
প্রকৃতি এখানে অকল্পনীয় সুন্দর। যদিও সূর্যের প্রখরতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, তবু চোখ একেবারে জুড়িয়ে যায়।
গত ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আমার ছোট মেয়ের কাছে শুনলাম, ‘গ্রিন বেল্ট’ নামে সদ্য জন্ম নেয়া, কয়েক বন্ধু মিলে গড়া, ছোট একটি সংস্থা এক ট্যুর প্রোগ্রাম করতে যাচ্ছে। খবরটা সে পেয়েছে ফেসবুক থেকে। আমি ফেসবুক ব্যবহার করি না বলে এ ব্যাপারে অবগত ছিলাম না।
২৯ সেপ্টেম্বর সপরিবারে রওনা হলাম। গন্তব্য রাঙ্গামাটি জেলার অখ্যাত এক গ্রাম সাজেক-এ, বর্তমানে যার সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে সম্ভবত বিদেশেও।
রাত দশটা ত্রিশের গাড়িতে আমাদের পনেরো জনের দলটি প্রথমে যাব খাগড়াছড়ি। বাস ঢাকা শহর পেরিয়ে যেতেই ঝিমুনি এসে গেল। ঝিমুতে-ঝিমুতে একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম। কতক্ষণ কেটে গেছে জানি না, হঠাৎ বাসের বেরসিক সুপারভাইজারের হাঁক শুনে মনোরম কাঁচা ঘুমটা ভেঙে মেজাজ খিঁচড়ে গেল। চোখ কচলে তাকিয়ে দেখি কুমিল্লার চোদ্দগ্রামে রেস্টুরেণ্ট-কাম-রিফ্রেশমেণ্ট হাউস-এ বাসটা দাঁড়িয়ে। রাত তখন দুটো বেজে দশ। লোকটা কুড়ি মিনিটের বিরতি ঘোষণা করল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই তলপেটে চাপ অনুভব করলাম। তাড়াতাড়ি বাস থেকে নেমে নিজেকে হালকা করে নিলাম। হাতমুখ ধুয়ে কয়েকটা বিস্কুট আর এক কাপ কড়া চায়ে অতিকষ্টে ঘুম তাড়াবার চেষ্টায় লেগে পড়লাম। চোখের পলকে যেন কুড়ি মিনিট পেরিয়ে গেল।
বাসে ওঠার পর আবার সেই ঝিমুনি, তারপর ঘুম, এভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময়। মোটামুটি গভীর ঘুমেই ঢলে পড়েছিলাম, হঠাৎ বাসের প্রচণ্ড দুলুনিতে ঘুম ভাঙার পর দেখি পাহাড়ি পথে এঁকে-বেঁকে চলেছি। কখনও বেশ উপরে উঠছি, আবার পরমুহূর্তে নিচে নামছি। খুব ঘন-ঘন বাঁক নিচ্ছে গাড়ি। আশপাশের যাত্রীদের কাছ থেকে জানলাম, মীরসরাই সদরের কাছাকাছি এসে, ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে থেকে বেরিয়ে খাগড়াছড়ির দিকে চলেছি। রাত তখন চারটা। গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল, আচমকা ঘন কুয়াশায় সামনের রাস্তা একেবারে অস্পষ্ট হয়ে গেল। ড্রাইভার আগের মত একই গতিতে নির্বিকারে চালিয়ে যাচ্ছে গাড়ি। রীতিমত আতঙ্কিত হয়েছিলাম তখন। সুপারভাইজারের কাছ থেকে শুনলাম ওটা আসলে কুয়াশা নয়, মেঘের ভিতর দিয়ে চলেছি আমরা। যদিও কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যেই আবার রাস্তা দেখতে পেলাম পরিষ্কার। গাড়ি যখন উপরে উঠছিল, মনে হচ্ছিল যেন স্বর্গে চলেছি। চারদিকে গাঢ় অন্ধকার, তবু হেড-লাইটের আলোয় যা দেখেছি তা কখনও ভুলবার নয়। সে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য আমার নেই। যতটুকু দেখতে পেয়েছি, মুগ্ধ-নয়নে মন ভরে উপভোগ করেছি সিটে খাড়া হয়ে বসে।
আস্তে-আস্তে ভোর হয়ে এল, সৌন্দর্য আরও বেশি মনোমুগ্ধকর হয়ে উঠল। ভোর ছ’টায় খাগড়াছড়ি শহরের কেন্দ্রে এসে পৌঁছলাম। তখনও বৃষ্টি পড়ছিল। এরই মধ্যে আমাদের নির্দিষ্ট গাইডের সঙ্গে কথা হয়েছে মোবাইলে। তার সাহায্যে এক হোটেলে উঠে ভালভাবে ফ্রেশ হয়ে, সকালের নাস্তা সেরে, এগিয়ে গেলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত ‘চাঁদের গাড়ি’-র কাছে।
বৃষ্টির মধ্যেই চললাম। গন্তব্য দীঘিনালা উপজেলার মোটামুটি দুর্গম এলাকায় হাজাছড়া ঝর্না। সম্পূর্ণ পাহাড়ি এলাকা। ক্রমেই আকাশ পরিষ্কার হয়ে আসছে। বৃষ্টিস্নাত সে-প্রকৃতির রূপ অবিশ্বাস্য ঠেকল আমার কাছে। পথে পড়ল কাসালং নদী, পেরিয়ে এলাম ব্রিজ দিয়ে। অতঃপর ছোট্ট একটা বাজারে এসে নামলাম চাঁদের গাড়ি থেকে।
এবারে পনেরো-কুড়ি মিনিটের হাঁটা-পথ। পথ মানে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ করে নিতে হয়। মাঝে-মাঝে পেরোতে হলো ছোট-ছোট নালা, ওগুলোতে বইছে ঝর্নার বেশ ঠাণ্ডা পানি। খুবই আরামদায়ক। কোনও-কোনও জায়গা বেশ পিচ্ছিল। লাঠি নিয়ে হাঁটতে হয়।
গন্তব্যে পৌঁছনোর অন্তত পাঁচ মিনিট আগে থেকে শুনলাম ঝর্নার পানি পড়ার জোরাল শব্দ আর সেই সঙ্গে দর্শনার্থীদের আনন্দ-চিৎকার। ঝর্নার সামনে যখন পৌঁছলাম, বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, বেশ ক’মিনিট স্হাণু হয়ে রইলাম। অনেকক্ষণ ধরে দু’চোখ ভরে দেখেও যেন সাধ মেটে না। ছবিও তোলা হলো অসংখ্য। সকালে বৃষ্টির মধ্যে শীত অনুভব করছিলাম, বেলা এগারোটার দিকে আকাশ পরিষ্কার হয়ে সূর্য প্রচণ্ড তাপ ছড়াতে শুরু করেছে। কিন্তু ঝর্নার শীতল পানি ক্লান্তি একেবারে দূর করে দেয় নিমিষে। শেষমেশ গাইডের তাড়া খেয়ে মন না চাইলেও ফিরে আসতে হলো গাড়ির কাছে।
দুপুর বারোটা বেজে কয়েক মিনিট। প্রচণ্ড রোদে হেঁটে আসতে-আসতে ঘেমে নেয়ে একসা। বাজার থেকে কলা, বিস্কুট আর ডাবের পানি দিয়ে প্রাক্-মধ্যাহ্নভোজ সারতে হলো। কারণ কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছতে হবে রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়ি উপজেলার প্রবেশমুখে। এরই মাঝে পেরিয়ে এসেছি খাগড়াছড়ির আরেক ছোট নদী মাসালং। সাজেকগামী গাড়িগুলোকে সার দিয়ে দাঁড়াতে হবে। ঠিক দুপুর একটায় কাফেলার সামনে-পেছনে সেনাবাহিনীর গাড়ি অবস্হান করবে, তারপরই রওনা দিতে হবে। তার আগে প্রতিটি গাড়িতে ক’জন যাত্রী, গাড়ির ড্রাইভারের নাম, সবকিছু সেনাবাহিনীর চেক পোস্ট-এ এণ্ট্রি করা হলো। ফেরার সময় সবাই ঠিকমত পৌঁছল কি না তা সেই চেক পোস্ট-এ রিপোর্ট করতে হবে।

আল্লাহর নাম নিয়ে যাত্রা শুরু সাজেক অভিমুখে। জানতাম পাহাড়ি পথ, বেশ অনেকগুলো চড়াই-উতরাই পেরোতে হবে। কিন্তু এতটা রোমাঞ্চকর! পাহাড়ি রাস্তা এঁকে-বেঁকে ক্রমশ উপরে উঠছে তো উঠছেই। অপ্রশস্ত রাস্তা, দু’পাশে খাদ। কোথাও পাশে গভীর খাদ আর অত্যন্ত ভীতিকর দুয়েকটা ঢাল। একজায়গায় প্রায় একশো ফুট খাড়া নিচে নেমেই আবার চড়াই। যেন রোলার কোস্টার।
এভাবে চলতে-চলতে, ভয়ানক রোমাঞ্চে ভাসতে-ভাসতে দু’ঘণ্টার রাস্তা পেরিয়ে অবশেষে পৌঁছলাম বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক ইউনিয়নে। এটা ছোট একটা গ্রাম, মাত্র কয়েকটা পরিবার। দর্শনার্থী কয়েকগুণ বেশি। প্রকৃতি এখানে অকল্পনীয় সুন্দর। যদিও সূর্যের প্রখরতায় প্রাণ ওষ্ঠাগত, তবু চোখ একেবারে জুড়িয়ে যায়।
আমাদের গাইড রকিব শাওনের কথা কিছু না বললেই নয়। তার চমৎকার তত্ত্বাবধান আর অতুলনীয় আতিথেয়তায় আমরা সত্যিই মুগ্ধ। ও আমাদের জন্য গ্রাম্য কটেজ-এর ব্যবস্থা করে দিল। কটেজে ঢুকেই কাপড় ছেড়ে আমরা চারজন একে-একে গোসল সেরে নিলাম ট্যাপের পানিতে। এত উপরে এরকম পানির ব্যবস্থা, আশাই করিনি। প্রাণ-জুড়ানো ঠাণ্ডা পানিতে স্নান সেরে অনেকটা সতেজ হয়ে গেলাম, যদিও পেটে তখন ছুঁচো দৌড়চ্ছে প্রাণপণে।

বেলা আড়াইটা বা তিনটা। প্রচণ্ড রোদ, পনেরো মিনিটের মত হেঁটে যেতে হবে রেস্টুরেণ্টে। পাঁচশো ফুট লম্বা সুন্দর উঁচু-নিচু পাকা রাস্তা, দু’ধারে বিচিত্র রঙের টাইল-এ তৈরি চমৎকার সরু ফুটপাত। গ্রামবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানির বিশাল ট্যাঙ্ক, সবই সেনাবাহিনীর কল্যাণে। কত পরিচ্ছন্ন! আর এই ভর-দুপুরেও প্রকৃতি কত সতেজ! সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৮০০ ফুট উপরে উঁচু-নিচু রাস্তা দিয়ে হাঁটছি-দু’পাশে যতদূর চোখ যায় শুধুই সবুজ। পাহাড় আর পাহাড়, দু’পাশে কোথাও গভীর খাদ। সে এক অপূর্ব দৃশ্য! এখানে সেনাবাহিনী, আনসার ও বিজিবি, সবারই ঘাঁটি রয়েছে।
রেস্টুরেণ্টে খাবার খেতে গেলাম ভয়ে-ভয়ে, পাহাড়ি গ্রাম্য জায়গা, ভাগ্যে কী জুটবে কে জানে! রীতিমত অবাক-কচি বাঁশের সুস্বাদু তরকারি (আক্ষরিক অর্থেই ‘বাঁশ খাওয়া’ যাকে বলে!), সুন্দর চালের ভাত, দেশি মুরগির ঝোল আর অতি উপাদেয় ডাল রান্না। বেশ তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম পেটপুরে। অবিশ্বাস্য!
খাওয়ার পর গরমে একেবারে হাঁসফাঁস করতে লাগলাম। কোনরকমে প্রখর রোদে পুড়তে-পুড়তে কটেজে ফিরে শুয়ে পড়লাম। ঘুমে চোখ বুজে আসতে চায়, কিন্তু গরমে ঘর একেবারে উত্তপ্ত। চারপাশ কাঠের আর ছাদ টিনের। একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার যেতে হবে হেলিপ্যাড-এ আর কংলক পাহাড়ের চূড়ায়।
রোদ একটু পড়ে আসতেই বেরোলাম কংলক বিজয়ের জন্য। সেই সুন্দর, পরিষ্কার পাহাড়ি পাকা রাস্তাটা কিছুদূর গিয়ে শেষ হয়ে গেল। এরপর কিছুটা কাঁচা রাস্তা চাঁদের গাড়িতে চড়ে অবশেষে হাঁটতে লাগলাম সাজেক থেকে আরও পঞ্চাশ-ষাট ফুট উঁচু কংলক পাহাড়ের চূড়ার দিকে। একজায়গায় এসে থমকে গেলাম।
ফুট দুয়েক পথ খুবই সংকীর্ণ, তারপর একেবারে খাড়া দশ-বারো ফুট উঠে গেছে চূড়া পর্যন্ত।
ফিরে এলাম। ক’জন দুঃসাহসী বালককে দেখলাম গাছের শিকড়-বাকড় ধরে উপরে উঠতে। ৩০-৩৫ বছর আগে হলে অবশ্য আমিও ওদের সঙ্গী হতাম। ওখান থেকে আট কিলোমিটার দূরে ভারতের মিজোরাম বর্ডার। বর্ডারের ওপারে ভারতীয় বাড়ি-ঘর দেখে মনে হয় খুব দূরে নয়।
ফিরে আসতে-আসতে দেখলাম আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। দ্রুত হেঁটে গাড়িতে, তারপর গাড়ি করে এলাম সেনাবাহিনীর তৈরি, বেশ বড় সমতল জায়গা-হেলিপ্যাড-এ। ততক্ষণে আকাশে ঘন কালো মেঘ জমেছে। বৃষ্টি নামবে ভালভাবে। মুগ্ধ হয়ে চেয়ে দেখছি চারদিক। মেঘ ক্রমশ ঘন হয়ে নিচে নেমে আসছে। এবার গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। পাহাড়ের উপর ঝড়ের কবলে পড়ার ভয়ে তাড়াতাড়ি গাড়িতে ফিরে এলাম। গাড়ি ঢাল বেয়ে নেমে আসছে ঝড়ের গতিতে। ভয়ও লাগছে কিছুটা। যখন কটেজে পৌঁছলাম ততক্ষণে বৃষ্টির ফোঁটা বেশ বড়-বড়।

কটেজে ঢুকতে না ঢুকতেই বৃষ্টি নামল তুমুল বেগে। সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। মেঘের জন্য সূর্যাস্ত দেখতে পারলাম না। মনের দুঃখে কটেজের বারান্দায় বসে বৃষ্টি দেখছিলাম, ভাল লাগছিল খুব। এরপর শুরু হলো ঝড়। কটেজের ভিতরে যেতে বাধ্য হলাম। বাতাসের তোড়ে টিনের ঘর কেঁপে-কেঁপে আমাদের বুকেও কাঁপন ধরিয়ে দিল। ঝড় অবশ্য বেশিক্ষণ স্হায়ী হয়নি, কিন্তু বৃষ্টি আর থামে না। রাত দশটা পর্যন্ত তুমুল বৃষ্টি হলো। এরপর বৃষ্টি কিছুটা কমে এল।
রাত আটটায় আমাদের রাতের খাবারের জন্য রেস্টুরেণ্টে উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও সম্ভব হয়নি। সাজেকে বিদ্যুৎ নেই, নেই কোনও মোবাইলের নেট-ওয়ার্ক। অবশ্য রাস্তায় ও কটেজে সৌর-বিদ্যুতের টিমটিমে বাতি আছে, সেগুলোও সেনাবাহিনীর সৌজন্যে।
সবাই ছাতা নিয়ে রেস্টুরেণ্টের উদ্দেশে হাঁটা ধরলাম। ভীষণ ক্লান্ত থাকায় ভেবেছিলাম দ্রুত খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়ব, কিন্তু আমাদের সেই গাইড, লাঞ্চের সময় কথা দিয়েছিল-রাতের মেনু হবে পরোটা আর চিকেন বারবিকিউ। বৃষ্টি না হলে আমরা সবাই মিলে হই-হুল্লোড় করে বারবিকিউ বানাতে হাত লাগাতাম। বৃষ্টির কারণে তা হলো না বলে ভেবেছিলাম যাহোক একটা কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু ভবী ভুলবার নয়। শাওন তার কথা রাখবেই। ভাবলাম, এই অজ-পাড়াগাঁয়ে বারবিকিউ! কী আর হবে! খেতে বসে তাজ্জব বনে গেলাম, এত সুন্দর কস্মিনকালেও আশা করিনি। পরোটাও বিশেষ ধরনের। ঢাকার মাঝারি মানের যে কোনও রেস্টুরেণ্টের চেয়ে কোনও অংশেই কম না। পরিমাণেও ছিল যথেষ্ট। পরোটা আর সেই কাবাব আমি অনেক বছর পর এতটা খেলাম। বৃষ্টিভেজা রাতে বারবিকিউ! ব্যাপারই আলাদা। সুনসান রাত, আমাদের এই দল আর সেই রেস্টুরেণ্টের ক’জন স্থানীয় কর্মচারী ছাড়া অন্য কেউই জেগে ছিল না তখন। রাত একটু বেশিই হয়ে গেল ঘুমোতে। ভোর চারটায় অ্যালার্ম দিয়ে রাখলাম। মেঘের জন্য সূর্যাস্ত ঠিকমত দেখতে পারিনি, তাই সূর্যোদয় কোনভাবেই মিস করতে চাই না।
সময় মতই ঘুম ভাঙল। পাঁচটার মধ্যে হেলিপ্যাডে না গেলে সূর্যোদয় দেখা হবে না। বেশ অন্ধকার থাকতেই ঘর থেকে বেরিয়ে হেলিপ্যাডের দিকে হেঁটে গেলাম। রাস্তায় টহলরত সেনাবাহিনীর লোকেদের দেখলাম, ওরাও টর্চ জ্বেলে দেখল, কিছু বলল না। ওখানে যখন পৌঁছলাম, ভোরের আলো একটু-একটু করে ফুটতে শুরু করেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুবাকাশ লালচে হয়ে উঠল। রাতে কখন বৃষ্টি থেমে গেছে জানি না, বৃষ্টি থাকলে ভোরটা মাঠে মারা যেত।

আস্তে-আস্তে আলো বাড়ছিল আর সৌন্দর্য যেন একটু-একটু করে বিকশিত হচ্ছিল। অপূর্ব স্বর্গীয় সৌন্দর্য। তখন আকাশে ছেঁড়া-ছেঁড়া সাদা মেঘ তুলোর মত খুব ধীরে উড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, তার বেশ কিছুটা নিচে, প্রায় চারদিকে ধবধবে সাদা মেঘ-পুঞ্জ একেবারে যেন স্থির হয়ে জমে আছে। যদি বৃষ্টি হত, অনায়াসে আমরা মেঘ ছুঁতে পারতাম।
এর আগে রাস্তায় চাঁদের গাড়িতে আসবার সময় পথের সৌন্দর্যের কথা বলেছিলাম-ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য নেই, আর হেলিপ্যাডের সেই ভোরের সৌন্দর্য! কী আর বলব! বর্ণনা করা আরও বেশি অসাধ্য। প্রায় আড়াই ঘণ্টা ওখানেই কাটালাম। কিছুতেই যেন ছেড়ে আসতে পারছিলাম না। ফিরে আসতেই হলো, কারণ দশটার মধ্যে চাঁদের গাড়ি রওনা হবে খাগড়াছড়ির উদ্দেশে। তার আগে খিচুড়ি, আলু ভর্তা আর হাঁসের মাংস দিয়ে সকালের খাওয়া সেরে নিতে হবে। সে খাবারও ছিল অতুলনীয়।
যাহোক, সকাল দশটায় ফিরতি পথে চড়ে বসলাম চাঁদের গাড়িতে। ছেড়ে আসতে বাধ্য হলাম স্বপ্নের সাজেক!

দুপুরে খাগড়াছড়ি শহরে খেয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়ার পর অদূরে আলুটিলায় ঘুরে এলাম এক সুড়ঙ্গে। সে-ও ভারি রোমাঞ্চকর। তারপর গেলাম তেরাং নামে এক জায়গায় রিসাং ঝর্না দেখতে।

সন্ধ্যার পর ফিরলাম খাগড়াছড়ির সেই আগের হোটেলে। সেখানে গোসল সেরে কাপড় বদলে ঘণ্টা দুয়েক বিশ্রাম নিয়ে রাতের খাবার খেয়ে ঢাকার উদ্দেশে বাসে উঠলাম। রাত ন’টায় বাস ছাড়ল, ভোর হবার দু’ঘণ্টা আগেই ঢাকার কমলাপুরে বাস থেকে নামলাম। ঘরের ছেলে ঘরে ফিরলাম।
-রানশু