বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির আরেকটি অধ্যায়ের নাম স্টারলিংক


মো. জাহিদুল ইসলাম


সম্প্রতি স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা নিয়ে বিশ্বব্যাপী ব্যাপক আলোচনা চলছে। বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্কের মালিকানাধীন মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স-এর সহযোগী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে স্টারলিংক। বিশ্ব জুড়ে স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা প্রদান করে থাকে তারা। বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা সরবরাহের আগ্রহ প্রকাশ করে ইতিমধ্যে কাজ শুরু করে দিয়েছেন মার্কিন প্রযুক্তি উদ্যোক্তা বিলিয়নিয়ার ব্যবসায়ী ইলন মাস্কের মহাকাশযান নির্মাণ প্রতিষ্ঠান স্পেসএক্স। মূলত স্পেসএক্সের ইন্টারনেট সেবা দানকারী প্রতিষ্ঠান স্টারলিঙ্কের মাধ্যমে এই সেবা দেয়া হবে। স্টারলিংক ইন্টারনেট এখন বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে। সাবমেরিন কেবলের ওপর নির্ভরশীল ইন্টারনেট সেবা থেকে বেরিয়ে এসে স্যাটেলাইট নির্ভর এই সেবার সূচনা দেশজুড়ে ডিজিটাল বৈষম্য হ্রাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের ৭০টিরও বেশি দেশে ৪৬ লাখ গ্রাহক ব্যবহার করছেন স্টারলিংকের স্যাটেলাইট। এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশে স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক ইন্টারনেটের গতি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ২২০ মেগাবিট পার সেকেন্ড (এমবিপিএস) গতি ও সর্বনিম্ন ১৭০ এমবিপিএস গতি পাওয়া গিয়েছিল। স্টারলিঙ্ক হল একটি উপগ্রহ-ভিত্তিক ইন্টারনেট নেটওয়ার্ক, যা স্টারলিঙ্ক সার্ভিসেস, এলএলসি দ্বারা পরিচালিত। এই সংস্থাটি একটি আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ পরিষেবাদাতা এবং আমেরিকান মহাকাশ প্রযুক্তি কোম্পানি স্পেসএক্সের সম্পূর্ণ মালিকানাধীন সহায়ক প্রতিষ্ঠান। এটি বর্তমানে ১০০টিরও বেশি দেশ ও অঞ্চলে পরিষেবা প্রদান করছেন। সম্প্রতি বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম শুরুর ফলে দুর্গম এলাকায় খুব সহজে উচ্চগতির ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা সম্ভব হবে । ফলে ইন্টারনেট-সেবার ক্ষেত্রে গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য একেবারেই ঘুচে যাবে। এর ফলে মানুষ গ্রামে এবং দুর্গম এলাকায় বসেই উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে ইন্টারনেটভিত্তিক সকল কাজ করতে পারবেন। এছাড়াও দুর্যোগের পর দ্রুত যোগাযোগ প্রতিস্থাপনে বড় ভূমিকা রাখবে এই স্টারলিংক। স্যাটেলাইট ইন্টারনেটের শুরু হয়েছে অনেক আগেই। ১৯৮০-এর মাঝামাঝি প্রায় ১০০টি স্যাটেলাইটের মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু। তারপর অনেকে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদান করা শুরু করে। এরপর যতই সময় অতিবাহিত হয়েছে অন্যান্য প্রযুক্তির মতো এই প্রযুক্তিরও উন্নত হয়েছে। ইন্টারনেট হলো মূলত ইন্টারকানেক্টড নেটওয়ার্কের সংক্ষিপ্ত রূপ। অনেকে একে নেটও বলে থাকেন। নেটওয়ার্ক তরঙ্গের মাধ্যমে অসংখ্য কম্পিউটার ডিভাইসকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে তথ্য আদান-প্রদান করার পদ্ধতিকে ইন্টারনেট বলা হয়। বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলেই মানুষ ক্যাবল ইন্টারনেট পরিষেবা ব্যবহার করে থাকে। ক্যাবল ইন্টারনেট সাধারণত সাবমেরিন ক্যাবল বা অপটিক্যাল ফাইবারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হয়। ক্যাবল ইন্টারনেটে ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে কম্পিউটার বা ল্যাটপটে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়। এটি অনেক দ্রুত গতির ও জনপ্রিয় ইন্টারনেট। তবে স্যাটেলাইট ইন্টারনেটর প্রযুক্তির মাধ্যমে কোনো তার ছাড়াই সরাসরি স্যাটেলাইট থেকে গ্রাহকদের ইন্টারনেট সেবা দেয়া সম্ভব। প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রামে যেখানে ফাইবার নেটওয়ার্ক স্থাপন করা কঠিন ঠিক সেখানে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবা দেয়া সম্ভব। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রযুক্তিতে পৃথিবীর যে কোনো স্থান থেকে অন্য কোনো কম্পিউটারের সঙ্গে ইন্টারনেট যোগাযোগ করতে হলে প্রথমে স্টারলিঙ্ক গ্রাহকের কম্পিউটার অথবা মোবাইল থেকে রিকোয়েস্ট কাছাকাছি স্যাটেলাইটে যায়। এরপর সেই রিকোয়েস্ট সেলুলার নেটওয়ার্কের মতো একটা থেকে আরেকটা স্যাটেলাইট হয়ে নির্দিষ্ট সার্ভারে পৌঁছায়। এরপর কাঙ্ক্ষিত তথ্য নিয়ে একই পদ্ধতিতে গ্রাহকের কম্পিউটারে অথবা মোবাইল ফিরে আসে। এভাবে পৃথিবীর যে কোনো স্থানে ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া হয়। এমনকি দুর্গম পাহাড় বা জঙ্গলেও ইন্টারনেট সংযোগ দেয়া যায়। স্টারলিংক এর কাজ করার পদ্ধতি অনেক চমকপ্রদ। স্টারলিঙ্ক অনেকটা স্যাটেলাইট টেলিভিশনের মতো কাজ করে। পৃথিবীর বাইরে অনেকগুলো জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট স্থাপন করা হয়েছে। পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটার দূরের পৃথিবীর কক্ষপথে অবস্থিত এই স্যাটেলাইটগুলোকে জিওস্টেশনারি স্যাটেলাইট বলে। স্টারলিঙ্ক মূলত এই স্যাটেলাইটগুলোর মাধ্যমে ইন্টারনেট সরবরাহ করে। স্টারলিঙ্ক ইন্টারনেটের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অনেক উচ্চ গতির ইন্টারনেট। তারবিহীন হওয়ায় কোনো প্রকার প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে ইন্টারনেটে বিঘ্ন ঘটায় সম্ভবনা নেই। সাবমেরিন ক্যাবল ও ইন্টারনেট তার ছিঁড়ে সেবা ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা থাকলেও স্টারলিঙ্কে সেই আশঙ্কা নেই। এছাড়া যেকোনো জায়গা থেকে এর ব্যবহার করা যায়। কখনও কখনও এর গতি সাধারণত প্রতিশ্রুতির তুলনায় দ্রুত হয়ে থাকে। আবাসিক চাহিদার পাশাপাশি করপোরেট ক্লায়েন্টও রয়েছে স্টারলিংকের। ইতোমধ্যে তারা বিস্তৃত পরিসরে ব্যবসায়িক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে তাদের সেবা রয়েছে এয়ারলাইনস, জাহাজ, বিনোদনমূলক যানবাহন, ও ট্রাকসহ নানা ধরণের পরিবহনে। স্যাটেলাইটগুলোর মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ রক্ষার্থে গেটওয়ে হিসেবে বসানো হয় গ্রাউন্ড স্টেশন। এগুলো উপগ্রহ থেকে ডেটা গ্রহণ করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পথ সুগম রাখে। একটি গ্রাউন্ড স্টেশন সাধারণত ৪,৩০৬ বর্গফুট জায়গা জুড়ে প্রশস্ত হয়। এখানে বন্ধনীতে ঘেরা থাকে ৯.৪ ফুট উচ্চতার ৯টি অ্যান্টেনা। স্টারলিংকের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে দ্রুতগতির ডাউনলোড সুবিধা। স্টারলিংকের ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য গ্রাহককে টেলিভিশনের ডিশ অ্যান্টেনার মতো একটি যন্ত্র বসাতে হবে। এটি সেই স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। যন্ত্রটি ক্রয়ের সময় এর সঙ্গে পুরো একটি টুলকিট দেওয়া হয়। এতে স্টারলিংক অ্যান্টেনা ছাড়াও থাকে স্ট্যান্ড, স্টারলিংক কেবল, জেন থ্রি রাউটার, এসি কেবল এবং পাওয়ার অ্যাডাপ্টার। অ্যান্টেনা যে কোনো জায়গায় মাউন্টের জন্য উপযোগী। এমনকি ট্রেনের মতো দ্রুতগামী কোনো বস্তুর ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। তবে শর্ত হচ্ছে- আকাশ ও অ্যান্টেনার মাঝে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকা যাবে না। এই অ্যানটেনার সঙ্গে স্টারলিংকের রাউটারটি যুক্ত করে গ্রাহক ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। এই টুলকিট এবং গ্রাউন্ড স্টেশন সম্মিলিত ভাবে স্টারলিংককে সম্ভাবনাময় করে তুলেছে। কেননা এতে করে দুর্গম পাহাড় বা জঙ্গলেও উচ্চগতির ইন্টারনেট সংযোগ স্থাপন সম্ভব হবে। স্পেসএক্সের মালিকানাধীন স্টারলিংক মূলত লো-আর্থ অরবিট (এলইও) স্যাটেলাইট ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে। স্টারলিংকের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যানুযায়ী, স্টারলিংক কিটে একটি রিসিভার বা অ্যান্টেনা, কিকস্ট্যান্ড, রাউটার, ক্যাবল এবং পাওয়ার সাপ্লাই থাকে। এ কীটের দাম ৩৪৯-৫৯৯ মার্কিন ডলারের মধ্যে। বাংলাদেশে এর সম্ভাব্য দাম ৬০-৭০ হাজার টাকা হতে পারে। এরপর প্রতি মাসে সাবস্ক্রিপশন ফি দিতে হবে। এই ফি প্রায় ১২-১৭ হাজার টাকা হতে পারে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্টারলিংককে বিশ্বের যে কোনো অঞ্চলে সেবা প্রদানের জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের বিধি-নিষেধ মেনে চলতে হয়। সেখানকার জাতীয় টেলিযোগাযোগ কর্তৃপক্ষের অনুমতির পরেই সেবার বিপণন শুরু হয়। এর জন্য স্টারলিংক নির্দিষ্ট দেশের সঙ্গে দীর্ঘস্থায়ী আন্তর্জাতিক চুক্তিতে যায়। এই চুক্তির মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকে লাইসেন্সিং-এর সাধারণ সময়সীমা এবং করনীতি। বাংলাদেশে স্টারলিংক ইন্টারনেটের পরীক্ষামূলক যাত্রা ডিজিটাল পরিসরে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। এই সেবা দেশব্যাপী উচ্চগতির ইন্টারনেট সহজলভ্য করতে সহায়ক হবে। বর্তমানে এটি বাংলাদেশের জন্য প্রযুক্তিতে সমতা প্রতিষ্ঠার পথে বড় এক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
নেটওয়ার্ক টেকনিশিয়ান (আইসিটি সেল), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension