বিজয়ের মাসেমুক্তিযুদ্ধ

৬ ডিসেম্বর ১৯৭১, বিজয়ের পথে

জাহান আরা দোলন: আজ ৬ ডিসেম্বর। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। ১৯৭১ এর এই দিনে বাংলাদেশ স্বীকৃতি লাভ করে। সারা বিশ্বকে হতবাক করে দিয়ে, জ্বলে পুড়ে ছারখার হওয়া এক ভূখন্ডের, রক্ত দিয়ে অর্জন করা স্বাধীনতার প্রথম ধাপ এই স্বীকৃতি। এই স্বীকৃতি একটি দেশের, দেশের মানুষের ত্যাগের বিনিময়ে অর্জন। বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় ভারত ও ভুটান।

৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের দৈনিক আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান শিরোনাম ছিল ভারতের বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান।

৬ ডিসেম্বর, সর্বপ্রথম ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করে। এর কয়েক ঘণ্টা পর ভুটানও বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় ঘোষণা দিয়ে এটি জানিয়ে দেন। তিনি জেফারসনের বিখ্যাত উক্তি অনুসারে বলেন, বাংলাদেশের সরকার সমর্থিত হচ্ছে ‘সম্পূর্ণরূপে জাতির আকাঙ্ক্ষায় বা উইল অব দ্য নেশন’ দ্বারা।

রয়টার্স জানায়, ভারতের কয়েক ঘণ্টা পর ভুটানও বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

ভারতের এই ঘোষণার পর, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে সকল কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করে। ভারতে মার্কিন অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যায় । উত্তর ভিয়েতনামে যুদ্ধরত দক্ষিণ চীন সাগরে অবস্থিত মার্কিন সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু ততক্ষণে পাকবাহিনী যুদ্ধের ময়দান থেকে পালাতে শুরু করেছে। পাকিস্তান নির্বাচন কমিশন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কারণে ‘পূর্ব পাকিস্তানের’ উপ-নির্বাচনে স্থগিত করে দেয়। এই নির্বাচন ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল।

মেজর জলিলের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযোদ্ধারা তখন সাতক্ষীরা মুক্ত করে খুলনার দিকে এগুচ্ছে। তিনি লিখেছেন, ‘বেলা এগারোটার সময় ‘অল ইন্ডিয়া রেডিও’ মারফত ঘোষণা হলো যে, ভারত বাংলাদেশকে সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। দীর্ঘ ন’মাস যাবত সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অধীর আগ্রহে দিনটির জন্য প্রতীক্ষায় ছিল। হঠাৎ স্বীকৃতির এই ঘোষণা শুনে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির বিধ্বস্ত অন্তর গর্বে ফুল উঠল।’

আজকের দিনে যশোর হানাদার মুক্ত হয়েছিল।

একাত্তরের এই দিনে মেহেরপুর, ঝিনাইদহ, সুনামগঞ্জ, লালমনিরহাট, যশোরের চৌগাছা, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ, রংপুরের পীরগঞ্জ, কুড়িগ্রামের উলিপুর, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, ও নেত্রকোনার দুর্গাপুর পাকিস্তানি হানাদার মুক্ত হয়। এদিন দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বিজয় নিশ্চিত করে দেশের ৬ জেলার দুর্বার মুক্তিবাহিনী। চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হলেও এদিন ছয়টি জেলায় ওড়ানো হয় লাল সবুজের বিজয় পতাকা।

দেশের প্রথম স্বাধীন জেলা হিসেবে যশোর জেলা সর্বপ্রথম পাক হানাদার বাহিনীর দখল থেকে মুক্ত হয়েছিল। যৌথবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে যশোর থেকে ৫ ও ৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী পালিয়ে যায় খুলনার দিকে। ৬ ডিসেম্বর দুপুরে যশোর জেলায় ওড়ে লাল-সবুজ পতাকা।

ফেনী অঞ্চলে ক্যাপ্টেন জাফর ইমামের নেতৃত্বে নানা হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে পাক বাহিনী। দিশেহারা হয়ে ৫ ডিসেম্বর রাতে তারা কুমিল্লার দিকে পালিয়ে যায়। পরদিন ৬ ডিসেম্বর সকালে সার্কিট হাউজের সামনে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়িয়ে আনন্দ মিছিল বের করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

কমান্ডার আব্দুস শহীদের নেতৃত্বে হবিগঞ্জে অবস্থান নেয় ৩৩ মুক্তি ফৌজ। কয়েক ভাগে বিভক্ত হয়ে তারা পাক বাহিনীর ক্যাম্পগুলোতে হামলা চালায়। ৬ ডিসেম্বর ভোরে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় পাক বাহিনী। পরে, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উঁচিয়ে পুরো শহর প্রদক্ষিণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

এই দিনে হানাদার মুক্ত হয় উত্তর অঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রাম। জেলা শহরে পাকসেনাদের ঘাঁটিতে মিত্র বাহিনীর বিমান হামলার পাশাপাশি অভিযানের নেতৃত্ব দেন ৬ নম্বর সাব সেক্টরের কোম্পানি কমান্ডার মোহাম্মদ আব্দুল হাই সরকার বীরপ্রতীক।

তিনি বলেন, ‘বিমান বাহিনী কুড়িগ্রামের অবস্থানরত পাক হানাদের ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারা এরসঙ্গে যোগ দেন। পরে, টিকতে না পেরে বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কুড়িগ্রাম শহর ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক বাহিনী।’

মেহেরপুরের মানুষ প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সময়ের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক এলাহি চৌধুরীর নেতৃত্বে আনসার মুজাহিদদের নিয়ে গড়ে তোলা হয় মুক্তিবাহিনী। ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুর মুক্ত করতে অবস্থান নেয় মুক্তিবাহিনী। ওইদিন রাতে জেলা ছেড়ে পালিয়ে যায় পাক হানাদাররা। মুক্ত হয় মেহেরপুর। জয়বাংলা শ্লোগানে মুখরিত হয় চারদিক।

শেরপুরে ধানুয়া কামালপুর মিত্র বাহিনীর আক্রমণে পাক বাহিনী ৪ ডিসেম্বর জেলার শ্রীবরদীর দিকে অবস্থান নিলে ১১নং সেক্টরের কর্ণেল আবু তাহেরের নেতৃত্বে মিত্র বাহিনী আক্রমণ করে। পরে, মিত্র বাহিনীর আক্রমণে ৬ই ডিসেম্বর ভোরে শ্রীবরর্দী থেকে পাক বাহিনী শেরপুর হয়ে জামালপুরে অবস্থান নেয়। ওইদিন বীরপ্রতীক জহুরুল হক মুন্সি ও মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রেজ্জাক বিজয়ের পতাকা উত্তোলন করেন।

সেদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারতের জওয়ানদের অভিবাদন জানান।

লেফটেন্যান্ট নিয়াজি তার বাহিনীকে ঝিনাইদহ থেকে বেরিয়ে এসে ঢাকাকে রক্ষা করতে আদেশ দেন। তিনি তাদেরকে মেঘনা নদীর কাছে জড়ো হওয়ার নির্দেশও দেন। এটা অসম্ভব ছিল কারণ, যৌথ বাহিনী ঢাকা-যশোর মহাসড়ক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। যৌথ বাহিনীর একটি দল খুলনার দিকে এগিয়ে যেতে থাকে এবং অন্য আরেকটি দল কুষ্টিয়ার দিকে এগুতে থাকে।

পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক উপদেষ্টা রাও ফরমান আলী বলেন, পাকিস্তানীরা ভারতের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষামূলক যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তিনি আরও বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি, আমাদের শক্তি বর্তমান পরিস্থিতিতেও পূর্ব পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারে।‘ যদিও পাকিস্তানিরা তখন বাংলা ছেড়ে পালানোর পথ খুঁজছে।❐

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension