মুক্তমত

অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কারও ক্ষতি, কারও লাভ

ড. আর এম দেবনাথ

তিন-চার মাস পর একটা দারুণ খবর পেলাম। রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেশ বেড়েছে। সেপ্টেম্বরে রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ১ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন ডলার। এটা ছিল একটা আতঙ্কের খবর, বিশেষ করে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পতনের মুখে। যা হোক, খুবই আশাপ্রদ খবরটি পড়ে শেষ করতে পারিনি, আরেকটি খবরে মাথাটা ঘুরে গেল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমান বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া স্থগিত করে দিয়েছে। ওমান আমাদের প্রবাস আয়ের একটা অন্যতম ভালো উৎস। সেদেশে ৪-৫ লাখ বাংলাদেশি ‘ওয়েজ আর্নার’ আছে। ২০২১-২২ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে ওমান ছিল আমাদের প্রবাস আয়ের নবম বৃহত্তম উৎস। ২০২১-২২ অর্থবছরে ওমান থেকে প্রবাস আয় আসে ৮৯ কোটি ডলার। এমন একটা উৎসের ‘ভিসা’ দেওয়া বন্ধ-এটা কোনোভাবেই ভালো খবর নয়। বলা হচ্ছে, ভিসার অপব্যবহারের কারণে ওমান এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে, ওমানের এ সিদ্ধান্ত আমাদের প্রবাসী আয়ে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলবে। অথচ প্রবাসী আয় আমাদের ভীষণ দরকার।

প্রবাসী আয়ের পরই আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের আরেকটি উৎস তৈরি পোশাক রপ্তানি। আরএমজি আমাদের কাছে ‘সোনার হাঁস’। অথচ চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যেই তৈরি পোশাক খাতেও বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে। খবরে দেখা যাচ্ছে, ২০০ তৈরি পোশাক কারখানা মালিকরা বন্ধ করে দিয়েছেন। গাজীপুর, সাভার ও মিরপুরের ২০০ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এর কারণ মজুরি বৃদ্ধির সমস্যা। তৈরি পোশাক খাতের শ্রমিকরা তাদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি চান। মালিকরা দিতে চান, তবে খুবই কম। এটা চিরাচরিত মালিক-শ্রমিক সমস্যা। পোশাকশিল্পের সমস্যাটা এমন সময়ে হচ্ছে, যখন পাঁচদিন যাবৎ দেশে অস্বাভাবিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি চলছে। তিনদিন অর্থাৎ মঙ্গল, বুধ ও বৃহস্পতিবার বিরোধী দলের ‘অবরোধ’ কর্মসূচি পালিত হওয়ার পর আবারও ৪৮ ঘণ্টার একই কর্মসূচি দেওয়া হয়েছে। ইস্যু আগামী নির্বাচন। মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক এ অস্থিরতা সহসা যাওয়ার মতো নয়। সামনে নির্বাচনের দুই-আড়াই মাস রয়েছে। এ সময় যদি এ অস্থিরতা চলে তাহলে এর ‘নতিজা’ কী হবে?

আমরা আমদানিনির্ভর দেশ। কাঁচামাল, মধ্যবর্তী পণ্য, শিল্পপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি, ভোগ্যপণ্য আমাদের আমদানি করতে হয়। শুধু এসব নয়, এমনকি পেঁয়াজ, রসুন, চাল, চিনি, লবণ আমদানি করতে হয়। ডিম, আলু, কাঁচামরিচ সবই আছে আমদানির তালিকায়। এ আমদানি ব্যবসা বিঘ্নিত হলে, রপ্তানি ব্যবসা বিঘ্নিত হলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে? আগামী দিনের কথা বাদ দিই। বিগত ৯ মাসের অবস্থা কী তা দেখা যাক। একটি খবরে বলা হয়েছে, ‘চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে কমেছে কার্গো ও কনটেইনার হ্যান্ডলিং। কমেছে আন্তর্জাতিক জাহাজ আসার সংখ্যাও, যার প্রভাব পড়েছে বন্দরের পরিচালন কার্যক্রমে।’ বলাই বাহুল্য, এর ফলে শিল্প মালিকদের মধ্যে উদ্বেগ ও শঙ্কার সৃষ্টি হয়েছে। এটা হচ্ছে ‘সাপ্লাই চেইন সংকট’, যা আমাদের জীবনকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে।

আগামী দিনের কথা বাদ দিই। রোববার থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অস্বাভাবিক সময়ে কার লাভ হলো, কার ক্ষতি হলো। বিষয়টি বোঝানোর জন্য একটা উদাহরণ দিই। আমি অবরোধের মধ্যেও রিকশা দিয়ে এখানে-ওখানে গিয়েছি। আমার লাভ হয়েছে একটি-রিকশাভাড়া কম লেগেছে। ৫০ টাকার জায়গায় ৪০ টাকা। কারণ রিকশার সরবরাহ বেশি, প্যাসেঞ্জার কম। এতে ক্ষতি হলো কার? ক্ষতি হলো শ্রমজীবী রিকশাওয়ালার। তার দৈনিক আয় অন্তত পাঁচদিন কম ছিল। বস্তুত পাঁচদিন নয়, বেশ কিছুদিন যাবতই রিকশাওয়ালাদের বাজারে মন্দা যাচ্ছে। বহু রিকশাওয়ালা, শ্রমজীবী মানুষ ঢাকায় আসে উত্তরবঙ্গ থেকে। তাদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত। ঋণের কিস্তি দিতে হয় নিয়মিত। ঋণের কিস্তির টাকা জোগাড়ের জন্য অনেক শ্রমজীবী ঢাকায় আসেন। সমস্যা হচ্ছে, তারা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কিস্তি শোধে অপারগ হন, পড়েন ভোগান্তিতে। এছাড়া সংসার খরচের প্রশ্ন তো আছেই।

যে কথাটি বলছিলাম, অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে সবাই লাভবান হয় না, আবার সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। করোনা, যুদ্ধ-সংঘর্ষ, হরতাল-অবরোধে শ্রমজীবীরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত, আর একশ্রেণির লোক হয় উপকৃত। উদাহরণ দিই। বছর দুই আগে যে করোনা মহামারি গেল, তাতে সারা বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে। মানুষের দুঃখ-কষ্টের কোনো সীমা ছিল না। কিন্তু এরই মধ্যে টাকা বানিয়েছে একশ্রেণির ব্যবসায়ী। করোনার মধ্যে দেশি-বিদেশি ওষুধ কোম্পানিগুলো বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা-ডলারের ব্যবসা করেছে। নানা রকমের ফন্দিফিকির করে তারা লাভবান হয়েছে। ধরা যাক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কথা। এতে আমরা ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। মূল্যস্ফীতির কারণে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারছি না। কিন্তু এরই মধ্যে একশ্রেণির মানুষ/ব্যবসায়ী টাকা বানিয়ে নিয়েছে, এখনো নিচ্ছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে তেলের দাম বাড়ে, ডলারের দাম বাড়ে, আমাদের রিজার্ভ হ্রাস পায়। মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের উপরে ওঠে। কিন্তু এর ভেতরেই পেঁয়াজের ব্যবসায়ী, ডিম, আলু, সয়াবিনসহ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী, আমদানিকারক এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা চুটিয়ে ব্যবসা করে নিচ্ছে। তারা লাগামহীনভাবে মুনাফা করছে। রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে তারা এখন।

সামনে নির্বাচন। সরকার এখন বেশি কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারবে না। এ সুযোগে তারা যাচ্ছেতাই করে বেড়াচ্ছে। হরতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ, বাস-গাড়ি পোড়ানো ইত্যাদি ঘটনায় একশ্রেণির ব্যবসায়ী লাভবান হয়। অরাজকতায় তাদের লাভ। তারা খোঁজে অজুহাত। বাজেট হলে, বৃষ্টি হলে, খরা হলে তারা সুযোগ পায়। এসব অজুহাতে তারা জিনিসপত্রের দাম বাড়ায়। অথচ কাঁচাবাজারে গেলে পণ্যের স্তূপ দেখতে পাওয়া যায়। কোনো ঘাটতি নেই। মাছের বাজারেও তাই। কিন্তু বিক্রেতাদের অভিযোগ, পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম চড়া। প্রশ্ন, পুলিশ অথবা বিরোধীদলীয় লোকেরা কি কাঁচামাল পরিবহণে বাধা দেয়? নিশ্চয়ই না। তাহলে কেন এ অভিযোগ এবং কেনই বা মূল্যবৃদ্ধি? প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক অস্থিরতায় ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের। মধ্যবিত্তের, চাকরিজীবীদের। ব্যসায়ীদের সার্বিকভাবে ক্ষতি হয়-এটা স্বীকার্য। কিন্তু এরই মধ্যে একশ্রেণির ব্যবসায়ী আছে, যারা পরিস্থিতির পুরোপুরি সুযোগ নেন।

এসব ভালো-মন্দ খবরের মধ্যেই একটা উৎসাহব্যঞ্জক খবর পেলাম। বুধবার আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তিনটি যৌথ প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন। এগুলো হচ্ছে : আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ, খুলনা-মোংলা বন্দর রেল সংযোগ এবং মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের দ্বিতীয় ইউনিট। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘তিনটি উন্নয়ন প্রকল্পের যৌথ উদ্বোধন বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক সহযোগিতার প্রমাণ দিয়েছে এবং ভবিষ্যতে বিদ্যমান সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।’ এদিকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, ‘এটি আনন্দের বিষয় যে, আমরা আবার ভারত-বাংলাদেশ পারস্পরিক সহযোগিতা উদযাপন করতে একত্রিত হয়েছি। আমাদের সম্পর্ক আপাতদৃষ্টিতে নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে।’ শুধু এ তিনটি প্রকল্প নয়, বিগত ৯-১০ বছরে বাংলাদেশ-ভারত অনেক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে ‘কানেকটিভিটি’ অন্যতম। এতে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেড়েছে।

এ ডামাডোলের মধ্যেই ভালো খবর একটি পাওয়া গেছে। শীত আসছে। শীতকালে প্রসাধনসামগ্রীর বেচাকেনা বাড়ে। ক্রিম ও লোশনজাতীয় প্রসাধনসামগ্রীর চাহিদা বাড়ছে বলে খবরে প্রকাশ। প্রসাধনসামগ্রীর মধ্যে দেশি ও বিদেশি উভয় ব্র্যান্ডের সামগ্রী রয়েছে। তবে উচ্চবিত্তরা বিদেশি প্রসাধনসামগ্রীর দিকেই নজর দেয় বেশি। ভালো খবরের মধ্যে আবার একটি খারাপ খবর দেই। সেপ্টেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ হ্রাস পেয়েছে। এ মর্মে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহের পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৬৯ শতাংশ। অথচ আগস্টে এর পরিমাণ ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ বস্তুত ২০২২ সালের জুলাই থেকেই হ্রাস পাচ্ছে। এর কারণ অনেক। প্রথমত, ব্যাংকের তারল্য সংকট। বাণিজ্যিক ব্যাংগুলো বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সমানে ডলার কিনছে আমদানি বিল পরিশোধ করার জন্য। এতে তাদের প্রচুর ঋণ বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে যাচ্ছে। ঋণ দেওয়ার মতো ক্ষমতা সংকুচিত হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সরকারও ইদানীং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে নিচ্ছে। এতে সরকারি ব্যাংকের ঝুঁকি কমে। ‘শ্রেণি-বিন্যাসের’ সমস্যা নেই। এ কারণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সরকারকেই ঋণ দিতে পছন্দ করে বেশি। সর্বোপরি রয়েছে ব্যবসায়িক মন্দা পরিস্থিতি। ডলারের অভাব রয়েছে। ডলারের মূল্য বেশ উঁচুতে। অর্থনৈতিক অস্থিরতার সঙ্গে সঙ্গে আসছে রাজনৈতিক অস্থিরতা। ব্যবসায়ী-শিল্পপতি সবাই টাকা ধার করে আছেন। কোনো বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন না। সবারই অপেক্ষা আগামী নির্বাচনের জন্য। নির্বাচনের ফলাফল না দেখে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবেন না বলে মনে হয়। এমনকি ফ্ল্যাট কেনার ক্ষেত্রেও তা-ই দেখা যাচ্ছে। এদিকে অর্থনৈতিক-ব্যবসায়িক মন্দা সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমজীবী মানুষ, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত। তারা সাবই ‘ভোগ’ কমিয়ে দিয়েছে। এদিকে সরকারি ব্যয়েও টান পড়েছে। ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস যায় যায়। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে সরকারি ব্যয়ে এখনো কোনো গতি আসেনি। ভোগব্যয় কম, সরকারি ব্যয়ও কম। বিনিয়োগে মন্থরগতি। তাই প্রশ্ন, ৬ থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি কোত্থেকে আসবে? এমন নয় যে-ব্যয়, বিনিয়োগ বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সরকারের রাজস্ব আদায়েও ধীরগতি। কারণ আমদানি-রপ্তানি কম। রাজস্ব বৃদ্ধি না পেলে সরকারি ব্যয়ের পরিমাণ বাড়বে কীভাবে? সবচেয়ে বড় কথা, রাজনৈতিক অস্থিরতা। যদি সরকার এ অস্থিরতার একটা সমাধান বের করতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আমাদের কপালে আরও দুর্ভোগ আছে, যা বলাই বাহুল্য।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক; সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension