
(প্রজন্মের সাহসী কবি কাজী জহিরুল ইসলামকে)
রাতের বুক চিরে আমি একজন কবিকে খুঁজি
বাড্ডা-গুলশান-ক্যাফেঝিল-টিএসসি
কিংবা শাহবাগের উত্তপ্ত চায়ের আড্ডায়
সবখানেই আমার অনুসন্ধানী চোখ
ঘুরে ফিরে আসে
কিন্তু কোথায় কবি?
আমার চোখকে ফাঁকি দিয়ে কাঙ্ক্ষিত কবি আমার
কোন অদৃশ্য রিমোট কন্ট্রোলের শিকার হয়েছেন
আমি জানি না
আমি শুধু কবিকে খুঁজি
আমার কাঙ্ক্ষিত কবিকে
যিনি আমার আদর্শ, আমার পথপ্রদর্শক
এইতো একটু আগেও কবিকে দেখেছি আমি
এই ভার্সিটির চত্বরে কালো পাথরে ঠেস দিয়ে
নিঃসীম আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন।
ওর এক চোখে চাঁদ আর অন্য চোখে সূর্যকে দেখেছি আমি
আমার শরীরের প্রতিটি ভাঁজ, শিরা উপশিরা
প্রতিটি রোমকূপ শিহরিত হয়
শিরদাঁড়া বেয়ে আশঙ্কার নীল স্রোত নেমে আসে
দুইশ’ বত্রিশ হাড়ের বাঁধন চিৎকার করে বলে
কবি তুমি কোথায়?
এক চোখে চাঁদ আর অন্য চোখে সূর্যকে পাশাপাশি নিয়ে
খেলা করে যে কবি সে হারিয়ে যেতে পারে না
পৃথিবীর দ্বিগুণ গতি কাজ করে আমার ভেতরে
আমি ছুটে চলি এ পথ-ও পথ, এ গলি-ও গলি
হঠাৎ থমকে দাঁড়াই জিরো জিরো সেভেন সিগন্যালে
পায়ের নীচে পরম আদরে শুয়ে থাকা মাটির কথা মনে পড়ে
মনে পড়ে আমার পূর্ব পুরুষের কথা
এখানে দাঁড়িয়েই আমার রক্ত ঘোষণা করেছিল
এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম—-
মুহূর্তে আনন্দের হিল্লোল ওঠে হৃদয়ের প্রতিটি পরতে
ওইতো আমার কবি অবিকল সেই মানুষ
দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যাচ্ছেন সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে
চোখের পলকেই কবি হাওয়া
১৯৭১ নম্বর নেমপ্লেটের লাল মার্সিডিসে
পেছন থেকে তাকে ডেকে ওঠার ব্যাকুল কন্ঠস্বর
ধর্মঘট করে বসে
কেরোসিনের সলতের মতো দপ করে নিভে যায়
ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠা হাসির রেখা
কারণ, গাড়িতে বসে থাকা ও মানুষটি আমার কাঙ্ক্ষিত কবি নয়
আমার কবি গাড়িতে চড়তে পারে না।
আমি আবার ছুটে চলি
প্রেস ক্লাবের সামনে আসতেই
জনৈক বন্ধু প্রশ্ন করে,
‘কি ব্যাপার, এতো হাঁপাচ্ছেন কেন?
এলোমেলো বিক্ষিপ্ত চুল, চোখের নিচে কালি
এ-কী শ্রী হয়েছে আপনার!’
ওর কথার জবাব না দিয়েই বলেছিলাম
‘আপনি তো সমাজের একজন জাঁদরেল প্রতিনিধি
পুরো ব-দ্বীপটাই এখন আপনার পকেটে
আপনি কি আমার কবিকে দেখেছেন?’
‘কোন কবির কথা বলছেন ?
ওই যে বেশ লম্বা লম্বা দাঁড়ি, কাঁধে ঝুলি
পান চিবুতে চিবুতে ঠোঁট লাল করে ফেলেছেন
ঠিক যেন কবিগুরু রবি ঠাকুর; তার কথা বলছেন তো?’
‘আপনি ভুল করছেন; আমি সেরকম ব্যাকডেটেড
কোনো কবিকে খুঁজি না
আধুনিক বিশ্বের অত্যাধুনিক কবি তিনি
যিনি ভগবানের বুক চিরে বের করে আনতে পারেন
টকটকে লাল কলিজা; অন্যায় অত্যাচারের পৃথিবীকে
ডিমের খোসার মতো পায়ের তলায় পিষে ফেলতে পারেন।’
ওর বিকৃত মুখ থেকে কোনো জবাব এলো না
আমি রাজধানী শহরের ব্যস্ত পল্টনে
লাখো জনতার ভিড়ে চিৎকার করে বলেছিলাম
হে মানুষ, তোমরা কি আমার কবিকে দেখেছ?
পিন পতন সাইলেন্ট নেমে এলো জনসমুদ্রে
কে একজন চিৎকার করে বলে উঠল
‘লোকটা বদ্ধ পাগল।’
বাড়তে থাকে রাতের গভীরতা
ক্রমশ জনশূন্য হয়ে পড়ে রাজধানী শহর
আমাকে উদ্দেশ্য করে জনৈক রিক্সাওয়ালা বলে ওঠে
‘এই যে ভাই, আপনার ঘড়িতে সময় কত?
খুব রাইত হইছে বুঝি?’ ওর দুচোখে প্রিয়জনের কাছে
ফিরে যাবার ব্যাকুলতা
আমি এগিয়ে গেলাম ওর কাছে
জানতে চাইলাম-‘আচ্ছা ভাই তুমি কি আমার কবিকে দেখেছ?”
ওর পোকলা দাঁতে বিচ্ছিরি হাসি খেলিয়ে বলল
‘এতো রাইতে কবি পামু কই
দেখতে চান তো রাতের প্রজাপতি নিশিকন্যাগো
ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া দেখাইতে পারি
রেসকোর্স ময়দানে – সংসদ ভবনের নরোম
ঘাসের উপর শুইয়া আছে হাজার হাজার নিশিকন্যা-রাধাকৃষ্ণের লীলা
চলতাছে অহন সারা শহরে।।”