নির্বাচিত কলামমুক্তমত

একমাত্র আন্দোলনের পক্ষেই বদলানো সম্ভব

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী


কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব বড়মাপের একটি ঐতিহাসিক কাজ করেছেন। সেটি হচ্ছে বাংলা সাহিত্যকে পুরোপুরি ধর্মনিরপেক্ষ করা। ওই কাজে মধুসূদন দত্ত নিযুক্ত ছিলেন, কিন্তু নজরুল যেভাবে হিন্দু পৌরাণিক ঐতিহ্য ও মুসলিম ইতিহাস ও কাহিনিকে একটি অভিন্ন সাহিত্যিক স্রোতে নিয়ে এসেছেন এবং বাঙালিরা যে একটি স্বতন্ত্র জাতি সেই সত্যকে তুলে ধরেছেন, ওই কাজ অমনভাবে অন্য কারো পক্ষেই করা সম্ভব হয়নি। এর কারণ তিনি কেবল কবি ছিলেন না, ছিলেন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী একজন আদর্শবাদী রাজনৈতিক কর্মীও। তিনি রাজনৈতিক মিছিলে যোগ দিয়েছেন, পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন, রাজনৈতিক কারণে জেল খেটেছেন এবং সমাজ-বিপ্লবের জন্য গান গেয়েছেন।

মুক্তির পথ সন্ধান তিনি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো কবিই তো পারেন না সমাজকে বদলে দিতে, তা তিনি যত বড়মাপের কবিই হোন না কেন। সমাজ-বদলের কাজটা খুবই কঠিন, যেখানে অনেক মানুষের এবং বহু ধরনের কাজকর্মের মানুষের অংশগ্রহণ প্রয়োজন। তাছাড়া নজরুল নিজেই বা আর কতটা অগ্রসর হতে পেরেছেন? তাকে তো অকালেই থেমে যেতে হয়েছে। ১৯৪২ সালে তো তিনি স্তব্ধই হয়ে গেলেন এবং তার আগেই চলে গিয়েছিলেন গানের জগতে। তার থেমে যাওয়ার কারণ দুটো। একটা হলো দারিদ্র্য। অপরটা সমাজতান্ত্রিক যে আন্দোলনের সঙ্গে তিনি নিজেকে যুক্ত করেছিলেন সেটির বেশি দূর না এগোনো। সাম্প্রদায়িকতা সবকিছুকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলল। মাতৃভূমি দ্বিখণ্ডিত হলো।
তাই কেবল একজন কবি নয়, চাই আন্দোলন। পুঁজিবাদবিরোধী, সমাজ-বিপ্লবী আন্দোলন। তার অভাব ঘটলে আমাদের এই বিশ্ব তো মনে হয় মনুষ্য বসবাসের উপযোগীই থাকবে না। তাই আন্দোলন চাই। পুঁজিবাদবিরোধী এবং সমাজ-বিপ্লবী আন্দোলন।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র কাজটা সহজ ছিল না। আর সেটা যে শুরু হতে পেরেছিল তার কারণ ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। মুসলিম সাহিত্য সমাজের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলন কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই অবদান। এই আন্দোলনের কর্মীদের রক্ষণশীলদের মুখোমুখি হতে হয়েছে; রক্ষণশীলরা প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে উঠেছে এবং বুদ্ধির মুক্তির কর্মীদের ওপর সামাজিকভাবে আক্রমণ চালিয়েছে। আন্দোলনের প্রধান সংগঠক ছিলেন অধ্যাপক আবুল হোসেন, আক্রমণে ক্ষুব্ধ হয়ে তিনি কলকাতায় চলে গেলেন ১৯৩২ সালে। এরপর এলো সাম্প্রদায়িকতার প্রবল ঝড়; দেশ ভাগ হয়ে গেল ১৯৪৭-এ; কাজী আবদুল ওদুদ ছিলেন বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের প্রধান চিন্তাবিদ, তিনি পাকিস্তানে আস্থা রাখতে পারেননি। রয়ে গেছেন কলকাতাতেই। পাকিস্তানের জন্মের পরে সার্বিক মুক্তির জন্য যে আন্দোলন সেটা বড় আকার ধারণ করল; সামনে চলে এলো ছাত্ররা, ঘটল রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সংস্কৃতির ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন এনেছে, যার ফলে বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের মতো আন্দোলনের বিশেষ কর্মক্ষেত্র আর রইল না। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ছিল সাহিত্যকেন্দ্রিক, নতুন যুগে প্রয়োজন দেখা দিয়েছিল রাজনীতিভিত্তিক আন্দোলনের। চলে এসেছিল জাতি প্রশ্ন ও শ্রেণি প্রশ্নের মীমাংসার আবশ্যকতা। সেখানে বুদ্ধির মুক্তি নয় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তিই প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াল।

শুরুর আন্দোলনটা তাই মিশে গেল বড় একটা আন্দোলনে। যেটা আমাদের জন্য দুঃখের ব্যাপার তা হলো নতুন রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতিতে সমাজ-বিপ্লবের জন্য যে সাংস্কৃতিক আন্দোলন দরকার ছিল সেটা গড়ে উঠল না। এর কারণ হলো রাষ্ট্রের শাসকরা সেটা চায়নি; উল্টো বাধা দিয়েছে। পাকিস্তান আমলে বাধাটা ছিল প্রচণ্ড; ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনার ওই রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিবিরোধী চরিত্রটা বিশেষভাবে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশ আমলেও রাষ্ট্রের চরিত্র কিন্তু দেখা যাচ্ছে আগের মতোই পুঁজিবাদী ও আমলাতান্ত্রিকই রয়ে গেছে। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ সীমিত আকারে হলেও তখনকার সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নিয়েছিল এবং প্রতিক্রিয়াশীলদের আক্রমণের মুখেও প্রগতিশীলদের কাছ থেকে যে সহযোগিতা পেয়েছিল সেটা এখন দুর্লভ হয়ে পড়েছে। এর মূলে আছে পুঁজিবাদের দৌরাত্ম্য।

ঐতিহাসিক কারণে ধর্মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়াটা বাস্তবসম্মত ছিল না। নিলে সেটা হঠকারী হতো। বিদ্যাসাগরের কথাই ধরা যাক। তিনি ধর্মকর্মে আস্থাশীল ছিলেন না। নাস্তিকই ছিলেন বলে ধারণা করা হয়। তার জীবনের একটা বড় লক্ষ্য ছিল বিধবা বিয়ের প্রবর্তন। কিন্তু তিনি জানতেন যে এটা করতে গেলে বড় বাধা আসবে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের কাছ থেকে। তারা বলবে যে বিধবা বিয়ে ধর্মসম্মত নয়। এবং ধর্মভীরু মানুষ সেই প্রচারণায় সাড়া দেবে। বিদ্যাসাগরকে তাই শাস্ত্র ঘেঁটে প্রমাণ করতে হয়েছে যে বিধবা বিয়ে শাস্ত্রসম্মত, যদিও শাস্ত্রের প্রতি তার কোনো শ্রদ্ধাভক্তি ছিল না। এটা আপস নয়, বাস্তববাদিতা। তাছাড়া তিনি চেষ্টা করলেন বিধবা বিয়ের পক্ষে আইন প্রণয়নের। যদিও বিধবা বিয়ে নিষিদ্ধ থাকাটা আইনের ব্যাপার ছিল না, ছিল সামাজিক প্রথার ব্যাপার। এখানেও ছিল তার বাস্তববাদিতা। তিনি জানতেন যে ব্রাহ্মণরা আইনকে সমীহ না করে পারবে না। সতীদাহের বিরোধিতার ক্ষেত্রে রামমোহনকেও একই পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছে। ধর্মের সাক্ষ্য নিয়ে এসেছেন এবং সরকারকে অনুরোধ করেছেন আইন প্রণয়ন করতে। নিজে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আধুনিক, ব্রাহ্মণ হয়েও ছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরোধী; কিন্তু জানতেন ও মানতেন যে ধর্মকে প্রগতির বিরুদ্ধে শক্তিশালী প্রতিবন্ধক হিসেবে দাঁড় করানো হবে, তাই শাস্ত্রের কাছ থেকে অনুমোদন আনা চাই, নইলে সব প্রচেষ্টা বানচাল হয়ে যাবে। এসব হচ্ছে মনীষীদের বাস্তববাদিতা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় ধর্মকে পাশ কাটিয়ে যেতে তারা পারেননি। ব্রাহ্মণ্যবাদের দাপটটা সুপ্রাচীন। চার্বাক দার্শনিকরা ছিলেন বস্তুবাদী এবং ঈশ্বরে অবিশ্বাসী, তাদের বিতাড়িত করা হয়েছে, তাদের গ্রন্থাবলি নিশ্চিহ্ন করে দেয়া হয়েছে। এমনকি রামায়ণেও তো নাস্তিকতা নিন্দা আছে। নাস্তিকতা মানে সেখানে ঈশ্বরে তো বটেই, ধরাধামে ঈশ্বরস্বরূপ যে নৃপতি তার কর্তৃত্বের প্রতিও অবিশ্বাস।

ওদিকে কৃষিনির্ভর উপমহাদেশে আধ্যাত্মিকতার চাষ আর পাঁচটা ফসলের ফলপ্রসূ চাষের মতোই প্রবলভাবে করা হয়েছে। উর্বর ভূমিতে ফসল পাওয়া গেছে সহজে, অবসর পেয়ে মানুষ পরকাল নিয়ে ভেবেছে, আবার বিপদ আপদ এলেও (যা প্রচুর পরিমাণেই এসেছে) জড়সড় মানুষ ঈশ্বরের ওপরই নির্ভর করেছে। লালন ফকির হিন্দু মুসলমান ভেদাভেদ মানতেন না, কিন্তু আধ্যাত্মিকতাকে উপেক্ষা করতে পারেননি। ওদিকে আবার ব্রিটিশের রাষ্ট্রশাসনে ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িকতাকে প্রচুর পরিমাণে উৎসাহিত করা তো হয়েছেই। মহাত্মা গান্ধী রাজনীতিকে জনগণের কাছে নিয়ে গেছেন ঠিকই, কিন্তু রামরাজ্যের ধারণা পরিত্যাগ করেননি। ‘শিক্ষিতশ্রেষ্ঠ’ বঙ্কিমচন্দ্র তো ধর্মকেই আঁকড়ে ধরলেন শেষ পর্যন্ত, মুক্তির উপায় হিসেবে। রবীন্দ্রনাথও ধর্মের কথা বলেছেন, যদিও সে ধর্ম শাস্ত্রীয় নয় মানুষের ধর্ম; এবং ব্রাহ্ম ধর্মের প্রভাব যে তার ওপরে গভীর ছিল সেটা অনস্বীকার্য এবং আধ্যাত্মিকতার সম্পদেও তার সাহিত্য সমৃদ্ধ বৈকি।

রাজনীতির মূল ধারা থেকে বামপন্থিরা সরে গেছেন এটা ঠিক; কিন্তু তার কারণ ধর্মের বিরুদ্ধে তাদের ‘দৃঢ় অবস্থান’ এমনটা ভাববার কোনো কারণ নেই। তারা সরে গেছেন দুই কারণে, একটি আত্মগত, অপরটি বস্তুগত। আত্মগত কারণ হলো এই যে বাম আন্দোলন যদিও কৃষক ও শ্রমিকের কাছে গেছে, আসলে বামপন্থিরাই গেছেন। জাতীয়তাবাদীরা প্রকৃত অর্থে মোটেই যাননি; তবু মেহনতি মানুষের সঙ্গে তারা একাত্ম হয়ে যেতে পারেনি। পরিপূর্ণ শ্রেণিচ্যুতি ঘটেনি। তারা গেছেন অনেকটা শিক্ষকের মতো, উপকারী মানুষের মতো, যেতে পারেননি অন্তরঙ্গ বস্তুর মতো। বাম আন্দোলন বিপ্লবী আন্দোলন হয়ে ওঠেনি। সংসদীয় নির্বাচনের আবর্তে পড়ে গেছে। বামপন্থিদের আন্দোলনকে কেবল অঙ্গীকারের ওপর ভরসা করলে চলে না, বামপন্থিদের জন্য জ্ঞানের চর্চা অত্যাবশ্যকীয় কর্তব্য। ওই চর্চার সুযোগ ছিল সীমিত। সমাজতন্ত্র বিষয়ক বইপত্র ছিল কার্যত নিষিদ্ধ। অন্য কারণটি বস্তুগত। বস্তুগত অন্তরায়ের ভেতর ছিল উপমহাদেশীয় সংস্কৃতিতে ধর্মবাদিতা ও আধ্যাত্মিকতার চর্চা। আরেকটি অন্তরায় ছিল উপনিবেশিক পরাধীনতা। রাজনীতিতে প্রাথমিক সংগ্রামটা ছিল ব্রিটিশকে বিদায় করার। সে কাজে জাতীয়তাবাদীরাই প্রধান ভূমিকা নিয়েছেন। এবং সেটাই ছিল স্বাভাবিক। জাতীয়তাবাদীরা সাম্প্রদায়িকতার শিকার হয়েছেন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের দ্ব›দ্ব শেষ পর্যন্ত রক্তাক্ত হয়ে উঠেছিল। এর বিপরীতে বামপন্থিদের কাজটা ছিল স্বাধীনতার সংগ্রামে অংশগ্রহণ তো বটেই, একই সঙ্গে ওই সংগ্রামকে সমাজতন্ত্রের অভিমুখে নিয়ে যাওয়াও। জাতীয়তবাদীরা- সে কংগ্রেসই হোক কি লীগপন্থিই হোক- সমাজতন্ত্রের ব্যাপারে কেবল যে উৎসাহহীন ছিলেন তা নয়, সমাজতন্ত্র-বিরোধীই ছিলেন। ব্রিটিশ শাসকরা বামপন্থিদের যত অপছন্দ করত জাতীয়তাবাদীদের ততো অপছন্দ করত না, কংগ্রেস ও লীগের সঙ্গে তারা ওঠাবসা আলাপ-আলোচনা করত, কিন্তু কমিউনিস্ট আন্দোলনকে চেয়েছিল অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দিতে। নেতাদের তারা আটক করেছে, মামলা দিয়েছে, পার্টিকে নিষিদ্ধ করে রেখেছে। কংগ্রেস, লীগ এবং ব্রিটিশ, সবাই মিলে চেষ্টা করেছে বাম আন্দোলনের বিনষ্টি ঘটাতে। আর দেশের ধনিক শ্রেণি ব্যবসায়ী, শিল্পপতি ও জমিদারদের কাছে তো বামপন্থিরা ছিলেন চোখের বালি; একেবারেই অসহ্য। তারা বামপন্থিদের দেশদ্রোহী, বিদেশি এজেন্ট, নাস্তিক, কোনো কিছুই বলতে ছাড়েনি। এতসব প্রতিবন্ধক ঠেলে বাম আন্দোলনকে এগোতে হয়েছে, যতটুকু এগিয়েছে।

লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension