
সমকাল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকায় দুই সপ্তাহ ধরে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছেন ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বাধীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নেতারা। ‘অবৈধ’ দোকান, উদ্বাস্তু, ভবঘুরে ও নেশাগ্রস্তদের উচ্ছেদ করছেন তারা। এ সময় মারধর, হেনস্তা, ব্যক্তিগত গোপনীয় লঙ্ঘন করার অভিযোগও রয়েছে। সেসব নিয়ে শুরুর দিন থেকেই আলোচনা-সমালোচনা চলছে। মানবিক দিকের পাশাপাশি অভিযানের এখতিয়ার নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
শুরুতে ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক এবি জুয়ায়েরকে এতে নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। কয়েকদিন পর সক্রিয়ভাবে উচ্ছেদ অভিযানে দেখা যায় সদস্য সর্বমিত্র চাকমাকে। জুবায়েরকে আর সেভাবে দেখা যায়নি। বিতর্কের কেন্দ্রে চলে আসেন সর্বমিত্র। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার রাতে লাঠি হাতে এক বৃদ্ধকে শাসানোর ঘটনায় তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন তিনি।
ছাত্রশিবিরের নেতা-কর্মী-সমর্থক ও তাদের সামাজিক মাধ্যমের পেজগুলো থেকে সর্বমিত্র সমর্থন পাচ্ছেন। বিপরীতে বামপন্থি ছাত্র সংগঠনগুলো উচ্ছেদ অভিযান ও মানুষকে হয়রানি-হেনস্তার প্রতিবাদ জানিয়ে আসছে। সর্বমিত্রের সমালোচনা করছে। ডাকসুর ভিপি-জিএসকে অভিযানে দেখা যায়নি। তবে সামাজিক মাধ্যমে তারা অভিযানের পক্ষে সোচ্চার রয়েছেন।
গত ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু ও হল সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে ভিপি-জিএসসহ ২৮টি পদের অধিকাংশতেই জয়লাভ করে ছাত্রশিবিরের প্যানেল। হল সংসদেও নিরঙ্কুশ জয় পায়।
মঙ্গলবার রাতে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, সর্বমিত্র চাকমা লাঠি হাতে এক বৃদ্ধকে শাসাচ্ছেন। তাঁর হাতে ছিল একটি বস্তা ও ক্র্যাচ। তা নিয়ে সর্বমিত্রের সঙ্গে টানাটানি করছেন। এক পর্যায়ে সর্বমিত্র বস্তা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। সেখানে উপস্থিত প্রক্টরিয়াল টিমের একাধিক সদস্যকে উদ্দেশ করে সর্বমিত্রকে বলতে শোনা যায়, তিনি মিটিং করেই উচ্ছেদ করছেন এবং জিনিসগুলো সরিয়ে নিতে বলেন। এর পর প্রক্টরিয়াল টিমের একজন সদস্য সর্বমিত্রের হাত থেকে লাঠি নিয়ে বৃদ্ধের বস্তায় আঘাত করতে করতে সতর্ক করেন। এ সময় বৃদ্ধ আকুতি জানিয়ে বলেন, ‘আমি মইরা যামু বাপ।’ লাঠি হাতে নিয়ে সর্বমিত্র ওই বৃদ্ধকে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আর দেখব এখানে?’ জবাবে বৃদ্ধ বলেন, ‘না বাবা।’
এই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর কঠোর সমালোচনা শুরু হয়। এক পর্যায়ে ‘মাঠে না থাকা’র ঘোষণা দেন সর্বমিত্র।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ২৩ অক্টোবর সপ্তাহব্যাপী হকার, ভাসমান দোকান, রিকশা ও ভবঘুরে উচ্ছেদে ৯ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। উচ্ছেদ কমিটিতে ছিলেন– ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ, ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ) উপমহাব্যবস্থাপক (নিরাপত্তা) মেজর (অব.) মোহাম্মদ জাকির সিদ্দিকী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা (উপসচিব) মোহাম্মদ মোবাশ্বের হাসান, এমআরটি পুলিশের অতিরিক্ত সুপার মো. আবু আশরাফ সিদ্দিকী, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (সিনিয়র সহকারী সচিব) মো. আমিনুল ইসলাম, শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খালিদ মনসুর ও উপপরিদর্শক মনোজ প্রভাকর রায়, গ্রিন ফিউচার ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক খালিদ হোসেন এবং ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক যুবাইর বিন নেছারী (এবি যুবায়ের)।
এই কমিটি সপ্তাহব্যাপী অভিযান পরিচালনা করার কথা ছিল। এর মেয়াদ শেষ হয় ৩০ অক্টোবর। কমিটিতে ডাকসু সদস্য সর্বমিত্র চাকমার নাম নেই। কিন্তু উচ্ছেদ অভিযান সপ্তাহ শেষ হওয়ার পরও নিজ উদ্যোগে তিনি এ অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন।
সর্বমিত্র চাকমার বাড়ি রাঙামাটি সদর উপজেলায়। তিনি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; থাকেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে। গত ৯ সেপ্টেম্বর ডাকসু নির্বাচনে ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্যানেল থেকে সদস্য নির্বাচিত হন তিনি।
গত ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক যুবাইর বিন নেছারী ও সর্বমিত্র চাকমার নেতৃত্বে এবং প্রক্টরিয়াল টিমের সহায়তায় বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর থেকে শাহবাগ মোড় পর্যন্ত ভাসমান দোকান উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। অভিযোগ রয়েছে, অভিযানের সময় ডাকসু নেতা ও প্রক্টরিয়াল টিম ভাসমান দোকানদার ও ফুল বিক্রেতাদের ওপর শারীরিক হামলা ও দোকানপাট ভাঙচুর করে। এ ছাড়া ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া এক ভিডিওতে দেখা যায়, সর্বমিত্র দলবল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনের ভ্রাম্যমাণ দোকানগুলো উচ্ছেদ করছেন। এ ঘটনার পর আলোচনায় আসেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ম্যাজিস্ট্রেট ও পুলিশের উপস্থিতিতে ভাসমানদের উচ্ছেদে ডাকসুর দুই নেতার কর্মকাণ্ডের সমালোচনায় সোচ্চার হন নেটিজেনরা। শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষ এ উচ্ছেদ অভিযানকে স্বাগত জানালেও আরেকটি পক্ষ চাচ্ছে, এসব হকার ও ভবঘুরেকে পুনর্বাসনপূর্বক উচ্ছেদ করা হোক।
সর্বমিত্র চাকমা গত মঙ্গলবার ফেসবুক পোস্টে বলেন, ‘লাঠিসোটা ছাড়া বা ভয়ভীতি প্রদর্শন না করে এই লোকগুলোকে সরানো কঠিন। সম্প্রতি দুইজন নারী শিক্ষার্থী হয়রানির শিকার হয়েছেন।’ সর্বমিত্র স্বীকার করেন, বিতর্ক তাঁর ব্যক্তিগত জীবনকে প্রভাবিত করছে। প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে রাতে পাহারা দিয়ে উচ্ছেদ করাটা সরাসরি ডাকসুর কার্যনির্বাহী সদস্যের কাজ না হলেও তাঁর এখতিয়ারের বাইরেও নয় বলে মন্তব্য করেন।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওর বিষয়ে সর্বমিত্র চাকমা সমকালকে বলেন, ‘যেই ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, সেটা খুব একটা প্রফেশনাল নয়। সেই ভিডিও গুপ্তভাবে ধারণ করা হয়েছে। যারা ধারণ করেছে, তারা উচ্ছেদ অভিযানের আশপাশ দিয়ে ঘুরছিল কোনো ফাঁকফোকর পাওয়া যায় কিনা– এই আশায়। তারা দূর থেকে ভিডিও করছিল। এটা সম্পূর্ণ পরিকল্পিত। অমর একুশে হলের সামনের রাস্তায় ওই লোক ছিল। এই রাস্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে।’
লাঠির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমার হাতে শুরু থেকে লাঠি ছিল। কিন্তু কোনো ধরনের লাঠিচার্জ করা হয়নি। ওই লোকের হাতের বস্তায় লাঠি দিয়ে কয়েকটা বাড়ি দেওয়া হয়েছে। সেই বস্তার মধ্যে মাদক ছিল। এ ছাড়া ওই বৃদ্ধের সঙ্গে যে স্ট্রেচার ছিল, সেটা তাঁর লাগে না। কেবল ভিক্ষাবৃত্তি করার জন্য।’
এই ছাত্রনেতার মাঠ ছাড়ার ঘোষণার পর ডাকসুর আরেক সদস্য মিফতাহুল হোসাইন আল মারুফ সেই পোস্টটি শেয়ার দিয়ে ঘোষণা করেন, ‘আগামীকাল থেকে প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে মাঠে থাকব।’
ডাকসু নেতাদের প্রক্টরিয়াল বডির ভূমিকায় নামার ব্যাপারে জানতে চাইলে প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমেদ বলেন, আইনে কোনো ‘ইয়েসও নাই, নো-ও নাই।’ কিন্তু আমরা এটা নিষেধ করেছি যে, এটা তোমরা সহায়ক হিসেবে কাজ করো, মূল টিম হিসেবে নয়– এটা আমরা বলে দিয়েছি। এখন বোধ হয় তারা নামছে না।
বর্তমান পরিস্থিতি
বুধবার সন্ধ্যায় ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, ক্যাম্পাসের প্রবেশমুখগুলো রিকশাসহ যানবাহন প্রবেশে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সাধারণ মানুষ বিড়ম্বনায় পড়ছেন। রিকশা থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে।
গত সপ্তাহে আপ বাংলাদেশের সদস্য সচিব মোহাম্মদ হিযবুল্লাহও ক্যাম্পাসে প্রবেশের সময় বাধার শিকার হন বলে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, টিএসসির মেট্রোস্টেশনে যাব। দোয়েল চত্বরে আমাকে রিকশা থেকে নেমে যেতে বাধ্য করা হলো। রিকশা মেট্রোস্টেশন যেতে দেবে না। হেঁটে যেতে বলা হলো।



