এশিয়াভারত

চীন-ভারত সম্পর্ক পুনরুদ্ধারে উদ্যোগ: প্রভাব ও সম্ভাবনা কতটুকু

চীন এবং ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের টানাপোড়েনপূর্ণ সম্পর্ক গত সপ্তাহে রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে আলোচনায় আসে। সেখানে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির মধ্যে বহু প্রতীক্ষিত একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

২০২০ সালে লাদাখে সীমান্ত সংঘর্ষের পর প্রতিবেশী দুই নেতার এটাই প্রথম পূর্ণাঙ্গ দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। যেখানে দুই পক্ষই সীমান্ত পরিস্থিতি শান্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।

লাদাখ সীমান্তে সংঘর্ষের পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তীব্র হয়। যার ফলে প্রায় ২০ জন ভারতীয় এবং ৪ জন চীনা সৈন্য প্রাণ হারান।

সম্প্রতি এই সংঘাতের পরিণতি হিসেবে ভারতীয় এবং চীনা সেনাবাহিনীর মধ্যে নতুন চুক্তি হয়েছে। যেখানে উভয় পক্ষ নির্দিষ্ট সময়সূচী অনুযায়ী সীমানা টহল কার্যক্রম পুনরায় চালু করতে সম্মত হয়েছে।

এশিয়ার ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব

ভারত-চীন দ্বন্দ্ব প্রশমনের বিষয়টি এশিয়া ও বৃহত্তর আন্তর্জাতিক রাজনীতিতেও বেশ প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।

এ বিষয়ে ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক জোরাওয়ার দাউলত সিং বলেন, এই সমঝোতা এশিয়ার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূ-রাজনৈতিক উন্নয়ন, যা যুক্তরাষ্ট্রের ঠাণ্ডা যুদ্ধের (কোল্ড ওয়ার) পরিকল্পনা থেকে ভারতকে আলাদা করতে পারে।

ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে চীনের ভূখণ্ডগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং আঞ্চলিক প্রভাবের বিরুদ্ধে একে অপরকে সহযোগিতা করে আসছে। তবে চীন ও ভারতের সাম্প্রতিক এই সমঝোতা ও আলোচনার মাধ্যমে ভারত হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে তার সম্পর্কের দিক নির্ধারণ করতে পারে।

অবিচ্ছিন্ন প্রশ্ন ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ

তবে এই চুক্তির পরেও অনেক বিশ্লেষক সীমান্ত চুক্তির বিষয়ে স্পষ্টতা ও পূর্ণাঙ্গতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ২০২০ সালের সেই সংঘর্ষের পর কিছু অঞ্চলে চীনের প্রভাবশালী উপস্থিতি তৈরি হয়েছিল, যা এখনও অমীমাংসিত বলে মনে করা হচ্ছে।

বিশিষ্ট কৌশলগত বিশ্লেষক মোহন গুরুস্বামী এবং সাবেক সামরিক কর্মকর্তা মেজর-জেনারেল হেমন্ত কুমার সিং এই বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। উভয়ের মতে, এই চুক্তির মাধ্যমে ভারতীয় ভূখণ্ডে চীনা দখল থেকে মুক্তির কোনো নিশ্চয়তা পাওয়া গেছে কি না, তা এখনও অস্পষ্ট।

অর্থনৈতিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ

চীন-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৃহত্তর অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ২০২০ সালের সংঘর্ষের পর ভারত চীনের টিকটকসহ অনেক অ্যাপ নিষিদ্ধ করে এবং চীনা বিনিয়োগের ওপর কড়া নজরদারি শুরু করে।

তবে চীনের সঙ্গে বিনিয়োগ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের জন্য ভারতের অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা জোর দিয়ে বলেছেন যে, চীনের বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ শিল্পক্ষেত্রে কর্মসংস্থান তৈরি করতে এবং ভারতের বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রবেশে সহায়ক হতে পারে।

ভারতের বৈদ্যুতিক যানবাহন, সোলার প্যানেল এবং ব্যাটারি শিল্পে চীনা বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন দেশটির অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, চীনের সঙ্গে নিরাপত্তা ঝুঁকি মুক্ত রাখা সত্ত্বেও অর্থনৈতিক অংশীদারিত্ব বাড়ানো যেতে পারে।

পশ্চিমের জন্য বার্তা!

এদিকে ভারত ও চীনের মধ্যে যখন সমঝোতার বিষয়টি সামনে আসছে, ঠিক তখনই ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কিছু রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিতর্ক চলছে। বিশেষ করে কানাডায় শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর।

এ অবস্থায় ভারত-চীন তাদের সমঝোতা আলোচনার মাধ্যমে সম্ভবত পশ্চিমাদের কাছে একটি বার্তা পাঠাতে চাইছে যে, তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর পৃষ্ঠপোষকতার বিরোধিতা করলেও আঞ্চলিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম।

তবে ভারতের কৌশলগত বিশ্লেষক অনিল ত্রিগুনায়েত মনে করেন, এই সমঝোতার মাধ্যমে উভয় দেশ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করছে, যা কৌশলগত উত্তেজনার মধ্যেও বজায় থাকবে।

(আল জাজিরায় প্রকাশিত সঞ্জয় কাপুরের লেখা অবলম্বনে/দৈনিক যুগান্তরের সৌজন্যে)

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension