ঢাকার জলাবদ্ধতা: ‘দুই মেয়র নাগরিকদের সঙ্গে প্রতারণা করে চলেছেন’
মামুনুর রশীদ
জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসনে বিভিন্ন সময়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের নেওয়া নানা ‘অকার্যকর’ উদ্যোগ ও ‘লোকদেখানো’ তৎপরতার সমালোচনা করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদ ও বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, সত্যিকার অর্থে এই সমস্যার সমাধানে দুই সিটি করপোরেশনের সমন্বিত কোনো পরিকল্পনাই নেই। পরিকল্পনা ছাড়াই বিচ্ছিন্নভাবে তারা বিভিন্ন সময় যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তাতে জনসম্পৃক্ততার কোনো জায়গা ছিল না। যদিও মাঝেমধ্যে একটি-দুটি খাল কিংবা নালার আবর্জনা পরিষ্কার করে বারবার নগরবাসীকে সমস্যা সমাধানে আশ্বস্ত করেছেন মেয়ররা, কিন্তু বাস্তবে সমাধান হয়নি। এভাবে প্রতিনিয়ত দুই সিটির মেয়র নগরবাসীর সঙ্গে প্রতারণা ও প্রহসন করে চলেছেন।
রাজধানীতে গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে টানা কয়েক ঘণ্টার ভারী বৃষ্টিতে বিভিন্ন এলাকার সড়ক ডুবে যায়। জলমগ্ন এসব সড়কে আটকা পড়ে সীমাহীন দুর্ভোগ পোহান নগরবাসী। পানিতে তলিয়ে থাকা রাস্তায় কোথাও কোথাও বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল। অসহায় হয়ে পড়েন পথচলতি মানুষেরা।
এরমধ্যে মিরপুরে কমার্স কলেজ–সংলগ্ন ঝিলপাড় বস্তির বিপরীত পাশে জলাবদ্ধ সড়কে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হন একই পরিবারের চারজন। তাদের তিনজনই মারা যান। ওই পরিবারের সাত মাস বয়সী এক শিশু এখন গুরুতর অবস্থায় ঢাকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। পুলিশের ভাষ্যমতে, এই পরিবারকে বাঁচাতে গিয়ে আরেক তরুণ বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা যান।
বৃষ্টির কারণে সৃষ্ট এই জলাবদ্ধতায় আজ শুক্রবারও দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা।
অথচ গত ১৪ জুন বংশাল এলাকার একটি খেলার মাঠ উদ্বোধনের সময় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস দাবি করেছিলেন, সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকার জলাবদ্ধতা ৭০ থেকে ১০ ভাগে নেমে এসেছে।
মেয়র তাপস সেদিন বলেছিলেন, ‘২০২০ সালেও একটু বৃষ্টি হলে শহর প্লাবিত হয়ে যেত। মনে হতো বন্যা হয়ে গেছে। সেখান থেকে আমরা জলাবদ্ধতা ১০ ভাগে নিয়ে এসেছি।’
এর ১৪ দিন পর ২৯ জুন বৃষ্টিমুখর কোরবানি ঈদের দিন জাতীয় ঈদগাহে উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, রাজধানীতে দুই দিন ধরে যে পরিমাণ বৃষ্টি হয়েছে, সে তুলনায় সড়কে এবার পানি জমেনি। কিছু কিছু জায়গায় জলজট হলেও পানি দ্রুত সরে যাচ্ছে।
সেদিন তিনি আরও বলেন, আগে বৃষ্টি হলে বিভিন্ন জায়গায় আটকে যেতে হতো। এবার উত্তরার বাসা থেকে বৃষ্টির মধ্যেও তিনি জাতীয় ঈদগাহে আসতে পেরেছেন।
জলাবদ্ধতার সমস্যা নিরসন কিংবা তা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুই মেয়রের এমন দাবি ও গতকাল রাতসহ আজকের ঢাকার বাস্তবতা প্রসঙ্গে কথা বলেছে নগরবিদ ও স্থপতি ইকবাল হাবিব, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাম্মানিক সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খানের সঙ্গে।
জলাবদ্ধতার সমস্যা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে দুই মেয়রের সফলতার দাবি প্রসঙ্গে নগরবিদ ইকবাল হাবিব বলেন, ‘এই সমস্ত অঙ্ক যারা দেন, তাদের উচিত এই প্রশ্নের জবাব দেওয়া যে, তারা কোথা থেকে জানলেন ৯০ শতাংশ জলাবদ্ধতা কমে গেছে? এর ভিত্তি কী? রিসার্চটা কোথায়?’
বিভিন্ন সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে দুই সিটি করপোরেশন খাল পরিষ্কার কিংবা দখলমুক্ত করার যে উদ্যোগগুলো নিয়েছে, তার কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন এই স্থপতি। বলেন, ‘রামচন্দ্রপুর খালের অবস্থা দেখে আসেন। পুরো খালটার এমন অবস্থা যে এর আবর্জনার ওপর দিয়ে হেঁটে চলে যাওয়া যায়। একইভাবে কল্যাণপুর খাল, পুরান ঢাকার আটটি খালের সংযোগস্থলের সব জায়গাতেই থকথকে আবর্জনা। যদি নগরীর খাল ও ড্রেনের সঙ্গে নদীর সংযোগ সরাসরি নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে তো জলাবদ্ধতা হবেই। এটাই স্বাভাবিক।’
এ ছাড়া কঠিন ও তরল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দুই সিটির ব্যর্থতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সত্যিকার অর্থে নগরীর তরল ও কঠিন বর্জ্যের ৪৬ শতাংশই সিটি করপোরেশনের বন্দোবস্তের মধ্যেই নেই। এটা সিটি করপোরেশন স্বীকারও করে না। ওয়াসা বছরের পর বছর ধরে বলে বেড়াচ্ছে যে সমস্ত পয়ঃবর্জ্যের ১৫ শতাংশের বেশি তাদের ব্যবস্থাপনার আওতায় নেই। তাহলে এত বছর ধরে এত টাকা খরচ করেও এটাকে অন্তত ৫০-৬০ শতাংশে তারা কেন উন্নীত করতে পারল না।’
‘আপনি যদি অন্যায়কে পুরস্কৃত করেন, জবাবদিহিহীনতাকে তিরস্কার না করে উৎসাহিত করেন, তাহলে অবশ্যই এমন পর্যুদস্ত হওয়ার মতো ঘটনা ঘটবেই। নগরীর নালা উপচে সড়কগুলো খালে পরিণত হবে। কারণ খালগুলো আপনি ভরে ফেলেছেন।’
এর পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে এখন পর্যন্ত দুই সিটির কোনো সুনির্দিষ্ট ও সমন্বিত পরিকল্পনা নেই বলেও মন্তব্য করেন ইকবাল হাবিব। বলেন, ‘কোনো পরিকল্পনা না করেই মাঝে মাঝে লোকদেখানোর মতো করে খালের খণ্ডিত খণ্ডিত অংশ পরিষ্কার করার মধ্য দিয়ে মেয়ররা আমাদের সঙ্গে প্রতারণা ও প্রহসন করে চলেছেন।’
জলাবদ্ধতার সমস্যার সমাধানে নদীর সঙ্গে নালা-খালের নিরবিচ্ছিন্ন সংযোগ নিশ্চিত করতেই হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর মধ্য দিয়ে নিষ্কাশন ব্যবস্থায় এই নগরী ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি অন্তত ধারণ করার ক্ষমতা রাখবে। এখন আমাদের নগর ১০০ মিলিমিটার দূরের কথা, ৩৩-৩৪ মিলিমিটার বৃষ্টিও ধারণ করতে পারে না। অথচ যে পানিটা চুঁইয়ে চুঁইয়ে চলে যায় সেটাকে কৃতিত্বের মধ্যে নিয়ে আত্মশ্লাঘায় ভুগছেন আমাদের মেয়ররা।’
এ বিষয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলামের ভাষ্য হলো, ‘(জলাবদ্ধতার বিষয়ে) জিজ্ঞেস করলে সিটি করপোরেশন বলে যে কাজ হচ্ছে। কিন্তু তা অতটা দৃশ্যমান হয় না। আরও বেশি তৎপর হতেই হবে।’
এই নগরবিদ আরও বলেন, ‘এটা অনেকদিনের পুঞ্জীভূত সমস্যা। ভাগ্য ভালো যে এরমধ্যে অত ভারী বৃষ্টি হয়নি। গতকাল হয়েছে। তাতেই তারা ধরা পড়েছে।’
নগর গবেষণা কেন্দ্রের সাম্মানিক সভাপতির বক্তব্য হলো, ‘আমি দেখি যে তারা (দুই মেয়র) মাঝেমধ্যেই এক্সপার্টদের সঙ্গে বসেন। কিন্তু বসার পরে সেই পরামর্শগুলো কার্যকর করা হয় কি না, আর কার্যকর করার মতো তাদের সেই সক্ষমতা, জনবল ইত্যাদি আছে কি না—তা নিয়ে সংশয় আছে।’
এ বিষয়ক আলোচনায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘পরিকল্পনার দিক থেকে আদর্শ একটি শহরে বৃষ্টি হলে তার অন্তত ৪০ শতাংশ পানি মাটির ভেতর চলে যাওয়ার কথা। এর ৫০ শতাংশ হয়তো (খাল-নালার মাধ্যমে) রানআউট হতে পারে। আমাদের তো ৯০ শতাংশই রানআউট। এ জন্য দুয়েকটি কাজ করেই যদি কেউ মনে করেন আগামী বর্ষায় জলাবদ্ধতা থাকবে না, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’
জলাবদ্ধতা সমস্যা নিরসনে দুই মেয়রের আশ্বাসের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘মেয়ররা যখন বারবার করে বলছিলেন যে জলাবদ্ধতা থাকবে না, তখন আমরাও বারবার বলেছি যে, তারা হয়তো কিছু কাজ করেছেন, তাতে তাদের সন্তুষ্টি থাকতে পারে। কিন্তু বৃষ্টি হলে ঢাকায় জলাবদ্ধতা থাকবে না—এই বাস্তবতা থেকে ঢাকা অনেক দূরে।’
‘জলাবদ্ধতা নিরসনে যে সাফল্যের গল্প মেয়ররা বলে আসছেন, তা অনেকটা রাজনৈতিক বক্তব্যের মতো’ বলেও মন্তব্য করেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক এই সাধারণ সম্পাদক। বলেন, ‘নগর পরিকল্পনার যে ক্ষেত্রটা ঢাকায় তৈরি হয়েছে তাতে ওনারা (মেয়ররা) চাইলেও এটাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে পারবেন না। কেননা ওনারা তো পরিকল্পনার বিষয়টি ডিল করেন না। পরিকল্পনা করে রাজউক। ওনারা কেবল কিছু ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
‘এখন ওনারা যদি অল্প কিছু খালের ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করে মনে করেন যে ঢাকার জলাবদ্ধতা চলে গিয়েছে, সেটা একদম ভুল। কেননা ঢাকার নগর পরিকল্পনার বেসিক জায়গাটিতেই মূল গণ্ডগোলটা করে ফেলা হয়েছে।’
তাই তিনি জোর দেন ঢাকার উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ অর্থাৎ ডেভেলপমেন্ট কন্ট্রোলের ওপর। বলেন, ‘ঢাকার ডেভেলপমেন্ট কন্ট্রোলের জন্য সরকারের কোনো মেকানিজম গত ১০-১৫-২০ বছর কাজ করছে না। সরকারও সেটা চাচ্ছে না।
‘যেখানে আদর্শগতভাবে একটি শহরের ২৫ শতাংশ সবুজ থাকার কথা, ১৫ শতাংশ জলাশয় থাকার কথা ঢাকায় তা ৫ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। তাহলে বেসিক স্ট্র্যাকচারের গণ্ডগোলটা তো থেকেই যাচ্ছে।’
দ্য ডেইলি স্টারের সৌজন্যে