নির্বাচিত কলামমুক্তমত

অস্থিরতা না পরিকল্পিত অরাজকতা?

রাজেকুজ্জামান রতন


কিছুদিন ধরে যা ঘটছে তাতে অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া, অভ্যুত্থানে আশাবাদী হয়ে ওঠা মানুষদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তাদের অনুচ্চারিত প্রশ্নকে ভাষায় রূপ দিলে শোনা যাবে তারা বলছেন, হচ্ছেটা কী দেশে? ফ্যাসিবাদের হাত থেকে মানুষ মুক্তি চেয়েছে। পুরনো অধ্যায় শেষ করে নতুনের পথে যাত্রা করার জন্যই তো মানুষ পরিবর্তন চায়। পুরনো পরিত্যক্ত হয়েছে কিন্তু নতুন এখনো গড়ে ওঠেনি, স্থায়িত্ব পায়নি এমন সময়ে কিছুটা অনিশ্চয়তা এবং অস্থিরতা থাকতে পারে কিন্তু অভ্যুত্থানের পর অরাজকতা কারোই কাম্য নয়। এতে অভ্যুত্থানের আসল উদ্দেশ্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়, লক্ষ্য হারিয়ে যায়। কয়েকটি ক্ষেত্রে যা ঘটেছে তা কোনোভাবেই উপেক্ষা করা যাবে না। বিচারালয় সব নাগরিকের শেষ আশ্রয়। যেখানে ন্যায়বিচারের স্বার্থে অভিযুক্ত, অপরাধী, অন্যায়কারীকে যেমন উপস্থিত হতে হয়, তেমনি বিচারপ্রার্থীও উপস্থিত থাকেন। অন্যায়কারী এবং অন্যায়ের শিকার দুজন এক জায়গায় উপস্থিত হলে উত্তেজনা তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু যখন মানুষ বিচারপ্রার্থী হয় তখন ব্যক্তিগত উত্তেজনার পরিবর্তে আইনের ব্যাখ্যা করে অপরাধের মাত্রা ও শাস্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা হয়। রায় ঘোষণার আগে বিচারালয়ে সবার নিরাপত্তা পাওয়ার অধিকার গণতান্ত্রিক ও নৈতিকভাবে স্বীকৃত। এটা না থাকলে তো বিচারের আগেই রায় হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা ন্যায়বিচারের পরিপন্থি। সাধারণ মানুষের মধ্যে উত্তেজনা থাকলেও আদালতের পরিবেশ রক্ষায় আইনজীবীদের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু কিছুদিন ধরে আইনজীবীদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। যা দৃষ্টান্ত হিসেবে খারাপ এবং ভবিষ্যতের জন্য প্রশ্ন ও পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা তৈরি করবে। নিম্ন আদালতে অভিযুক্তদের ওপর হামলা, জুতা নিক্ষেপের ঘটনা ঘটেছে, তা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। কিন্তু উচ্চ আদালতে এ ধরনের ঘটনা বিচারালয়ের সংস্কৃতি নিয়ে উদ্বেগের জন্ম দেয়। যেমন গত ২৭ নভেম্বর ষোড়শ সংশোধনীর রায়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে নিয়ে ‘আপত্তিকর’ মন্তব্যের অভিযোগে হাইকোর্ট বিভাগের একটি দ্বৈত বেঞ্চের নেতৃত্বদানকারী বিচারপতিকে বেঞ্চ থেকে নেমে যেতে বলেন একদল আইনজীবী। তখন দুই বিচারপতি বেঞ্চ থেকে নেমে যান। এ সময় তাদের প্রতি ডিম নিক্ষেপের মতো ঘটনা ঘটে।

আগে যাই ঘটে থাকুক, এবারে ঘটনাটিকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করেছে সুপ্রিম কোর্ট। এক বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গত ২৭ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যে নজিরবিহীন অনভিপ্রেত ঘটনাবলি সংঘটিত হয়েছে এবং একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণসহ দেশের জেলা আদালতগুলোতে সাম্প্রতিক সময়ে যেসব অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, সেসব বিষয় সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশের প্রধান বিচারপতি। সুপ্রিম কোর্টের গণসংযোগ কর্মকর্তার স্বাক্ষরিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের আদালতগুলো যাতে বিচারপ্রার্থীদের নির্বিঘ্নে বিচার সেবা দিতে পারে, সে লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট সামগ্রিক বিষয়াবলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। সব প্রতিকূলতা ও অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি সত্ত্বেও দেশের আদালতগুলোতে বিচারসেবা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। প্রধান বিচারপতি দেশের আদালতগুলোতে এ ধরনের পরিস্থিতির পুনরাবৃত্তি রোধ করতে ইতিমধ্যে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। এই বিবৃতি এবং পদক্ষেপ নিশ্চয়ই পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাবে এমনটা মানুষ প্রত্যাশা করে। অন্যদিকে দেখা যাচ্ছে, দেশের বিভিন্ন স্থানের তুলনায় রাজধানীতেই প্রায় প্রতিদিনই কোনো না কোন ইস্যুতে বিশৃঙ্খলা, সংঘাত ও সহিংসতা ঘটছে। কলেজের ছাত্ররা জড়িয়ে পড়ছে সংঘাত ও সংঘর্ষে। বিভিন্ন কলেজের ছাত্রদের মধ্যে সংঘর্ষে পুরান ঢাকা ও যাত্রাবাড়ী পরিণত হয়েছিল রণক্ষেত্রে। এ সময় অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছিল লক্ষ্মীবাজার ও জনসন রোডসহ পুরান ঢাকার বড় এলাকা। সংঘর্ষের কারণে দীর্ঘ সময় বন্ধ ছিল ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের ডেমরা অংশ। হামলা-পাল্টাহামলার শিকার হয় বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও একটি হাসপাতাল। শুধু হামলা নয়, লুটপাটের কারণে তিনটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। সেখানে এখন শিক্ষা কার্যক্রম চলার উপায় নেই। আতঙ্কিত অভিভাবকরা ভাবছেন, শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো উন্মত্ত হয়ে উঠছে কেন? তেজগাঁওয়ের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব টেক্সটাইলের শিক্ষার্থীরাও সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। ছাত্র এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে সংঘর্ষের প্রতিটি ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, কারণ খুব বড় নয় কিন্তু সংঘাতের ব্যাপকতা ভয়াবহ। আর যে বিষয়টি উদ্বেগের তা হলো, এই কদিন আগে যে ছাত্ররা ঐক্যবদ্ধ হয়ে এত বড় আন্দোলনের জন্ম দিল, জীবন ও রক্ত দিয়ে সাফল্য ছিনিয়ে আনল তারা কেন এ ধরনের সংঘাতে জড়িয়ে পড়ছে?

আরেকটি বিষয় দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সবার। তা হলো, দেশের দুটি পরিচিত পত্রিকা নিয়ে অভিনব প্রতিক্রিয়া। পত্রিকার প্রতি মানুষের প্রত্যাশা থাকে, সাংবাদিকদের দায়িত্ব থাকে, আর থাকে পত্রিকা পরিচালনা নীতি। আবার পত্রিকার এক ধরনের পাঠক গোষ্ঠী থাকে, তারা তাদের পছন্দের খবর পেতে চান পত্রিকায়। এ নিয়ে বিতর্ক, সমালোচনা থাকে। কিন্তু ডেইলি স্টার আর প্রথম আলো কার্যালয়ের যা করা হলো, তাও কি গ্রহণযোগ্য? গায়ের জোর তো পত্রিকার বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার কথা না। অফিসের সামনে নামাজ পড়া কিংবা গরু জবাই করে জেয়াফত খাওয়ানো, জমায়েত হয়ে বিক্ষোভ এবং হামলা প্রচেষ্টা কোনোটাই তো ভালো দৃষ্টান্ত হলো না। এটা কারও কারও কাছে হাস্যকর মনে হলেও, সামগ্রিকভাবে সংবাদপত্রের জন্য অশনি সংকেতের মতো। কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যার পরিণতিতে তৈরি হচ্ছে উত্তেজনা। হঠাৎ করে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধের ঘোষণা কোনোভাবেই বিবেচনাপ্রসূত ছিল না। এর সঙ্গে শুধু লাখ লাখ চালকের জীবিকার প্রশ্নই জড়িত নয়, ঢাকা মহানগরের যোগাযোগব্যবস্থাও জড়িত। নাগরিকরা চলাফেরা করবেন কীভাবে সে কথাও ভাবা হয়নি, এই সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষেত্রে। ফলে জীবিকা হারানোর আশঙ্কায় লাখ লাখ ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক নেমে এলো রাস্তায়। ঢাকার প্রেসক্লাব, মোহাম্মদপুর, যাত্রাবাড়ী, রামপুরা, মহাখালী ও ধানম-ি এলাকা অবরুদ্ধ ছিল ব্যাটারিচালিত রিকশা চালকদের আন্দোলনে। শ্রমিক অসন্তোষের কারণে কয়েক ঘণ্টার জন্য বন্ধ ছিল ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়ক। এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে এবং ব্যাপক রূপ নেওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর অন্তর্নিহিত কারণ না খুঁজে শুধু দমন-পীড়ন চালালে ফল ভালো হবে না। কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকলে, মানুষ নিজের মতো করে কাজ খুঁজে নেয়। সংসার চালানোর চিন্তা, মাথায় ঋণের বোঝা আর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ একজন তরুণ যুবককে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। তখন তাদের নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন, সে কথা বিবেচনায় রেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।

এসবের মধ্যে ঘটেছে আরেক নতুন ধরনের ঘটনা। শাহবাগে ‘অহিংস গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ’ নামের সংগঠনের উদ্যোগে লোক জমায়েতের চেষ্টা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ এসেছে এই কথা শুনে যে, তারা রাষ্ট্রের কাছে ঋণ পাবে। এসব ঋণ প্রত্যাশী দরিদ্র, নিরীহ মানুষ ঢাকায় এসে নিজেরা বিপদে পড়েছে আর তৈরি হয়েছে বিশৃঙ্খলা। দেশে বর্তমানে যেসব ঘটনা ঘটছে, তাতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠতেই পারে। আন্দোলন সম্পর্কে তাদের কাছ থেকে আগাম তথ্য পাওয়া গেলে আগেভাগেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব। শাহবাগে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনকে প্রলোভন দেখিয়ে যেভাবে ঢাকায় নিয়ে আসা সম্ভব হলো, সেই ঘটনাটিও গোয়েন্দা তথ্যের ঘাটতির বিষয়টি নিশ্চিত করে। বাস ভাড়া করে দূর থেকে এত মানুষ ঢাকায় এলো আর কারও নজরেই পড়ল না, তা কি বিশ্বাসযোগ্য? গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী পরিস্থিতিতে মানুষের আকাক্সক্ষা যেমন বেড়েছে, তেমনি বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী ও অশুভ শক্তি নিজের স্বার্থ হাসিলে মাঠে তৎপর রয়েছে। এসব বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু সবকিছুকে ঢালাওভাবে ‘ষড়যন্ত্র’ আখ্যা দিয়ে কাউকে প্রতিপক্ষ বানানো যাবে, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা যাবে, কিন্তু সমস্যার সমাধান হবে না। মানুষের জীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলোকে বিবেচনায় না নিলে সংকট নানা রূপেই দেখা দেবে।

বেশ কিছুদিন ধরে সনাতন ধর্মের মানুষেরা তাদের ওপর নিপীড়নের প্রতিবাদ করে বড় বড় জমায়েত করে আসছিলেন। এর প্রভাব দেশে এবং আন্তর্জাতিক মহলে কী হতে পারে তা বিবেচনায় নেওয়া উচিত ছিল। সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তার ও আদালতে হাজির করা হলে, সম্ভাব্য কী ঘটতে পারে তা না ভেবে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত না করে ব্রহ্মচারীকে কেন আদালতে হাজির করা হলো? এ প্রশ্ন উঠছে। পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে আইনজীবী হত্যার ঘটনার পর আরও সংঘাত ও সহিংসতার যে আশঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছিল তা সব স্তরের জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এড়ানো গেছে। এটা যেমন স্বস্তির ঠিক তেমনি মানুষের শুভবুদ্ধিই আমাদের ভরসার জায়গা। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ধরনের উসকানি মোকাবিলা করেই জনগণ দেশের শান্তি বজায় রাখতে চান এটা আবারও প্রমাণিত হলো। যে কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িক উন্মাদনা শুধু বাংলাদেশে নয়, এই উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে, জনগণের গণতান্ত্রিক চেতনা ধ্বংস করে এটা ভুলে যাওয়া যাবে না। ছাত্র-শ্রমিক-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ১১৫ দিন পার হলো। দ্রব্যমূল্য, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ জনজীবনের সংকট তো আছেই, এর পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, পুলিশ, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসন, দুর্নীতি দমন, স্বাস্থ্য, গণমাধ্যম, শ্রমিক অধিকার, নারীবিষয়ক এবং স্থানীয় সরকার সংস্কারে কমিশন গঠন করা হয়েছে। কমিশন গঠনের ৯০ দিনের মধ্যে, অর্থাৎ ডিসেম্বরের শেষ বা জানুয়ারির প্রথম দিকে অধিকাংশ কমিশনের প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা। এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে বিতর্ক হবে। কিন্তু সংস্কার প্রস্তাব অনুযায়ী আইন তৈরি করা, অন্তর্বর্তী সরকারকে আইনি বৈধতা দিতে পারে সংসদ। ফলে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের কোনো বিকল্প নেই এবং সময়ক্ষেপণের কোনো সুযোগ থাকতে পারে না। একটি গণতান্ত্রিক সমাজের প্রত্যাশা যেন অস্থিরতা ও অরাজকতার কারণে মার না খায়, সেই বিষয়ে সচেতন থাকা দরকার।

লেখক: রাজনৈতিক সংগঠক ও কলাম লেখক

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension