নির্বাচিত কলামমুক্তমত

অদম্য বাঙালির স্বপ্নলোকের চাবি

বেলাল বেগ


মানুষ স্বপ্ন দেখে। ঘুমিয়ে গেলেও তার মস্তিষ্কের ১০০ বিলিয়ন নিউরন জেগে থাকে। ফেলে আসা সব সময়ের সঙ্গে, বর্তমান জীবনের প্রতি মুহূর্তের অভিজ্ঞতার হিসাব মেলাতেই থাকে। সেটিই মানুষের স্মৃতি ও স্বপ্নাকারে প্রকাশ পায়। মানবসভ্যতায় গত দশ হাজার বছরে জন্ম নেওয়া, একশজন শ্রেষ্ঠ কবির একজন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

বাঙালি জাতি তথা বিশ্বমানুষের স্বপ্নলোকের অন্যতম স্বাপ্নিক কবি, মৃত্যুতাড়িত মানুষের জন্য স্থায়ী আনন্দময় স্বপ্নময় আবাস কল্পনা করে রেখেছিলেন। কিন্তু তার অভ্যন্তরে প্রবেশের চাবি খুঁজে পাচ্ছিলেন না। ফলে জাগ্রত সময়েও স্বপ্নে তিনি সেই চাবি অনবরত খুঁজে বেড়িয়েছেন। আমরা সাধারণ মানুষও, একই ভাবে স্বপ্ন দেখি। কিন্তু আমাদের ক্ষমতা ও সাহস কম বলে, আমরা স্বপ্নলোকের চাবি খুঁজে পাই না।

আমার স্বপ্নলোকের জন্ম হয়েছিল, চট্টগ্রামে বিখ্যাত এমই স্কুলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ার সময়। আমার নামের ছন্দমিলের বিখ্যাত ব্যক্তি, ‘দিলাল’ ছিলেন সন্দ্বীপের রাজা। সন্দ্বীপ রাজ্য তখন বিশ্বে লবণ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। জাহাজ নির্মাণ ছাড়াও সন্দ্বীপবাসীর সম্পদ বৃদ্ধির বহু উপায় ছিল। তাই ধনাঢ্য জনপদ হিসেবে সন্দ্বীপের খ্যাতি, পৃথিবীর পূর্ব-পশ্চিম পর্যন্ত বিস্তৃত। মগ ও পর্তুগিজ দস্যুদের ঘন ঘন আক্রমণ তখন ঠেকাতেন ওই দিলাল রাজা ও তার বাহিনী।

একবার ব্রহ্মদেশের মগ দস্যুদের বিরাট বাহিনীকে পরাজিত ও বন্দি করে তাদের সব রণতরী সমুদ্রে ডুবিয়ে দেন। পরবর্তী সময়ে বন্দিদের একটি স্থানে জড়ো করে তাদের পলায়নের সব পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিলেন। আমার নানার বাড়ির অদূরের ওই স্থানটিই এখন ‘মগধরা’ নামে সন্দ্বীপ ও বাংলাদেশের ইতিহাসে বিখ্যাত।

মগদের বারবার আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে, দিলাল রাজা এক অচিন্তনীয় পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। একবার তার গোয়েন্দারা মগদের এক বিরাট বাহিনীর অভিযানের অগ্রিম খবর রাজাকে জানান। এরপর সেই রাজা শত্রুদের আক্রমণের সবচেয়ে সম্ভাব্য পথ বরাবর, সন্দ্বীপ উপকূলে একটি উঁচু বাঁধ নির্মাণের আদেশ দেন। বাঁধ নির্মাণ শেষ হওয়ার পর, কয়েকশ মোটা আকারের কলাগাছ কাটা হয়।

পাতাসহ সেই কলাগাছের মাথা ফেলে দিয়ে এবং গোড়ার অংশটি ছেঁটে, সেগুলোকে কালো রং করে কামান সদৃশ করে ফেলার আদেশ দেন। সেই নকল কামানগুলো, আসল কামানের মতো বাঁধের ওপর সাজানো হয়। এরপর ছিল অপেক্ষার পালা।

দীর্ঘক্ষণ পর কাক্সিক্ষত দৃশ্যগুলো অবির্ভূত হতে থাকল। দিকবলয়ে কালো রেখার মতো মগ দস্যুদের নৌবহরগুলো এগোতে থাকে। ক্রমেই স্পষ্ট হতে থাকে, তার বিশালত্ব ও ভয়ংকরতা। এক সময় প্রত্যাশিতভাবেই থেমে গেল নৌবহরটি। স্তব্ধ আকাশতলের মৃদু সমুদ্রগর্জনের মধ্যে যেন সময় থেমে আছে। ভয় পেয়ে যায় মগদস্যুরা। অকস্মাৎ দেখা গেল, সেই ভীতিজাগানো যুদ্ধযানগুলোর সম্মুখ সারির যানগুলোও উল্টো দিকে মূল বাহিনীর শেষ সারি হয়ে ফিরে যাচ্ছে!

দিলাল রাজার ওই কল্পনাশক্তিকে হারাতে চেয়েছিল বালক বেলাল ১৯৫০ সালে চট্টগ্রামের চন্দনপুরায় গুলজার বেগম স্কুল ও সিরাজদ্দৌলা রোডের পাশের একতলা দালানের দক্ষিণ দিকের জানালার কাছে বসে। কল্পলোকের চাবি এই বয়সেও হারাইনি। কারণ ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই সন্দ্বীপ থেকেই বাঙালির মুক্তির সনদ ৬ দফার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচারণা শুরু করেন। যে কারণে এখনো স্বপ্ন দেখি।

বাঙালি অনেক অত্যাচার সহ্য করেছে। এই জাতির ওপর হাজার হাজার বছর নির্যাতন হয়েছে। কিন্তু পরিণতিতে, সেই বাঙালিই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা স্বাধীন হয়েছে। এখন বিশ্ব মানচিত্রে মাথা উঁচু করে বলতে পারে আমরা স্বাধীন।

আমাদের নিজস্ব একটা ভাষা আছে। একটা দেশ আছে যার সঙ্গে মিশে রয়েছে হাজার বছরের সংস্কৃতি। এত সহজে এই বাঙালির কাছ থেকে, স্বপ্নলোকের চাবি কেড়ে নেওয়া যাবে না। যে যতই হুঙ্কার দিক, লাভ নেই।

বাংলার জয়, সুনিশ্চিত। মনে রাখতে হবে, বাঙালি কখনো হারে নাই হারবেও না।

লেখক: টেলিভিশন ব্যক্তিত্ব, সাংবাদিক ও কলাম লেখক

দৈনিক দেশ রূপান্তরের সৌজন্যে

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension