গল্পসাহিত্য

ঘৃণা

দর্পণ কবীর


রায়হান অর্ণবের দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে বলল, ‘বন্ধু, তুমি মেয়েটাকে আমার কথাগুলো গুছিয়ে বোঝাতে পারবে না?’
রায়হানের কথা শুনে অর্ণবের হাসি পেল। একটি মেয়েকে বোঝাতে হবে যে, রায়হান নিউইয়র্কে শায়লা নামের একটি মেয়েকে ভালোবেসে বিয়ে করেছিল। বিয়ের ছয়মাস পর শায়লা ওকে ডিভোর্স দেয়। এ ঘটনার দেড় বছর পর রায়হান ঢাকায় এলে ওর বাবা-মা ওই মেয়েটির সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলে। রায়হান এই বিয়েতে অমতও করেনি। কিন্তু সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে, আকস্মিকভাবে শায়লা ঢাকায় চলে এসে রায়হানের সঙ্গে দেখা করে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েছে। রায়হান ওকে ক্ষমাও করে দিয়েছে। এখন শায়লাকে নিয়ে পুনরায় সংসার করতে চায় ও।

কিন্তু এ কথা ওর বাবা-মাকে বলতে পারছে না রায়হান। কারণ, তার সম্মতি নিয়েই মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে বিয়ের কথা চূড়ান্ত করেছে ওর বাবা-মা। বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়েছে। মেয়েটি অপেক্ষা করছে একটি রেস্টুরেন্টে। রায়হানের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা বলার জন্য। বিয়ের আগে সে রায়হানকে কিছু কথা বলে নিতে চায়। মেয়েটির অনুরোধে রায়হান আজ সময় দিয়েছে তাকে। কিন্তু রায়হান মেয়েটির জরুরি কথা শোনার আগে নিজের কথাটি বলে ফেলতে চায়। এই কথা নিজের মুখে বলতে সঙ্কোচবোধ করছে ও। তাই অর্ণবকে নিয়ে এসেছে। কথাগুলো মনে মনে ভেবে নিয়ে ম্লান হাসল অর্ণব।

রায়হান ওর হাসির অর্থ খোঁজার দৃষ্টি মেলে বলল, ‘তুমি, হাসছো কেন? আমি কি হাসির কথা বলেছি? আমি যে ঘটনার সামনে এসে দাঁড়িয়েছি, তা কি হাস্যকর, বন্ধু?’

‘না, না। আমি তোমার সংকটের কথায় হাসছি না’, বলল অর্ণব।

‘তাহলে?’ রায়হান জানতে চায়।

অর্ণব বলে, ‘আমার হাসির কারণ নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার নেই। মানুষ অনেক সময় কোনও কারণ ছাড়াও হাসে। তারপরও বলছি, আমি হাসছি এ কথা ভেবে যে, নিউইয়র্ক থেকে দু’বন্ধু একসঙ্গে দেশে এলাম বিয়ে করতে। তোমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, আর আমার এখনও বিয়ের কনেই পছন্দ হয়নি। এখন আবার তোমার বিয়ে ভাঙতে আমাকে কাজ করতে হবে। এটা কি হাসির জন্য যথেষ্ট নয়।’ কথাটি বলে ফের হাসল অর্ণব।

রায়হান ওর কথার কোনও জবাব না দিয়ে বলল, ‘ওসব কথা থাক। তুমি রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়। আমি রেস্টুরেন্টের একটি রুম বুকড করে রেখেছি। রেস্টুরেন্টের ভেতরে ডানদিকের সারির সবশেষে গিয়ে ডানদিকের রুমটিতে প্রবেশ করবে। ওই রুমে দেখবে একটি মেয়ে বসে আছে। তুমি ওকে তোমার পরিচয় দেবে। বলবে, আমি কিছুক্ষণের মধ্যে চলে আসব। তুমি ওর সঙ্গে গল্পের ছলে আমার সমস্যার কথাটা বলে ফেলবে। এ কথা বলার উদ্দেশ্য হচ্ছে, ওকে আমার অবস্থা অর্থাৎ ওকে বিয়ে করতে না পারার অপারগতার বিষয়টি সে যেন সহজভাবে মেনে নেয়। বুঝলে?’

অর্ণব মাথা নেড়ে জানায়, ও বুঝতে পেরেছে। কাউকে বোঝানো বা দু’জনের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হলে তাদের মধ্যে মধ্যস্থতা করার কাজ সে ভালো পারে। নিউইয়র্কে লেখাপড়ার সময় সে যখন মেসে থাকত, তখন রুমমেটদের মধ্যে সমস্যার সৃষ্টি হলে অর্ণব মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকাটা বেশ ভালোই করত।

অতুলের সঙ্গে রায়হানের তুমুল ঝগড়া হয়েছিল একবার। ওদের দু’জনের মধ্যে হাতিহাতিও হয়ে গিয়েছিল। রায়হানের থাপ্পড়ে অতুলের নাক দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। পুলিশ ডাকাডাকির অবস্থায় অর্ণব উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করেছিল। এরপর থেকে রায়হানের সঙ্গে ওর বন্ধুত্ব আরও গভীর হয়।

অর্ণবকে চুপ থাকতে দেখে রায়হান তাগিদ দিয়ে বলে, ‘যাও, ভেতরে চলো যাও। মেয়েটি একা বসে আছে। আমি একঘণ্টা পর শায়লাকে সঙ্গে নিয়ে আসছি। তুমি পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখ। এরপর শায়লা আর আমি ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে নেব।’

অর্ণব জানতে চাইল, ‘মেয়েটির নাম কি?’

‘ওর কাছেই জেনে নিও ওর নাম কি। আমি সব বলে দিলে কথা চালিয়ে যাবে কীভাবে? যাও, ভেতরে চলে যাও।’ তাগিদ দেয় রায়হান।

অর্ণব বলে, ‘আরে নাম বলতে না চাইলে অন্তত মেয়েটির সম্পর্কে কিছু তথ্য দাও। কথা চালিয়ে নিতে গেলেও তো ওর সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা থাকার প্রয়োজন আছে।’

রায়হান এ নিয়ে তর্ক করল না, বলল, ‘পুরুষদের তীব্র ঘৃণা করে মেয়েটি। শুনেছি, ওর জীবনে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছিল। এরপর থেকে পুরুষদের প্রতি ওর ঘৃণার জন্ম নেয়। ওর পরিবার কয়েক বছর যাবত ওকে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। এসব কথা শুনে আমি মেয়েটিকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলাম। কথাগুলো মনে রেখে ওর সঙ্গে আলাপ জমাও। যাও, সময় নষ্ট না করে, ভেতরে চলে যাও। মেয়েটি আমার জন্য অপেক্ষা করছে। তুমি ভেতরে গেলে আমি ওর সেলফোনে এসএমএস করে জানিয়ে দেব যে, তুমি আমার বন্ধু।’

গুলশান অভিজাত এলাকায় একটি রেস্টুরেন্টের বাইরে দাঁড়িয়েছিল ওরা। রায়হান ওর হাতের ঘড়িতে সময় দেখল। শায়লা আসবে ওয়ারী থেকে মহাখালীর আড়ংয়ের স্টোরে। সময় বেশি নেই। রায়হানকে যেতে হবে এখুনি। আড়ং থেকে শায়লাকে নিয়ে সে চলে আসবে ফের এখানে।

অর্ণব রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করার সময় ভাবল মেয়েটি পুরুষদের ঘৃণা করে, এটি কৌতুহলের বিষয়। যদিও আজকাল অনেক মেয়ে ‘নারীবাদী’ হয়ে পুরুষদের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করে আনন্দ পায়। আধুনিকতার মোড়কে এটি এক ধরনের ফ্যাশন বলে মনে হয় ওর। আবার কেউ কেউ আছেন, যারা সত্যিকার অর্থে পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খল ভাঙার আদর্শ নিয়ে লড়াই করে যাচ্ছেন। তাদের লড়াইটা সমর্থন করে অর্ণব।

রায়হানের সঙ্গে যে মেয়েটির বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়েছে, সেই মেয়েটি কেন পুরুষদের প্রতি ঘৃণা পোষণ করে আছে তা জানতে হবে, ভেবে নেয় ও। রায়হান বলেছে, মেয়েটির জীবনে একটি দূর্ঘটনা ঘটেছিল। ওর জীবনে কী ঘটেছিল? প্রশ্নটা ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে ওঠার মতো ওর মনে পাকিয়ে উঠল। এক ধরনের তন্ময়তার মধ্যে বিনা অনুমতিতে মেয়েটির কক্ষে প্রবেশ করল অর্ণব। হালকা নিয়নের আলো ছড়ানো কক্ষটিতে আঁধারের ঘনত্ব পেখম ছড়িয়ে আছে। আলো-আঁধারি ঘেরাটোপ পরিবেশে মেয়েটি মৌনতার প্রতিমা হয়ে বসেছিল। অর্ণব মেয়েটির মুখোমুখি বসল তার দিকে ভালো করে না তাকিয়েই।

অর্ণবকে দেখে ভূত দেখার মতো চমকে উঠল পারমিতা। মৌনতার প্রতিমার দু’চোখে রাজ্যের বিস্ময় বিস্ফোরিত হলো মুহূর্তেই। ওই চোখে চোখ রেখে অর্ণবও হতবিহ্বল হয়ে পড়ল, বা বলা যায়, বিস্ময়ের আরও গভীরে সে তলিয়ে যেতে লাগল।

প্রচণ্ড ধাক্কায় অতল সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছিল অর্ণব, পারমিতার বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে ওর চেতনায় চাবুক পড়লো। বিস্ফোরিত দৃষ্টি মেলে অর্ণবকে দেখে পারমিতা বলল, ‘তুমি!’

কখনও কখনও এই একটি শব্দই অনড় পাহাড় ধসিয়ে দিতে পারে, স্রোতস্বিনী নদীর খরস্রোত থামিয়ে দিতে পারে, মহাপ্রলয়ের ক্রন্দনও বাকরুদ্ধ করে দিতে পারে। মুহূর্তেই ভেবে নেয় অর্ণব। যে পারমিতাকে ছয় বছর আগে সে হারিয়ে ফেলেছে, সেই পারমিতা ওর সামনে বসে আছে। অনেক চেষ্টা করেও যে পারমিতার সঙ্গে একটিবারের জন্যও যোগাযোগ করতে পারেনি, সেই পারমিতা তার সামনে আভির্ভূত, রায়হানের হবু বধুর ভূমিকায়। অর্ণবের ভাবনায় উথাল-পাথাল ঢেউ। পারমিতার তো বিয়ে হয়েছিল। তাহলে কি বিয়েটা টেকেনি? ওটাই কি ওর জীবনের দুর্ঘটনা? অর্ণবের শিরা-উপশিরায় ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে। ও একটু ঘামছেও। পারমিতার চোখ থেকে ওর চোখ সরছে না। হতভম্বের মতো সে তাকিয়ে আছে। পারমিতা যেন একটু নড়ে উঠে সে ফের বলল, ‘তুমি! তুমিই কী রায়হানের বন্ধু?’

‘হুম। কিন্তু আমি জানতাম না, তোমার সঙ্গে রায়হানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। আমি এসেছি রায়হানের হয়ে কিছু কথা বলতে।’

এ পর্যন্ত বলে তাকাল পারমিতার মুখের দিকে। পারমিতার চোখ কেমন নিষ্প্রভ। ওর মুখে মেঘলা আকাশের নিবিড় ছায়া। ওকে দেখে রোগা ও ক্লান্ত মনে হচ্ছে অর্ণবের। পারমিতা কি কোনও রোগে আক্রান্ত? পারমিতা মরা মাছের দৃষ্টি দিয়ে অর্ণবকে দেখছে। প্রাণবন্ত, উচ্ছ্বসিত যে পারমিতাকে ও চিনত, আজ সেই পারমিতাকে অর্ণব দেখছে না। সে কথা চেপে রাখতে পারল না। প্রশ্ন করল, ‘শুনেছিলাম, তোমার বিয়ে হয়েছিল। সংসার টিকেনি?’

এ কথায় সপাং করে চাবুকের আঘাত পেল যেন পারমিতা। ওর চোখ দুটি কেমন জ্বলে উঠল। ওই চোখে কি রাগ-ক্ষোভ বা ঘৃণা জ্বলজ্বল করে উঠল? অর্ণবের বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় চলছে।

পারমিতা জানতে চাইল, ‘আমার বিয়ের মিথ্যা খবরটি কি তোমার বানানো? আমি কি কখনও তোমার কাছে কিছু চেয়েছিলাম? আর কত আমাকে আঘাত দেবে? আর কতটা কষ্ট পেলে তোমার তৃপ্তি হবে?’

পারমিতার কথায় এক সঙ্গে হাজারটা পাহাড় ধসে পড়লো ওর চেতনায়। ওর বোধশক্তিতে চিনচিনে ব্যথা ছড়িয়ে যাচ্ছে। এ সব কি বলছে ও! পারমিতাকে অর্ণব কষ্টও দেয়নি, আঘাতও করেনি। বরং সে নিজে কষ্ট পেয়েছে পারমিতাকে হারিয়ে। এখন ও কী বলছে? ঝড়ো হাওয়ার মতো প্রশ্ন এসে ওকে জেঁকে ধরে। অর্ণব কয়েক মুহূর্ত বিষণ্ন চোখে তাকিয়ে থাকে পারমিতার চোখের দিকে। ও মনে মনে ঠিক করে নেয়, আজ তার মনের কষ্টের কথাও পারমিতাকে জানিয়ে দেবে। অর্ণব বলল, ‘তুমি কি বলছো, ঠিক বুঝতে পারছি না। আমি কবে, কীভাবে তোমাকে কষ্ট দিলাম। বরং আমাকে একটিবারও জানাওনি কী অপরাধে আমাকে তুমি ছেড়ে গিয়েছিলে। তোমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে আমি কতদিন, কতবার তোমাকে ফোন করেছি। এসএমএস করেছি প্রতিদিন। কোনও জবাব পাইনি। একদিন তোমার বোনকে ফোন করলাম, তিনি জানালেন তোমার বিয়ে হয়ে গেছে। আমি যেন আর তোমাকে কখনো বিরক্ত না করি। ব্যস, আমার পৃথিবীটা ওলট-পালট হয়ে গেল। আমি মেনে নিয়েছি আমার পরাজয়! অথচ তুমি আজ বলছ, আমি তোমাকে কষ্ট দিয়েছি? আমি মিথ্যাচার করছি!’

অর্ণবের কথাগুলো চৈত্রের তপ্ত দুপুরের ঝরাপাতার মতো মর্মর ধ্বনি তুলল পারিমতার অনুভবে। ওর চোখে অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া একটি ঝর্ণা পথ খুঁজে পেল যেন। সে ঝর্ণার চঞ্চলতা সামলে নিয়ে বলল, ‘এসব কি বলছো? আমি তো এসব কিছুই জানি না। আমার বিয়ে তো হয়নি কখনও!’

শুধু পাহাড় নয়, এ কথায় আকাশও ভেঙে পড়ল যেন। অর্ণব বোকার মতো তাকিয়ে রইল পারমিতার মুখের দিকে। অর্ণব ছয় বছর আগে পারমিতাকে একদিন চমকে দিতে চেয়েছিল। সে যেদিন মার্কিন দূতাবাসে স্টুডেন্ট ভিসার ইন্টারভিউয়ের জন্য গিয়েছিল, সেদিন তাকে গুলশানে একটি রেষ্টুরেন্টে ওকে অপেক্ষা করতে বলেছিল। মার্কিন ভিসার বিষয়টি পারমিতার কাছে গোপন রেখেছিল অর্ণব। ভিসা পেলে ওইদিনই পারমিতাকে বিয়ে করার পরিকল্পনা ছিল ওর। এ কথা শুধু ওর বন্ধু জামিল জানত। ভিসা পাওয়ার পর থেকে পারমিতার সেলফোনে বারবার ফোন করেও ওর সঙ্গে কথা বলতে পারেনি। গুলশানের নির্ধারিত রেস্টুরেন্টে গিয়েও পারমিতাকে পায়নি সে। এরপর প্রতিদিনই ও ফোন করত পারমিতাকে। কখনও আর ফোন ধরেনি ও। কয়েকদিন পর অর্ণব উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমায়।

পেছনের কথাগুলো ভেবে নিয়ে অর্ণব বলল, ‘অনেক রাগ-দুঃখ-অভিমান-ক্ষোভ-দহন বুকে চেপে আমি দেশান্তরী হয়েছিলাম। নিউ ইয়র্ক থেকেও আমি তোমার খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তুমি আমার ফোন কখনও ধরোনি।’

অর্ণবের কথা শুনে বিষণ্নতা ছড়িয়ে পড়ে পারমিতার চোখে-মুখে। ও বলে, ‘তুমি কী জানো না, সেদিন আমার কী হয়েছিল?’

‘না। কী হয়েছিল?’
কৌতুহল প্রকাশ করে অর্ণব।

‘সেদিন তুমি আমাকে গুলশান থেকে উত্তরা নিয়ে যেতে জামিলকে পাঠিয়েছিলে না?’ জানতে চাইল পারমিতা।

অর্ণব বলল, ‘না তো! সেদিন জামিল তো আমার সঙ্গে দূতাবাসে গিয়েছিল। ওর কাছে আমার সেলফোন রেখেছিলাম। সেদিনের পর থেকে জামিলের দেখা আমি পাইনি! কী হয়েছিল সেদিন, বলো তো!’

পারমিতার বুকের ভেতর যে কান্না পাথর চাপা, সেই কান্নাটা সুনামি হয়ে নামতে চাইছে। কিন্তু ও আর কাঁদতে চায় না। কোনও পুরুষের সামনে ও কেঁদে নিজেকে ছোট করতে চায় না। ও কান্না সামলে নেয় প্রবলভাবে। দাঁত দিয়ে নিচের একটি ঠোঁট কামড়ে ধরে। অর্ণব ওর দিকে উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থেকে তাগিদ দেয়, ‘বলো, সেদিন কী ঘটেছিল? আমি জানতে চাই।’

পারমিতা নিজেকে শক্ত করে। ওর ভেতরে প্রবল ভাঙন হচ্ছে। অর্ণবের চোখে চোখ রেখে সে বলে, ‘তোমার সেলফোন থেকে একটা এসএমএস আসে যে, আমি যেন জামিলের সঙ্গে উত্তরা চলে যাই। তুমি, আমার জন্য উত্তরা অপেক্ষা করছ। আমাকে সারপ্রাইজড করার কথা তুমি আগেরদিন বলেছিলে। এসএমএসটি পাওয়ার আধঘণ্টার মধ্যে জামিল চলে আসে। এরপর তার সঙ্গে আমি একটি গাড়িতে চড়ে উত্তরা যাই।’ এই পর্যন্ত বলে থেমে যায় পারমিতা।

অর্ণবের অনুভূতিতে কেউ যেন গরম তরল কিছু ঢেলে দিয়েছে। সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকে পারমিতার দিকে। কয়েক মুহূর্ত পর অষ্পষ্ট কণ্ঠে বলে, ‘থামলে কেন, বলো।’

পারমিতা এবার অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বলল, ‘সেদিন জামিল আমাকে একটি বাসায় নিয়ে যায়।’

‘বাসায় নিয়ে যায় মানে? এরপর কি হয়েছে?’ রাগের উত্তাপ অর্ণবের কণ্ঠে।

পারমিতা মাথা নিচু করে বলে, ‘সেদিন আমি ধর্ষিত হই, অর্ণব!’

কথাটা না জানলেই যেন ভালো হতো অর্ণবের। পৃথিবীতে এরচেয়ে কষ্টের কথা কী হতে পারে? কথাটা শোনার পর কয়েক মুহূর্ত স্তম্ভিত হয়ে যায় সে, এরপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। বুক চাপড়িয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল অর্ণবের। রেস্টুরেন্টের কক্ষে এভাবে কান্না করা ঠিক হবে না ভেবে ও ফুপিয়ে কাঁদতে থাকে। দৃশ্যটা যেন উল্টো, অর্ণব কাঁদছে আর পাথর চোখের দৃষ্টি মেলে পারমিতা তাকিয়ে আছে ওর মুখের দিকে। এক সময় পারমিতা ওর ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে দিয়ে বলল, ‘তুমি এতো কাঁদছো কেন? চোখের জল মুছে ফেল।’

অর্ণব ওর কাছ থেকে রুমাল নিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলে, ‘এরপর আর কি জানতে চাইব? তোমরা জামিলের বিরুদ্ধে মামলা করোনি?’

পারমিতা স্মিত হেসে বলল, ‘বাংলাদেশে ক’টা ধর্ষিতা মেয়ে মামলা করে বলো? আর যারা করেও তাদের পাশে সমাজ থাকে না। বরং নিন্দা-ঝড়ে ওই মেয়েটির জীবন বিষিয়ে ওঠে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে আমাদের পাশে আইনও নেই!’

পারমিতার কথার সঙ্গে তর্ক করল না অর্ণব। এখন তর্ক করে লাভও নেই। ও বলল, ‘এত বড় ঘটনাটি আমি জানতে পারলাম না! আজ ছয় বছর পর ঘটনাক্রমে তোমার সঙ্গে দেখা হলো বলে তা জানলাম। আমার নিজেকে ভীষণ অপরাধী লাগছে, পারমিতা!’

ওর কথার জবাবে পারমিতা বলল, ওর কথার জবাবে পারমিতা বলল, ‘আমি বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ছিলাম। এই ঘটনার পর খুব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি। মাস্টার্সটা আর দেয়া হয়নি আমার। আমি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলাম। প্রায় দু’বছর একজন মনোবিজ্ঞানী আমার চিকিৎসা করেছেন। সেদিনের পর থেকে আমার সঙ্গে কোনও সেলফোন ছিল না। তোমার সঙ্গে আমি যোগাযোগ করার চেষ্টাও করিনি। তোমাকে আমি ভুলে যাবার চেষ্টা করেছি অর্ণব। আমি জানতেও পারিনি তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো। কী হবে জেনে, বলো? একটি নষ্ট মেয়ের জীবনের ছায়া তোমার উপর পড়ুক, আমি আজও তা চাই না।’

পারমিতার কথাগুলোর মধ্যে পৃথিবীর তাবৎ কষ্ট যেন চেপে আছে। অর্ণবের বুকের ভেতর কান্নার ঢেউ উথলে আসে। ও সামলে নেয়, বলে, ‘বুঝতে পারছি, এরপর থেকে পুরুষদের প্রতি তোমার ঘৃণা জন্মেছে।’

জবাবে পারমিতা বলে, ‘প্রচণ্ড ঘৃণা করি! পুরুষ মানুষকে আমার জন্তু মনে হয়। পুরুষ মানুষ দেখলে আমার গা গুলিয়ে আসে। এ কথাটাই তোমার বন্ধু রায়হানকে বলতে এসেছি। আমি তাকে বিয়ে করতে পারব না। বাবা-মা’র মুখ দেখে খারাপ লাগে। তাই রায়হানের সহায়তা নিয়ে বিয়েটা যদি ভেঙে দেওয়া যায়, সে কথা চিন্তা করেই এখানে এসেছি। তিনি কি আমার কথা রাখবেন?’

অর্ণবের কাছে জানতে চাইলো পারমিতা। এতো কষ্টের মধ্যেও না হেসে পারল না অর্ণব। ও ম্লান হেসে বলল, ‘রায়হানের কথা বাদ দাও। ওর সঙ্গে তোমার বিয়ে হবে না।’

‘সত্যি! তুমি একটু হেল্প করো, প্লিজ!’ পারমিতা দু’হাত জোড় করে অনুরোধ জানায়। .

অর্ণবের বুকের ভেতরে পারমিতার জন্য অপার্থিব মায়া প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ও বলে, ‘কিন্তু তোমার বাবা-মা যেদিন বিয়ের তারিখ ঠিক করেছেন, সেদিনই তোমার বিয়ে হবে। তবে এই বিয়ে রায়হানের সঙ্গে হবে না, হবে আমার সঙ্গে!’

এ কথায় হচকিয়ে যায় পারমিতা। ও কয়েকমুহুর্ত হতভম্বের মতো তাকিয়ে থেকে বলে, ‘কী আবোল-তাবোল বকছো! আমি একটি নষ্ট মেয়ে!’

অর্ণবের ভেতরে ভালবাসার ঘূর্ণিঝড় অনেকদিন পর পাকিয়ে ওঠে। ও বলে, ‘তুমি নষ্ট মেয়ে নও। যে পুরুষ তোমার সম্ভ্রম কেড়েছে, সে নষ্টমানুষ। সে মানুষরূপী এক জানোয়ার। তার জন্য যে ঘৃণা তোমার মধ্যে জমাট বেঁধেছে, এর জন্য তো সকল পুরুষ দায়ী নয়। আমি তোমার সকল দুঃখ-গ্লানি-লজ্জা-যন্ত্রণার ভার তুলে নিলাম।’

পারমিতা ওর কথার প্রত্যুত্তরে বলে, ‘অর্ণব, তোমার সুন্দর জীবনের সঙ্গে আমি কেন জড়াবো? প্লিজ, ওসব কথা বলো না!’

অর্ণবের বুকের ভেতরে পাকিয়ে ওঠা ঝড়টা বেপরোয়া হয়ে যায়। ও পারমিতার দু’হাত নিজের হাতের মুঠোয় বন্দি করে নেয়। আশ্চর্য, পারমিতার গা গুলিয়ে ওঠে না। অর্ণবের স্পর্শে ওর মধ্যে কেমন যেন শিহরণ খেলে যায়। কুঁকড়ে থাকা কুঁড়ি যেন আকস্মিক পাপড়ি মেলে ধরে। অর্ণব ঘোরলাগা কণ্ঠে বলে, ‘আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। আজ ফিরে পেয়েছি। তোমাকে আর কখনও হারাতে দেব না। ভালোবেসে তোমাকে পুরোটা জীবন আগলে রাখব আমি। যে ঘৃণার লাভা অন্তরের অন্তঃস্থলে রেখে কষ্টের আগ্নেয়গিরি হয়েছে, আমি সেই লাভাস্রোতে ভালোবাসার ফল্লুধারা বইয়ে দেব। এ আমার প্রতিজ্ঞা!’

নিজের মুঠোয় থাকা পারমিতার দু’হাতে চুমু খায় অর্ণব। বড্ড পবিত্র এই স্পর্শ। এই স্পর্শে পথ খুঁজে পেয়ে পাহাড়ী ঝর্ণাটা পারমিতার দু’চোখ বেয়ে তরতর করে নেমে আসতে থাকে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension