নির্বাচিত কলামবাংলাদেশমুক্তমত

আন্তর্জাতিকতার আগে প্রয়োজন জাতীয় ঐক্য

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


আমরা কোন সংস্কৃতি চাই? আমরা কার পক্ষে? নাকি আমরা নিরপেক্ষ? নিরপেক্ষ তো ধূর্ত, কপট, মিথ্যুক, প্রবঞ্চক, চালবাজ, সুবিধাবাদী, মোনাফেক, মক্কর। আমরা তাহলে কোন সংস্কৃতির প্রতিনিধি– জালেমের, না মজলুমের?

এখানে নৈতিক বিচারটিও এসে গেছে। এই বিচারক্ষমতা হচ্ছে সেই প্রাথমিক গুণ, যা ব্যক্তিকে যোদ্ধা হবার জন্য উৎসাহিত করে এবং যোদ্ধার জন্য অত্যাবশ্যকীয় অপর গুণ যে আত্মসম্মান জ্ঞান, সেটাকে পুষ্ট করে তোলে। ড. আহমদ শরীফ লিখেছেন, যারা ধর্ম ও বিজ্ঞানের, যুক্তি ও বিশ্বাসের সমন্বয় চান, তারা চাঁদ-সূর্যের অন্বয়রূপে উপস্থিতিই কামনা করেন। পরস্পর বিপরীত সত্যে আস্থা স্থাপন কেবল যে চরিত্রহীনতার পরিচায়ক, তা নয়; কোনো সত্যকেই গ্রহণ না-করার নামান্তর মাত্র।

এই সমন্বয় পন্থা যে বিপজ্জনকও বটে, তা প্রকাশ করেছেন একটি বাস্তবসম্মত উপমা দিয়ে। বলছেন, ‘বহতা নদীতে দুকূল রক্ষা করা যায় না, এবং দুই নৌকায় পা রাখাও বিপৎসংকুল।’
বৈজ্ঞানিকতার সঙ্গে আধুনিকতার অপর উপাদানটি হচ্ছে আন্তর্জাতিকতা। বর্তমানে আমরা বিশ্বায়নের দাপটের নিচে বসবাস করছি; বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিকতা কিন্তু এক বস্তু নয়, দুইয়ের মধ্যকার ব্যবধান একেবারেই মৌলিক। বিশ্বায়ন হচ্ছে বাণিজ্যের, আন্তর্জাতিকতা হলো মৈত্রীর। বিশ্বায়ন পুঁজিবাদের আগ্রাসী রূপের একটি নতুন নাম; সে চায় বাজার দখল করবে; লগ্নি করবে পুঁজি; ঋণ দিয়ে সুদ আদায় করবে; তৈরি করবে ক্রেতা ও সেবক। বিশ্বজুড়ে ভোগবাদিতার একটি মানদণ্ড তৈরি করে দেবে, যা অর্জন করতে গিয়ে ব্যক্তিমানুষের মেরুদণ্ডের ওপর চাপ পড়বে। এর বিপরীতে আন্তর্জাতিকতার কাজটা হচ্ছে বিশ্বের মানুষকে সহমর্মিতা ও সহযোগিতার মানববন্ধনের ভেতর দিয়ে কাছাকাছি নিয়ে আসা; বিপদ-আপদে পরস্পরকে সাহায্য করা; আদান-প্রদান করা ইতিহাসের অভিজ্ঞতা; বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় যে পৃথিবী ছোট ও খাটো হয়ে আসছে তাকে তার দুর্দশার গ্রাস থেকে বাঁচানো। এক কথায় বলতে গেলে আন্তর্জাতিকতা হচ্ছে বিশ্বায়নের প্রতিপক্ষ। আন্তর্জাতিকতা ওই দৈত্যকে রুখবে; অগ্রসর হতে দেবে বিজ্ঞানকে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আন্তর্জাতিকতা হচ্ছে গণতন্ত্র অভিসারী; যে গণতন্ত্র পুঁজিবাদের অধীনে মোটেই নয়; প্রতিষ্ঠা সম্ভব শুধু সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাতেই। সমাজতন্ত্র আধিপত্য চাইবে না, মানুষকে বাজারে ঠেলে দেবে না; সর্বোপরি অবসান ঘটাবে শোষণমূলক বৈরিতার।

লক্ষ্য করবার বিষয়, বৈজ্ঞানিকতার বিকাশে খোলা আকাশের চেয়েও খোলা সমুদ্রের ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকর; তাই দেখি বিজ্ঞানে যারা এগিয়েছে সেসব জনগোষ্ঠী সমুদ্রকে ব্যবহার করবার সুযোগ পেয়েছে। বাঙালির দুর্ভাগ্য যে তার বসতভূমির একদিকে সমুদ্র থাকলেও, সেই সমুদ্র তার জন্য খোলা ছিল না; সমুদ্র ছিল বহির্দেশীয় বণিক ও দস্যুদের নিয়ন্ত্রণে। সীমানার অন্য দুই দিকে পাহাড়-পর্বত দিয়ে আবদ্ধ, যেদিকটা খোলা সেদিক থেকে বিজয়ীরা এসেছে; ইংরেজরা অবশ্য এসেছে সমুদ্রপথে, কিন্তু সমুদ্র খুলে দেয়নি, আটকে রেখে বাংলাকে যুক্ত করে দিয়েছে ভারতবর্ষের সঙ্গে। মোট কথা, বাংলা একাধারে পরাধীন ও আবদ্ধ থেকেছে; যে-দশাটা সামন্তবাদী বিচ্ছিন্নতা ও অন্ধকারাচ্ছন্নতা উভয়কেই পুষ্ট করেছে। পীড়িত মানুষ ধর্মের কাছে গেছে, আশ্রয়ের খোঁজে এবং আত্মপরিচয়ের অভিমানে।

পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের প্রতিও প্রবল ধিক্কার, গভীর ঘৃণা থাকা আবশ্যক। পুঁজিবাদ এমন ব্যাপ্ত যে তার বিরুদ্ধে লড়বার পথটা সহজ নয়। একটা পথ ছিল প্রত্যাখ্যানের। যে-কাজটা লালন ফকির ও তাঁর বাউল সম্প্রদায়ের লোকেরা করেছিলেন তাদের নিজেদের মতো। আহমদ শরীফ লিখেছেন, ‘ভেদবুদ্ধিহীন মানবতার উদার পরিসরে সাম্য ও প্রেমের সুউচ্চ মিনারে বসেই বাউলেরা সাধনা করে। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সাধকের ও দার্শনিকের সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তারা সাম্য ও মানবতার বাণী প্রচার করে।’ এটা খুবই সত্য। পুঁজিবাদের বৈষম্য ও মানবতা-বিরোধিতাকে বাউলরা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা শ্রেণি মানেন না, বলেন– ‘কেমন ন্যায় বিচারক খোদা বল গো আমায়/ তাহলে ধনী-গরিব কেন এ ভুবনে রয়।/ ভালো-মন্দ সমান হলে/ আমরা কেন পড়ি তলে/ কেউ দালানকোঠার কোলে/ শুয়ে নিদ্রা যায়।

বাউলরা ইহজাগতিক, অসাম্প্রদায়িক এবং যদিও তারা ধর্মের ভাষা ব্যবহার করেছেন, তবু ধর্মনিরপেক্ষই। তারা বেরিয়ে এসেছেন বিদ্যমান সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদের বন্ধন থেকে। সেটা সামান্য ব্যাপার ছিল না। যেমন সামান্য নয় ইংরেজের রাজত্বকে প্রত্যাখ্যান করা। ওই রাষ্ট্রকে বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত কীভাবে দু’বাহু বাড়িয়ে গ্রহণ করেছে, সেটা আমরা দেখেছি। রামমোহন-বিদ্যাসাগরের ওই তথাকথিত রেনেসাঁসের কালে লালন ফকির উঠে দাঁড়িয়েছেন। ইংরেজ রাষ্ট্রের আধিপত্য তিনি ও তাঁর অনুসারীরা মেনে নেননি। উঠে দাঁড়াননি শুধু; রুখেও দাঁড়িয়েছেন। ফকির-সন্ন্যাসীদের ইংরেজবিরোধী যে-যুদ্ধকে বঙ্কিমচন্দ্র তাঁর উপন্যাস দুটিতে চিত্রিত করেছেন, তাতে বাউলরা ছিলেন; এবং বঙ্কিমের নায়কেরা যা করেছেন অর্থাৎ আত্মসমর্পণ ঘটানো, বাউলরা তা করতে সম্মত হননি। তারা রাষ্ট্রের শিক্ষা ও প্রশাসনকে প্রত্যাখ্যান অব্যাহত রেখেছেন। ইংরেজের চাপিয়ে দেওয়া মানদণ্ডকে তারা কখনও মেনে নেননি।

এই প্রত্যাখ্যানের আসল জোরটা অবশ্য ছিল ব্যক্তিগত সম্পত্তিকে গুরুত্ব না-দেওয়ার মধ্যে। লালন ফকির ও তাঁর অনুসারীরা কেবল প্রত্যাখ্যান করেছেন, তা নয়, গ্রহণও করেছেন। ওই গ্রহণের ভেতর আধুনিকতার উপাদান ছিল বৈ কি। ছিল তত্ত্বজ্ঞান ও জিজ্ঞাসা, বলা যায় বৈজ্ঞানিকতা। ইতিহাস ও পরিবেশ থেকে তারা কখনও বিচ্ছিন্ন হননি, বরঞ্চ সর্বদাই সংলগ্ন থেকেছেন। তারা ভাষা ও সুর নিয়েছেন চারপাশের জীবন থেকে, যেমন রবীন্দ্রনাথ বাউলদের সুর নিয়েছেন নিজের গান রচনায়; আমাদের জাতীয় সংগীত তো ওই সুরেই রচিত।

লালন ফকিরের বিষয়কে আমরা দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করছি। পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদকে তিনি ও তাঁর অনুসারীরা প্রত্যাখ্যান করেছেন ঠিকই, কিন্তু তাকে নিজেদের দেশে যে পরাভূত করবেন, এমনটা সম্ভব ছিল না। নিজে সরে এসেছেন, কিন্তু তাতে পুঁজিবাদ তো নিজেকে গুটিয়ে ফেলেনি। সে রয়েই গেছে। বরঞ্চ ক্রমাগত শক্তিশালী হয়েছে। এতই তার প্রতাপ-প্রভাব যে, ইংরেজ গেছে, পাকিস্তান গেছে; সমাজতন্ত্র কায়েম করবার স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, কিন্তু পুঁজিবাদ অবসানের লক্ষণ দেখা না গিয়ে বরঞ্চ তার বিক্রম বৃদ্ধির চিহ্নই দেখা যাচ্ছে। এমনকি লালন ও তাঁর সম্প্রদায়ের মানুষরাও উচ্ছেদ হয়ে যাবেন– এমন হুমকি এসেছে। এদের আশ্রয় কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়াতে উন্নয়নের অজুহাতে ব্যবসায় ও দখলদারিত্বের যে-তৎপরতা চলেছে তাকে একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করলে খুবই অন্যায় করা হবে। কেননা, সামনে যদিও ঠিকাদার ও দখলদারেরা রয়েছে, তবু পেছনে আছে বিশ্বায়নের সেই ভয়ংকর আদর্শ ও তাণ্ডব, যা পৃথিবীকে ছোট এবং খাটো করে চলেছে।
বাউলদের পুঁজিবাদ প্রত্যাখ্যান এবং ওই পুঁজিবাদের হাতেই নির্মূল হয়ে যাবার আশঙ্কা এই কথাটাই জানিয়ে দিচ্ছে, টিকে থাকবার জন্য বৈজ্ঞানিকতা পর্যাপ্ত নয়, আন্তর্জাতিকতাও প্রয়োজন, যে-আন্তর্জাতিকতা বাউলরা অর্জন করতে পারেননি; সম্ভব ছিল না অর্জন করা। কিন্তু মূল ব্যাপারটা হচ্ছে যুদ্ধ; ভিক্ষুক না-হলেই যে যুদ্ধে আছি– এটা সত্য নয়, যুদ্ধের ব্যাপারটা নেতিবাচক নয়, যুদ্ধ একটি ইতিবাচক কর্ম বটে। ওই যুদ্ধের একটি উপাদান আন্তর্জাতিকতা; কিন্তু আন্তর্জাতিকতা পরে আসবে, আগে প্রয়োজন স্থানীয় ঐক্য। ওই ঐক্যই হচ্ছে দাঁড়াবার জায়গা।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension