাটতে পারে, ঝুড়ি বুনতে পারে তাহলে আমি টাঙ্গা চালালে অসুবিধা কোথায়? হুজুর আমার ওপর দয়া করুন, এভাবে আমার রুটি কেড়ে নেবেন না। আমি কীভাবে রোজগার করব তা দয়া করে বলুন!’
 
শহরের কমিটি তাকে উত্তর দিল, ‘বাজারে গিয়ে ধান্দা শুরু কর। ওতে রোজগার অনেক বেশি।’
 
নীতির অভ্যন্তরের সমস্ত নীতি সেই মূহূর্তেই জ্বলেপুড়ে ছারখার হয়ে গেল। ও শুধু মৃদু স্বরে ‘আচ্ছা’ বলে বেরিয়ে এল।
 
তারপর খুব জোরে টাঙ্গা চালিয়ে এসে সোজা কবরস্থানে এসে থামল। এরপর এক মূহূর্ত স্থির হয়ে আব্বুর কবরের সামনে দাঁড়াল। তারপর মাথা নিচু করে বলল, ‘আব্বু, আজ তোমার নীতি কমিটির অফিসে মারা গেছে।’
 
পরদিন ও কমিটির অফিস গেল। এবং সেখান থেকে ওর নিজের শরীর বেচার লাইসেন্স পেতে কোনও বেগ পেতে হল না।
Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Check Also
Close
Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension