
[পূর্বে প্রকাশের পর]
ইতালির বারগুলোর আড্ডার প্রধান বিষয় ফুটবল, তারপর অন্য কিছু। সিনিওরে রবের্তো এ এস রোমার (রোমের ফুটবল ক্লাব) ভক্ত; আর এখানে ভক্ত বলতে সবাই অন্ধ ভক্ত। হাসান নিজেও রোমার ভক্ত, সে আসলে সিনিওরে রবের্তোকে কষ্ট দিতে চায় না। রোমা যেদিন হেরে যায়, সেদিন থেকে পরবর্তি দুইদিন সিনিওরে রবের্তোর মন খুব খারাপ থাকে। হাসান যখন বারে যায় উনি তখন একজন অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞের মতো হাসান কে ব্যাখ্যা করে: কেন রোমা হারলো? কেন মনতেল্লা ভালো খেলতে পারেনি? তত্তি একাই বা আর কত খেলবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আর হাসান একজন মনোযোগী শ্রোতার মতো তার সমস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শোনে এবং একমত পোষণ করে। যেদিন রোমা জিতে যায়, সেদিনের কথাই আলাদা; সিনিওরে রবের্তোর খুশীর সীমা থাকে না, হাসানকে কফি অফার করে; স্মৃতির বাক্স নিয়ে বসে হাসানের সামনে। সিনিওরা (মিসেস) রবের্তো বার কাউন্টারে বসে সব দেখেন ও হাসতে থাকেন। হাসানও উৎসাহ দেয়, আহ, কী খেললো আজ রোমা! বারে বসে এভাবে আনন্দমুখর পরিবেশে সময় কেটে যায়, সাথে ব্যবসাও চলে। ইতিমধ্যে ওবুদু এসেছে, কয়েকজন বাঙালী ও পাকিস্তানী খুচরা ব্যবসায়ীও এসেছে; সবাই মিলে প্রায় হাজারখানেক সিডি নিয়ে যায়। দুপুর হয়ে গেছে, সিডির ব্যাগটাও প্রায় খালি, সিনিওরে রবের্তোর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হাসান বাসায় চলে আসে।
ব্যাগটা জায়গা মতো রেখে টাকা হিসাব করে হাসান; আগের বিক্রির টাকা এবং আজকের টাকা মিলিয়ে মোট পনেরো হাজার ইউরো আন্দ্রেয়ার জন্য আলাদা করে রাখে। আরাম করে একটা সিগারেট ধরিয়ে আন্দ্রেয়াকে ফোন দেয়; কোন কোন সিডি আনতে হবে বিস্তারিত আন্দ্রেয়াকে বুঝিয়ে বলে। সাধারণত সন্ধ্যার পরে আসে আন্দ্রেয়া, কিন্তু আজ তার একটা কাজ আছে রোমে, তাই বিকালে হাসানকে রেডি থাকতে বলে।
হাসান, কত ইউরো আছে?
পনের হাজার।
ব্রাভো।
আলাপ শেষে গোসল করে খাওয়া-দাওয়া সেরে বিছানায় হেলান দিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা করতে থাকে। আন্দ্রেয়া না আসা পর্যন্ত কোথাও যাওয়া যাবে না, তাই এই ফাঁকে একটু ঘুমিয়ে নিলে ভালো হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রে অন্য কাউকে দিয়ে সিডি পাঠিয়ে দেয় আন্দ্রেয়া; হাসানের গেটের সামনে সিডির কার্টুনগুলো নামিয়ে দেয়। দুই-তিনটা কার্টুন, এবং ওজনেও বেশ ভারী থাকে বিধায়, হাসান সব সময় তার কোন না কোন রুম মেটের সাহায্য নেয়। প্রতি চালান বিক্রি করতে কম-বেশি এক সপ্তাহ সময় লাগে; মাঝে মাঝে তার আগেও হয়ে যায়, এটা নির্ভর করে মার্কেটের চাহিদার উপর। আন্দ্রেয়ার ফোন পেয়ে গেটের সামনে দাঁড়ায় হাসান; পাঁচ মিনিটের মধ্যে আন্দ্রেয়া আসে। মালগুলো বাসায় রেখে আসে হাসান, আর আন্দ্রেয়া বলে, চলো, বারে গিয়ে বসি।
চলো, যাওয়া যাক।
দুজনে সিনিওরে রবের্তোর বারে গিয়ে বসে।
কী খাবে, আন্দ্রেয়া?
শুধু কফি।
তারপর কফি খেতে খেতে আন্দ্রেয়া শুরু করে, হাসান, মেয়েটি কে?
কোন মেয়ে?
দুদিন ধরে তুমি যাকে নিয়ে ঘুরছো!
ওর নাম ভ্যালেন্তিনা।
আচ্ছা।
তুমি তা হলে এই জন্যে আমাকে ডেকেছ?
ওর বাসা কোথায়?
আমার বাসার কাছেই।
তোমাদের পরিচয় হলো কীভাবে?
বার আমিগোসে।
প্রথম পদক্ষেপ কার?
ভ্যালেন্তিনা এসে আমার কাছে বিয়ার খেতে চেয়েছিল।
ও আচ্ছা; হাসান, আমি তোমার ভালোর জন্য বলছি। ভ্যালেন্তিনার ব্যাপারটা কি তোমার স্বাভাবিক মনে হচ্ছে?
আমিও ভেবেছি, তবু দেখি না।
হাসান, আমার তো মনে হয় তুমি কোন জালে জড়িয়ে চাচ্ছো।
কেন, আমি একজন বিদেশী, আর আমার বান্ধবী একটি সুন্দরী ইতালিয়ান মেয়ে, তাই কি এই কথাগুলো আসতেছে?
না, হাসান। তুমি একজন মাফিয়া, তাই বলছি। আমার তো মনে হয় তুমি আমার চাইতে বড় মাফিয়া; তোমার কেসগুলোর কথা তুমি ভুলে যাচ্ছ কীভাবে? আর ইতালিতে পুলিশ যখন কোন মাফিয়াকে ধরতে হিমশিম খায়, তখন তার পিছনে সুন্দরী নারী লাগিয়ে দেয়; তোমার ব্যাপারটা আমার সেই রকম মনে হচ্ছে।
আমি কাপুরুষ নই, ভয়ও পাচ্ছি না। যদি তাই হয়, তুমি যেমন ভাবছো; তবে তারা বুঝবে আমি আসলে মাফিয়া নই, একজন প্রেমিক।
ব্যাপারটা এত হালকা ভাবে নিও না, হাসান। আর আমি যদি তোমার সাথে ব্যবসা না করি? তখন তুমি কী করবে?
তুমি কি আমাকে নিয়ে ভয় পাচ্ছো? আমার সাথে যদি তুমি ব্যবসা না করো, তবে কিছু একটা তো আমাকে করতে হবে।
হাসান, আমরা নাপোলিতান। আমাদের অভিধানে ভয় বলে কোন শব্দ নেই। আমাদের ধর্ম হলো তুমি যতক্ষণ আমার সাথে, ততক্ষণ তুমি আমার ভাই; আর যদি পক্ষ ত্যাগ করো, তবে তুমি আমার শত্রু।
আন্দ্রেয়া, দেখ, আমার মনটা ভালো নেই; হয় আমাকে গুলি করো, না হয় আমার সাথে ব্যবসা করো, অথবা আমায় যেতে দাও। তবে এটা ধরে নিও, আমার দ্বারা তোমার কোন ক্ষতি হবে না।
চমৎকার, দুদিনের ভ্যালেন্তিনার জন্যে তুমি গুলি খেতে প্রস্তুত, তাহলে ব্যবসা করবে কী করে?
ব্যবসার সাথে তো ভ্যালেন্তিনার কোন সম্পর্ক নেই।
ঠিক আছে, হাসান। তোমার ভ্যালেন্তিনার সুস্বাস্হ্য কামনা করে আর একটা কফি হয়ে যাক।
আশ্বস্ত হলাম, আন্দ্রেয়া।
কিন্তু সাবধানে থাকবে হাসান, বড়ভাই হিসাবে বলছি; ভ্যালেন্তিনার ব্যাপারটায় সাবধানে পা ফেলবে।
তুমি ইতালিয়ানদের চেনো না, কোন সমস্যা হলে আমাকে জানাবে।
তোমার উপদেশ আমি মনে রাখবো।
সিডি শেষ হলে ফোন দিও।
কফি শেষ করে আন্দ্রেয়া চলে গেছে, হাসান বসে সিগারেট টানছে; তার মুখে চিন্তা, আর দুশ্চিন্তার ছাপ ফুঁটে উঠেছে। হাসান নিজের কাছে প্রশ্ন করে, ইনিয়াসের মতো তুমিও কি পালিয়ে যাবে, নাকি ভেসে যাবে ভ্যলেন্তিনার ভালোবাসার ভেলায়? আত্মার অন্তঃস্থল থেকে উত্তর ভেসে আসেভ্যালেন্তিনা তোমার নিয়তি!
আন্দ্রেয়া চলে যাবার পরে সিনিওরে রবের্তো জানতে চায়, কী ছেই (কে উনি)?
মিও কাপো (আমার বস)।
হাসানের মন খুব খারাপ, অথচ এখন তার খুশি থাকার কথা। গতকালের স্বপ্নময় রাতের রেশ তো এত তাড়াতাড়ি কাটবার নয়; কিন্তু তবুও কেন সে এত বিষণ্ন তা বুঝতে পারে না। এটা কি ভ্যালেন্তিনাকে হারাবার ভয়? আান্দ্রেয়া এখন যেটা বলে গেল, তার কয়েকজন বন্ধুরাও কিন্তু হাসানকে সেটাই মনে করিয়ে দিয়েছে। তার নিজের মনেও যে এই ধরণের সন্দেহ হয়নি, তা নয়; তাই তো পুলিশের কাছে যে নাম্বার দেওয়া আছে, ভ্যালেন্তিনাকেও সেই নাম্বারটাই দিয়েছে সে। হাসান ভালো করেই জানে ভ্যালেন্তিনার সঙ্গে তার সমস্ত কথোপকথোন রেকর্ড হবে, আড়িপেতে শুনবে ক্যারাবিনিয়েরি (ক্রিমিনাল পুলিশ)। ভ্যালেন্তিনা যদি তাদের চর হয়, তো হোক; আর যদি সেই জাতীয় কিছু না হয়, তবে তারাও শুনবে হাসানের ভালোবাসার কথা। এবং বুঝবে তাদের চোখে যে ক্রিমিনাল, তারও একটা মন আছে; সে-ও একটা মেয়েকে ভালবাসে, যার নাম ভ্যালেন্তিনা। একদিকে সন্দেহ-অবিশ্বাস, অন্যদিকে ভ্যালেন্তিনায় পাগলপারা; সবকিছু মিলিয়ে এক নিদারুণ কষ্ট অনুভব করে হাসান। যে কষ্টের কথা কারো সাথে ভাগাভাগি করতে পারে না সে; কী করবে এখন? মনে একটা জেদ চেপে যায়। সে তো ভীত নয়, পলাতক নয়, কাপুরুষও নয়; সবচেয়ে বড় কথানিয়তির পাশা খেলার শুরুতেই সে হেরে যেতে চায় না, এর শেষ দেখতে চায় হাসান। সবাই যে ধারণা করছে, তেমনটা না-ও হতে পারে! সে তার যৌবন উপভোগ করছে নিজের মতো, নিজের মর্জি মাফিক; এখানে একটা মেয়ে এসে তার দিকে হাত বাড়াতেই পারে!
প্রন্ত, হাসান (হেলো, হাসান)।
প্রন্ত, ভ্যালেন্তিনা।
দোভে ছেই (তুমি কোথায়)?
ভিচিনো আ কাছা (বাসার কাছে)।
নন দেবি উসসিরে (বাহির হবে না)?
ছি, চেরতো (হ্যাঁ, অবশ্যই)।
দোভে ব্যাঙ্গো ইও (আমি কোথায় আসবো)?
কে ভোই, ব্যাঙ্গো ইও আ ছোত্তো কাছা তুয়া (কী চাও, আমি কি তোমার বাসার নিচে আসবো)?
গ্রাচ্চে, হাসান, ছেই মোলতো জেনতিলে (ধন্যবাদ, হাসান, তুমি খুব ভদ্র)।
ফা নিয়েন্তে, সি ভেদিয়ামো (ব্যাপার না, দেখা হবে)।
বারের বিল মিটিয়ে ভ্যালেন্তিনার বাসার দিকে রওনা দেয় হাসান।
হাসান গিয়ে দেখে ভ্যালেন্তিনা ইতিমধ্যে বাসার গেটে দাঁড়িয়ে আছে। আজ একটি লং স্কার্ট সঙ্গে সাদা হাত কাঁটা স্কিন টাইট গেজ্ঞি, এবং তার উপরে পাতলা কাপড়ের কালো জ্যাকেট পরেছে ভ্যালেন্তিনা; গলায় মোটা একটা লাল পুঁথির মালা, ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক। সত্যি বলতে কী, ভ্যালেন্তিনার উপর থেকে চোখ ফেরাতেই কষ্ট হচ্ছিল হাসানের। ভ্যালেন্তিনাকে নিয়ে কিছুক্ষণ আগের দারুণ দোলাচল নিমেষে তার মন থেকে উধাও হয়ে গেল। যতটা সম্ভব হাসান নিজেও রুচি সম্মত পোষাক পরার চেষ্টা করে, তবে তার সবচেয়ে বেশি দূর্বলতা চামড়ার জ্যাকেটের প্রতি। শীত-গ্রীষ্ম সব ঋতুর জন্যে তার আলাদা আলাদা চামড়ার জ্যাকেট আছে। যেমন, এই এখন একটা পাতলা কালো চামড়ার জ্যাকেট পরে ঘর থেকে বের হয়েছে সে। ভ্যালেন্তিনার ঠোঁটে আলতো একটা চুম্বন এঁকে দিয়ে হাসান বল্লো, তুমি আমাকে যতই পাগল বলো, তবু তুমি কিন্তু ভীষণ সুন্দরী।
ধন্যবাদ, হাসান।
এ্যালেনা কোথায়?
মায়ের কাছে।
তোমার মা কি জানে, তুমি আমার সঙ্গে বের হচ্ছো।
হ্যাঁ, মাকে বলেছি। হাসান, আজ কি আমরা অন্য কোথাও যেতে পারি?
তুমি যদি চাও অবশ্যই যাব; তবে আপাতত বার আমিগোসে চলো, ওখানে এখন আমার একজন বন্ধু আসবে, আমাকে কিছু ইউরো দিতে; ওটা নেবার পরে না হয় যাওয়া যাবে।
ঠিক আছে, চলো।
আসলে আমিন নামের একজন বাংলাদেশী বন্ধুর কাছে সিডি বিক্রির কিছু টাকা পাওনা আছে; খুবই ভদ্র ও নিরীহ ছেলে। সারাদিন বিচে ঘুরে ঘুরে সিডি বিক্রি করে, তাই সন্ধ্যা ছাড়া হাসানের সাথে দেখা করার সময় পায় না সে। হাসান সাধারণত কাউকেই বাকিতে সিডি বিক্রি করে না, কিন্তু ব্যাতিক্রম এই আমিন; সে আগে সিডি নিয়ে বিক্রি করে, তারপর হাসানের টাকা দেয়। ভদ্র এবং বিশ্বস্ত বিধায় হাসান আমিনকে এই বিশেষ সুযোগটি দিয়েছে; আর আমিনও লেনদেনের সততা নিষ্ঠার সাথে বজায় রেখেছে।
আজ ভ্যালেন্তিনাকে সাথে নিয়ে একত্রে বার আমিগোসে গিয়ে একটা ফাঁকা টেবিলে বসে হাসান। ইউরোপিয় সৌজন্যতা দেখিয়ে, একটা চেয়ার টেনে ভ্যালেন্তিনাকে বসিয়ে, তারপর বসে হাসান; সিনেমাটিক ব্যাপার আর কী। হাসানের ব্যবহারে মুগ্ধ ভ্যালেন্তিনা। মার্কো এসে ওদের সাথে হাই-হেলো করে যায়; ভ্যালেন্তিনা থাকায় সে হাসানের সঙ্গে কোন ফাজলামো করে না; তাই হাফ ছেড়ে বাঁচে হাসান। কিছুক্ষণ পরে সান্দ্রা আসে, দুজনের সাথে সৌজন্য বিনিময় করে ভ্যালেন্তিনাকে বলে, যাক, এতদিন পরে হাসানকে হাসি-খুশি দেখে ভালো লাগছে; আগে ও চুপচাপ বসে বিয়ার পান করতো, তারপর চলে যেতো; আর এখন তো ওর মুখ থামতেই চায় না।
ধন্যবাদ, সান্দ্রা।
মুচকি হেসে ভ্যালেন্তিনা উত্তর দেয়।
আর আমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য তোমাকে ধন্যবাদ, সান্দ্রা।
তিনজন একত্রে হেসে ওঠে।
তো এবার বলো, তোমাদের জন্য কী করতে পারি?
আমার খুব ক্ষুধা পেয়েছে; রোজ রোজ ত্রামাজিনো খেতে ভালো লাগে না, অন্য কিছু থাকলে এক পিছ দিতে পারো। আর ভ্যালেন্তিনা, তুমি কী খাবে?
কিছু না, কফি।
কিছুক্ষণ পরে সান্দ্রা ভ্যালেন্তিনার জন্য কফি, এবং হাসানের জন্য বার্গারের মতো একটা রুটি (ভিতরে চিজ, সালাত, ডিমের স্লাইজ) নিয়ে আসে।
সান্দ্রা, যদি কিছু মনে না করো, তবে দুইটা বিয়ারও দিতে পারো।
হাসান আয়েশ করে রুটি খাবার পর বিয়ারে চুমুক দেয়, আর ভ্যালেন্তিনা হাসি মুখে তা দেখতে থাকে।
কী দেখছ, ভ্যালেন্তিনা?
তোমাকে।
কেন, আমি আবার কী করলাম?
কিছুই করোনি!
অবাক হবার ভান করে ভ্যালেন্তিনা, আর হাসান হাসতে হাসতে বলে, আমার তো কিছুই মনে পড়ছে না।
কেন, কাল সারা রাত আমার শরীর নিয়ে খেলা করোনি?
ও আচ্ছা, ভিখারীদের ও কি ডাকাত হতে ইচ্ছা করবে না একদিনও!
আচ্ছা, তবে এই কথা; সুযোগ পেলেই তুমি ডাকাতি করবে আমায়?
না, তা নয়; আমি হচ্ছি ভদ্র ডাকাত। তোমার অনুমতি ছাড়া তোমার ঘরে আমি কখনোই পা দেবো না।
আমি ভেবেছিলাম তুমি নিরীহ প্রকৃতির; কিন্তু এখন দেখছি তুমি দুষ্টু প্রকৃতির শয়তান।
ধন্যবাদ, আমাকে চিনতে পারার জন্যে।
ভ্যালেন্তিনাকে একটা সিগারেট ধরিয়ে দিয়ে, নিজেও একটা সিগারেট ধরায় হাসান। এমন সময় আমিন ভাই আসে; হাসান ইশারায় বসতে বলে; ভ্যালেন্তিনার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় হাসান; ভ্যালেন্তিনা হাত বাড়িয়ে করোমর্দন করে। হাসানকে পাঁচ হাজার ইউরো দেয় আমিন ভাই, হাসান বলে, ভাই, কাল সকাল সকাল আসবেন; নতুন মাল এসেছে, যা লাগে নিয়ে যাবেন।
ঠিক আছে।
ভাই কফি দিতে বলি? ব্যবসা কেমন চলছে?
ভালোই।
আপনার যদি কোন স্পেশাল অর্ডার থাকে, তবে একটা লিষ্ট করে আনবেন। যেগুলো থাকবে নিয়ে যাবেন, বাকী আমি আনিয়ে দেব।
ভ্যালেন্তিনা চুপ করে দুজনের কথা শোনে, তবে কিছুই বুঝতে পারে না; আমিন ভাই কফি খেয়ে চলে গেলে সে হাসানকে বলে, হাসান, তোমার তো অনেক টাকা।
অনেক না, তবে চলার মতো টাকা আমার আছে।
চেয়ারের পিছন দিকে হেলান দিয়ে সিগারেট টানছে ভ্যালেন্তিনা, আর বিয়ারে চুমুক দিয়ে হাসান উপভোগ করছে মদিরা ও মায়াবী কন্যার সৌন্দর্য সুধা।
দুজনের বিয়ার শেষ হলে হাসান জানতে চায়, বলো, কোথায় যেতে চাও তুমি?
আমরা কি আজ পাবে যেতে পারি?
তুমি চাইলে অবশ্যই যাব।
তবে চলো যাই।
জো হুকুম, মহারানী!
ভ্যালেন্তিনা হাসানকে পাবে নিয়ে যায়, নাম প্যারাদিসো। এটা বার আমিগোসের কাছেই; অথচ হাসান জানতো না। অবশ্য জানার কথাও না; কারণ আগে কখনো পাবে যায়নি সে, এই প্রথম। কিন্তু হাসান বুঝতে পারে এটা ভ্যালেন্তিনার খুব পরিচিত জায়গা, হয়তো মৌরিচ্ছিওর সাথে এখানে সে অনেকবার এসেছে।
পাব শুধু সন্ধ্যায় চালু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে; এই রাস্তা দিয়ে হাসান প্রায় যাতায়াত করে, কিন্তু সে কখনো বোঝেনি এটার ভিতরে এক আলাদা জগৎ। বাইরে থেকে বোঝার কোন উপায় নাই; অথচ ভিতরে কৃত্তিম স্বর্গ বানাতে চেষ্টার কোন ত্রুটি করেনি পাবের মালিকপক্ষ। রোমান্টিক পরিবেশে আবছা রঙিন আলোর মাঝে আরামদায়ক সোফা বসানো; হালকা মিউজিকের তালে জোড়ায় জোড়ায় কপোত-কপোতী বসে বিয়ারের গ্লাস হাতে উপভোগ করছে মধুর এই মায়াবী মূহুর্ত।
একজন ওয়েটার ভ্যালেন্তিনাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে একটা টেবিল পরিস্কার করে বসার ব্যবস্হা করে দেয়। এই রোমান্টিক পরিবেশ হাসানের খুব পছন্দ হয়েছে; তাই তার জীবনে এমন রোমান্টিক রাত উপহার দেবার জন্য সে ভ্যালেন্তিনাকে ধন্যবাদ জানায়; আর ভ্যালেন্তিনা ধন্যবাদ জানায় রাতটাকে রঙিন করে দেবার জন্য। অন্যদিকে, যেমন আয়োজন তেমন তার মূল্য; সাধারণ বারের তুলনায় পাবে সবকিছুর মূল্য অনেক বেশি। তবু টাকা এ ক্ষেত্রে হাসানের কাছে মূখ্য বিষয় নয়। ওয়েটার অর্ডার দিতে আসলে ভ্যালেন্তিনা দুইটা বিয়ার অর্ডার দেয়, অবশ্যই হাসানের পক্ষ থেকেএখানে বড় বড় গ্লাসে বিয়ার পরিবেশন করা হয়।
আলো-আঁধারীর এই মায়াবী পরিবেশে বসে, নিজের সঙ্গে বয়ে বেড়ানো সার্বক্ষণিক পুলিশী যন্ত্রণার কথা ভুলে যায় হাসান। পাশে বসে থাকা ভ্যালেন্তিনার দিকে তাকিয়ে, নিয়তির পাশা খেলার পরিণতি কী হতে পারে, তা বিয়ারে চুমুক দিয়ে ভাবতে থাকে হাসান। আবেগে হাসানকে জড়িয়ে ধরে, তার ঠোঁটে একটা চুমু দিয়ে ভ্যালেন্তিনা জানতে চায়, কেমন লাগছে, হাসান?
চমৎকার!
সবার সামনে ভ্যালেন্তিনার এই ঘনিষ্ট আবেগী আচরণে অস্বস্তি অনুভব করে সে; কিন্তু ভ্যালেন্তিনার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই, এবং অন্যদেরও কোন মাথা ব্যথা নেই তাদের দুজনকে নিয়ে।
গতকালের স্বপ্নের ঘোর এখনো কাটেনি, এরই মধ্যে শুরু আর একটা। এদিকে ভ্যালেন্তিনার শরীরের মিষ্টি গন্ধটা বিয়ারের সাথে মিশে শূন্য করে দেয় হাসানের মস্তিস্কের অনুভূতি। হাসানের খুব ইচ্ছে করছে ভ্যালেন্তিনাকে ‘বনলতা সেন’ কবিতা অনুবাদ করে শোনায়‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতো সন্ধ্যা আসে’কিন্তু পারে না। ইতালিয়ান ভাষায় জীবনানন্দ দাশ অনুবাদ করার মতো এতটা দক্ষতা এখনো সে অর্জন করেনি। যদিও ছয় মাসের একটা ভাষা শিক্ষার কোর্স করেছিল সে বেসরকারি সংস্থা কারিতাসে; তাতে আর যাই হোক জীবনানন্দ দাশ অনুবাদ করা সম্ভব নয়। হালকা সুরে বাজছে ফিল কলিন্স এর ‘প্যারাডাইস’ গানটি, ভ্যালেন্তিনা গাইছে গানের তালে তালে এবং হাসছে হাসানের ডিকে তাকিয়ে।
একদিকে ভ্যালেন্তিনার প্রজাপতি মন, অন্যদিকে যে আগামীকাল অপেক্ষা করছেকঠিন বাস্তবতার ভয়ানক ঝুঁকিপূর্ণ সিডির ব্যবসা (যদিও যে জীবন সে যাপন করে, এই সিডি ব্যবসা ছাড়া সেটা সম্ভব নয়)কঠিন এক পরীক্ষার মুখোমুখি হাসান। এখন সে কী করবে? ভেবে কোন কূল-কিনারা খুঁজে পায় না। যে হেমলকের পেয়ালা সে নিজেই পছন্দ করেছে নিজের জন্যে; সেটা এখন তাকে পান করতেই হবে; আর এখন তো এটা আরও প্রয়োজন ভ্যালেন্তিনাক কারণে। এখান থেকে ফিরে আসার পথ অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে, সে খেয়াল করেনি। গভীর এক হতাশা ঘিরে ধরে তাকে; মরে যেতে ইচ্ছে করে। এই যখন অবস্থা, তখন ভ্যালেন্তিনা আচমকা তার ঠোঁটে আর একটা চুমু দিয়ে অতি আদুরে গলায় বলে, হাসান, খুব ক্ষুধা পেয়েছে; কিছু খেতে পারলে ভালো হতো। পৃথিবীর সেরা পাষণ্ডের পক্ষেও সম্ভব নয় ভ্যালেন্তিনার এই আবদার উপেক্ষা করা, আর হাসান তো তার প্রেমে দিওয়ানা; সে কীভাবে সাড়া না দিয়ে থাকবে? হাসান ইশারা করতেই ওয়েটার ছেলেটি চলে আসে, ভীষণ স্মার্ট একটা ছেলে। একটা কিং সাইজ বার্গার অর্ডার দেয় ভ্যালেন্তিনা, এবং দুই ভাগ করে আনতে বলে।
তো আমার ভদ্র ডাকাত, আজও কি ডাকাতি করার ইচ্ছা আছে তোমার?
ভ্যালেন্তিনা মুখে যা বলে, চোখে বলে তারও চেয়ে বেশি। হাসন সোফায় হেলান দিয়ে বিয়ারে চুমুক দিয়ে হাসতে থাকে; হঠাৎ লটারির কথা মনে আসে।
চলো ভ্যালেন্তিনা, আজ আমরা নতুন একটা খেলা খেলি!
সেটা কী?
লটারি, যদি হেড পড়ে তবে ডাকাতি, আর যদি টেল পড়ে তবে এখানে বসে বিয়ার খাওয়া। তুমি রাজি?
হ্যাঁ, আমি রাজি।
এই নতুন আইডিয়াতে ভ্যালেন্তিনা ভীষণ মজা পায়। লটারি করার জন্য হাসান পকেট থেকে এক ইউরোর একটি কয়েন বের করে ভ্যালেন্তিনাকে দেয়। ভ্যালেন্তিনা লটারি করে, লটারিতে বিয়ারের বোতল ভেসে ওঠে। ভালেন্তিনা হাসতে হাসতে একাকার; কোনমতে হাসি থামিয়ে বলে, হাসান এবার থেকে আমরা সব সময় লটারি করব।
না, তাহলে তো আমার লোকসান হবে; তবে মাঝে মাঝে।
হাসান, তুমি আমার দেখা সেরা দুষ্টু ছেলে।
হাসানকে দেখে বোঝাই যাচ্ছে, সে এখন পরিপূর্ণ তৃপ্ত;
না পাবার কোন যন্ত্রণা তাকে বিদ্ধ করছে না। ভ্যালেন্তিনা তো তার পাশেই বসে আছে; চাইলেই তাকে নিয়ে যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারবে সে; সেই জন্যেই তার কোথাও যেতে ইচ্ছা করছে না। আসলে মানুষের মনস্তত্ত্ব খুব জটিলনা পাবার চেয়ে, না পাবার বেদনা আমাদের কষ্ট দেয় বেশি; কিন্তু যখন চাইলেই কিছু পাওয়া যায়, তখন আর তা চাইতে ইচ্ছা করে না। ওয়েটার ছেলেটি বার্গার নিয়ে আসে, গরম বার্গার দুজনে ভাগ করে খায়; আরও দুইটা বিয়ারের অর্ডার দেয় হাসান। বিয়ার এনে ওয়েটার ছেলেটি দাঁড়িয়ে থাকে, হাসান বুঝতে পারে টাকার জন্য দাঁড়িয়ে আছে সে। হাসান আজ প্রথম এসেছে, তার উপর সে আবার বিদেশী; তার মতো অনেকে এখানে ফুল বিক্রি করতে আসে; হয়তো ওয়েটার ছেলেটি ভাবছে, হাসান টাকা না দিয়ে ঝামেলাও করতে পারে। দোষ ছেলেটির নয়, দোষ হাসানের কপালের; হাসান জানতে চায়, আমাদের কত হয়েছে?
ত্রিশ ইউরো।
হাসান পকেট থেকে টাকা বের করে দেয়। ছেলেটি ধন্যবাদ জানিয়ে টাকা নিয়ে চলে যায়।
দুজনে আবার নিজেদের মধ্যে মশগুল হয়ে পড়ে। এমন সময় হাসানের পরিচিত এক দেশী বন্ধু ফুল বিক্রি করতে আসে; হাসানকে দেখে সে চলে যেতে চায় (হয়তো লজ্জা পেয়ে)। ইতালিয়ান বান্ধবী সাথে নিয়ে হাসান বিয়ার পান করছে; তার সামনে অনুনয়-বিনয় করে ফুল বিক্রি করতে তার হয়তো ইচ্ছা করছে না। হাসান তাকে আস্বস্ত করে বলে, ভাই আসেন, কোন সমস্যা নাই। আপনার কাজ আপনি করেন, আর আমাকে একটা ফুল দেন।
হাসান ফুলটি ভ্যালেন্তিনাকে উপহার দিয়ে, দাম মিটিয়ে দেয় (যদিও তিনি দাম নিতে চাননি)। ফুল পেয়ে ভ্যালেন্তিনা খুশিতে হাসানকে জড়িয়ে ধরে। অন্যদের মতো ভ্যালেন্তিনাও হাসানের অপ্রস্তুত মনোভাব বুঝতে পারে; তাই পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক করতে সে হাসানকে বলে, উনি কি তোমার দেশী?
হ্যাঁ, ভ্যালেন্তিনা।
ভ্যালেন্তিনা, তোমার বাবা কী করেন?
আমার বাবা-মা দুজনেই ফিনান্স অফিসে চাকরী করেন; ডঃ ভিসকন্তি নামে বাবাকে সবাই চেনে।
তোমার বাবা তো তা হলে খুব নামি মানুষ।
জি, জনাব ডাকাত (মজা করে ভ্যালেন্তিনা)।
তুমি কিছু করো না কেন?
হাসান, আমার অবসাদে ভোগার রোগ আছে; তা ছাড়া আমাকে সবসময় ডাক্তারের কাছে যেতে হয়।
ঠিক আছে, আমি তোমাকে সুস্থ করে দেবো। আমার সাথে থাকলে তুমি অবসাদে ভোগার সময় পাবে না।
জানো হাসান, আমার মা সিসিলির এবং বাবা নাপোলির মাম্মা মিয়া, তা হলে তো তোমার শরীরে বইছে খাঁটি মাফিয়া রক্ত।
মোটেও না হাসান, আমি ভীষণ ভীতু; রক্ত দেখলে আমি অজ্ঞান হয়ে যাই।
বিয়ার শেষ করে ভ্যালেন্তিনাকে নিয়ে পাব থেকে বের হয় হাসান; রাত প্রায় বারোটা, ভ্যালেন্তিনা ভীষণ উৎফুল্ল।
চলো তোমাকে বাসায় দিয়ে আসি।
হাসান, রোজ রাতে কেন বাসায় ফিরতে হয়?
কারণ পরিচিত বিছানায় ঘুমাবার জন্যে।
হাসান, আমার না আজ বাসায় যেতে ইচ্ছা করছে না।
তবে কী করতে ইচ্ছা করছে?
চলো, আজ সারারাত বিচে কাটিয়ে দেই।
আমারও মন চাচ্ছে ভ্যালেন্তিনা তুমি আর আমি তারাদের পাশে বসে, তারাদের সাথে গল্প করে রাত পার করে দেই; কিন্তু রাতে এ্যালেনা তোমাকে খুঁজবে।
হাসান, আমার জীবনে তুমি আগে কেন আসো নি?
আমরা নিয়তির হাতে বন্দি ভ্যালেন্তিনা, আর এটাই আমাদের নিয়তি।
গল্প করতে করতে হাত ধরাধরি করে বার আমিগোসের সামনের পার্কের বেঞ্চে বসে ওরা। বার আমিগোস বন্ধের আয়োজন চলছে; সোডিয়াম লাইটের রঙিন আলোর নিচে, সুনসান নীরবতার মাঝে, পার্কের কৃত্তিম ঝর্ণার রিমঝিম শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। হাসান বেঞ্চে বসে, আর ভ্যালেন্তিনা এক হ্যাঁটু বেঞ্চে ভর দিয় নিচু হয়ে, এতক্ষণ জমিয়ে রাখা শরীরের সমস্ত আবেগ হাসানের শরীরে ঢেলে দেয়। ভ্যালেন্তিনার শরীরের মিষ্ট গন্ধটা হাসানকে চারিদিক থেকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলে; নড়াচড়া করার শক্তি হারিয়ে ফেলে সে; তার শুধু মনে হচ্ছে, কোন এক অদৃশ্য শক্তি তাকে বেঁধে রেখেছে বেঞ্চের সাথে। হাসান তার সমস্ত শরীর দিয়ে অনুভব করে ভ্যালেন্তিনার নরম শরীর, আর হৃদয় দিয়ে অনুভব করে তার আত্মার উত্তাপ
ভ্যালেন্তিনা, বিয়ার নিয়ে আসি?
হাসান, তুমি নিশ্চয়ই মন পড়তে পারো।
তুমিও কি আমার মতো ভাবছিলে?
হ্যাঁ, হাসান।
তুমি বসো, আমি বিয়ার নিয়ে আসছি।
ভ্যালেন্তিনা হাসানকে মুক্ত করে দেয়; আর সে যায় বার আমিগোসে। এলোমেলো চুলে হাসানকে দেখে সান্দ্র বলে, হাসান, এখনও?
এটাই শেষ, সান্দ্রা!
কাঁচুমাচু মুখ করে হাসান উত্তর দেয়।
ভ্যালেন্তিনার হাতে একটা বিয়ারের বোতল ধরিয়ে দিয়ে নিজের বিয়ারে চুমুক দেয় হাসান; এবং একটা সিগারেট ধরিয়ে টানতে থাকে।
হাসান, তুমিও কি মৌরিচ্ছিওর মতো আমায় ফেলে চলে যাবে?
আমি প্রতারক নই, আর প্রতারণা শিখিও নি, ভ্যালেন্তিনা।
তবে বলো, আমাকে ছেড়ে তুমি কোথাও যাবে না।
আমি দুঃখিত ভ্যালেন্তিনা, তোমাকে ছেড়ে এবং এই সুন্দর পৃথিবী ছেড়ে আমাকে একদিন চলে যেতেই হবে।
সব ব্যাপারে মজা করা তোমার অভ্যাস। আমি কিন্তু তোমার উপরে রাগ করেছি, হাসান।
দুঃখিত ভ্যালেন্তিনা, তোমায় কষ্ট দেবার জন্যে। আমি তো তোমাকেই ভালোবাসি, তবে এত ভয় পাচ্ছো কেন?
আমি তোমাকে হারাতে চাই না, হাসান।
রাত বাড়তে থাকে, তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দুজনের ভালোবাসা। সন্ধ্যার তারাগুলো আকাশের যে স্হানে ছিল, তারা এখন সেখানে নেই; অনেক দূরে চলে গেছে। সপ্তর্ষিমণ্ডলী ঘুরে এখন প্রশ্নবোধক চিহ্নের মতো হয়ে গেছে, যেন হাসানকে প্রশ্ন করছেতারপর কী? অথচ সে প্রশ্নের উত্তর হাসানের জানা নেই; সে শুধু জানে, হৃদয়ের সবটুকু আবেগ উজাড় করে সে ভ্যালেন্তিনাকে ভালবেসেছে!
তেরো
নিয়তির সাথে নিদারুণ যুদ্ধ করে, জীবন বাজি রেখে যে দুঃখ-কষ্ট-যন্ত্রণা ভোগ করে ইউরোপে এসেছে হাসানসে সব এখন অতীত। এখন তার দিন কাটে ব্যবসা নিয়ে, আর রাতগুলো ভ্যালেন্তিনাময়। আগে মাঝে-মধ্যে বন্ধুদের সাথে বারে বসে আড্ডা মারতো; এবং ফুটবল খেলা দেখে হৈ হুল্লোড় করে কাটাতো। কিন্তু এখন ধীরে ধীরে বন্ধুদের সঙ্গ ভুলতে বসেছে হাসান। বন্ধুরাও কিছু মনে করে না, কারণ, তারা বোঝে ভ্যালেন্তিনা নামক আবেগের কাছে হাসান এখন বন্দি। ভ্যালেন্তিনা বিহীন নিঃসঙ্গ এক একটি রাত যেন হাজার বছরের নরক যন্ত্রণা, আর বিয়ারগুলো মনে হয়, সাগরের নোনা জলের মতোই বিস্বাদ।
হাসান এখন মাঝে মাঝে ভীত-আতংকগ্রস্ত হয়ে পড়ে সে-ও কি ভ্যালেন্তিনার মতো বিষণ্নতায় আক্রান্ত হয়ে গেল? তা না হলে কেন সে কারণ ছাড়াই অবসাদে ভোগে? একটা ছায়া সব সময় তাকে ঘিরে থাকে; এবং ফাঁসির দড়ির মতো কিছু একটা তাকে তাড়া করে বেড়ায়; এটা সে অনুভব করে, কিন্তু এখান থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষমতা তার নেই। তার অবস্হা এখন হুবহু রাসকলনিকভের মতো। এর মধ্যে একদিন ভেরনাতে গিয়ে মানব পাচারের মামলায় হাজিরা দিয়ে এসেছে সে। ট্রাইবুনালে মিখাইলের উকিলের সাথে দেখা হলে তিনি এক ফাঁকে হাসানকে বলেছেন, ‘পুলিশের কাছে বলা বয়ানটাই তুমি কাঠগড়ায় বলে দিও।’ হাসান মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে, তাহলে তার বুদ্ধি নেহাত মন্দ নয়। উকিল সাহেবের পরামর্শ মোতাবেক কাজ করে সে। পরবর্তী করণীয় চিঠির মাধ্যমে তার উকিলকে জানিয়ে দেওয়া হবে; এবং কেস শেষ না হওয়া পর্যন্ত সে ইতালি ছাড়তে পারবে না। এই নির্দেশনা দিয়ে তাকে রোমে যাবার অনুমতি দেয় ট্রাইবুনাল; যদিও হাসান চাইলেও বৈধ পথে ইতালি ছাড়তে পারবে না, কারণ তার পাসপোর্ট পুলিশের কাছে জমা আছে। আর সে যদি হাজিরার দিন না আসে তবে তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি হবে। তাকে নিয়ে নিয়তির নিষ্ঠুর তামাশা দেখে ক্লান্ত হাসানসাধারণত সবাই যেখানে আতংকে থাকে, কখন তাকে পুলিশ দেশে পাঠিয়ে দেয়; অথচ হাসানের চিন্তা একটাই, কীভাবে সে দেশে যাবে!
হাসানের দৃঢ? বিশ্বাস ভেরনার এই কেসে তাকে কিছুই করতে পারবে না সরকার; যেহেতু তার বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ নেই, এবং কোন প্রমাণ হাজিরও করতে পারবে না পুলিশ। কিন্তু তার ভয় অন্য জায়গায়, পঁচা শামুকে যেমন পা কাটে, তেমনি ভেরনার কেসে কিছু করতে না পেরে আপাত নিরীহ গ্রীন কার্ডের কেসে তাকে ফাঁসিয়ে দিতে পারে পুলিশ। অবশ্য এজন্য দায়ী আমেরিকার টুইন টাওয়ারে আল কায়েদার হামলা। এই ঘটনার পর থেকেই ইউরোপ এবং আমেরিকায় মুসলিম বিদ্বেষ অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় ভয়ানক রকমে বেড়ে গেছে, আর এটা সবক্ষেত্রে। যদিও কোটি কোটি মুসলমানের মতো হাসানেরও ধারণা, টুইন টাওয়ারের হামলা মোসাদ এবং সিআইএর পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র।
এদিকে দেশ থেকে আসার পর দেখতে দেখতে আট বছর কেটে গেছে; দেশে যাবার জন্য হাসানের মনটা যেন কেমন কেমন করেএকেই বুঝি ‘হোম সিকনেস’ বলে। বৈধ কাগজ হাতে না থাকায়, বৈধ কোন কাজ অথবা চাকরী করাও হাসানের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ভ্যালেন্তিনার বাবার কাছে গিয়ে ভ্যালেন্তিনার পাণিপ্রার্থনার সাহসও পায় না হাসান; যদিও হাসান ও সিনিওরে ভিসকন্তি কেউ কাউকে পছন্দ করে না, এটা আবার ভ্যালেন্তিনার মুখের দিকে তাকিয়ে কেউ প্রকাশও করে না। ইতিমধ্যে সিনিওরে ভিসকন্তি ও হাসানের সাথে ছোট-খাটো দু’একটা সংঘর্ষ হয়ে গেছে। এবং প্রতিবারই ভ্যালেন্তিনার হস্তক্ষেপে পরিস্হিতি স্বাভাবিক হয়েছে। তবুও ভ্যালেন্তিনার বাবা হিসাবে সিনিওরে ভিসকন্তিকে হাসান যথেষ্ট সন্মান করে; আর অবাক হয়ে সে অনুভব করেছে পৃথিবীর সকল বাবাই সন্তানের প্রতি একই রকম স্নেহশীল, ঠিক যেমন পৃথিবীর সকল নারী একই রকম ইর্ষাপরায়ণ। গভীর বেদনার সাথে হাসান অনুভব করে ঘুড়ি আকাশে উড়ছে ঠিকই, কিন্তু লাটাই হাসানের হাতে নেই।
এটাই হাসানের সমস্যার শেষ নয়, এটা সবে শুরু। বিগত আট বছর যাবত দৌড়াতে দৌড়াতে সে এখন ক্লান্ত; ইউরোপের অন্য কোন দেশে পালিয়ে গিয়ে আবার নতুন করে জীবন শুরু করার মতো মনের জোর তার আর অবশিষ্ট নেই; যে মন ছিল সেটা এখন বিষণ্নতায় পরিপূর্ণ। হাসানের এই সর্বগ্রাসী হতাশার মাঝে একমাত্র ভ্যালেন্তিনাই রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো মুগ্ধতা ছড়াচ্ছে এখনও; তার জীবনে আনন্দ বলতে এখনও যেটুকু আছে, তা এই ভ্যালেন্তিনাই। অথচ ভ্যালেন্তিনাকে নিজের মতো করে পাওয়া এই মূহুর্তে সম্ভব না, আবার ভ্যালেন্তিনাকে ছাড়া একলা জীবন যাপন হাসানের কাছে এক কথায় অকল্পনীয়। তার প্রতি নিয়তির এই নিষ্ঠুর রসিকতা দেখে হাসান মাঝে মাঝে ভীষণ ভেঙে পড়ে। এদিকে আবার ভ্যালেন্তিনার বাবা ভ্যালেন্তিনার মাথায় ঢুকিয়ে দিয়েছেহাসান শুধুমাত্র ইতালিয়ান পাসপোর্টের জন্য তাকে বিয়ে করতে চায়। তাই মনের দুঃখে হাসান এখন আর ভ্যালেন্তিনাকে বিয়ের ব্যাপারে কিছু বলে না; যদিও আগে কয়েকবার সে বিয়ে করার কথা ভ্যালেন্তিনাকে বলেছে। প্রতিবারই ভ্যালেন্তিনা তাকে সান্তনা দিয়ে বলেছে, হাসান, এখন থাক না; আরও দু’এক বছর পরে বিয়ে করি; তাছাড়া আমি তো তোমার সঙ্গেই আছি।
হাসান তার বুক চিরে ভ্যালেন্তিনাকে দেখাতে পারে না; তার আনন্দ এবং বেদনার নাম একটাই, আর সেটা হচ্ছে ভ্যালেন্তিনা। হাসান বোঝাতে পারে না দেশে ফেরার জন্য তার হাহাকার, বুকের ভিতর জমিয়ে রাখা চাপাকান্নার কথা। ভ্যালেন্তিনা নামক ট্রাজেডির সামনে দাঁড়িয়ে কিছুই ভাবতে পারে না সে। সারাদিন যত দূরে যাবার চেষ্টাই করুক না কেন, সন্ধ্যায় ভ্যালেন্তিনার কাছেই ফিরে আসে হাসান।
‘জানি-তবু জানি
নারীর হৃদয়-প্রেম-শিশু-গৃহ-নয় সবখানি;
অর্থ নয়, কীর্তি নয়, স্বচ্ছলতা নয়-
আরওএক বিপন্ন বিস্ময়
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভিতরে
খেলা করে;
আমাদের ক্লান্ত করে,
ক্লান্তক্লান্ত করে;’
জীবনানন্দ দাশের মতো কোন এক বিপন্ন বিস্ময়ে ক্লান্ত হতে থাকে হাসানের হৃদয়।
বার আমিগোসে বসে আছে হাসান, সন্ধ্যা হতে এখনও অনেক বাকী; চোখের পলকে কীভাবে সময় চলে যায় ভাবতে তার অবাক লাগে। সে-দিনের সেই ছোট্ট এ্যালেনার মুখে এখন কথার ফুলঝুরি ফুটতে থাকে, বন্ধ হতেই চায় না। বিকালে যখন মা’র সাথে ঘুরতে বের হয়, তখন হাসানের কাছে বিভিন্ন বায়না করে এ্যালেনা, আর হাসানও এ্যালেনার কোন ইচ্ছা অপূর্ণ রাখতে চায় না। অবশ্য ভ্যালেন্তিনা এজন্য দুজনকেই শাসন করে, কিন্তু দুজনের কেউই ভ্যালেন্তিনার এই চোখ রাঙানির বিশেষ পাত্তা দেয় না; বরং এ্যালেনাকে খুশি করতে পারলে হাসান তৃপ্তি অনুভব করে। পার্কে খেলার সময় এ্যালেনা যখন ‘হাসান’ বলে ছোট ছোট পায় দৌড় দিয়ে তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে, হাসান তখন গভীর মমতায় দু’হাত বাড়িয়ে এ্যালেনাকে বুকে জড়িয়ে ধরে। এ্যালেনার পবিত্র হাসি দেখে সে ভুলে যায় সব পার্থিব যন্ত্রণা; হারিয়ে যায় কোন এক দূর অতীতেমনে পড়ে বাবার হাত ধরে আইসক্রিম কিনতে যাবার কথা। ছবিটা ঝাপসা হতে গিয়েও ঝাপসা হয় না, এ্যালেনার কল্যাণে ফিরে আসে মনের পর্দায়। মৌরিচ্ছিওর জন্য দুঃখ হয় হাসানের‘হায় মৌরিচ্ছিও, পবিত্র এই দেবশিশুর হাসিটা দেখলে না কোনদিন, এতটা নিষ্ঠুর তুমি?’হাসান অবাক হয়ে ভাবতে থাকে। তবে কেন এই ভালোবাসা, কেন এই মানুষ জন্ম? দ্বিধায় পড়ে যায় হাসান।
সান্দ্রা হাসানের সামনে এসে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে, কোন কথা না বলে। হাসানই শুরু করে, সান্দ্রা, আজ আমার মনটা ভালো নেই।
সে তো দেখতেই পাচ্ছি, কিন্তু তোমার সমস্যা কী?
আমার সমস্যার শেষ নেই, আর তোমাকে বলে বোঝাতেও পারব না।
ভ্যালেন্তিনার সাথে কি ঝগড়া হয়েছে?
না।
তবে (চোখ বড় করে হাসানের দিকে তাকায়)?
সান্দ্রা, আসলে আমরা যা চাই, তা আমরা পাই না;
আর যা পাই, তা নিতান্তই অনিচ্ছায়।
হাসান, আমি অনেক ব্যস্ত; তোমার দার্শনিকতা শোনার সময় নেই। পারলে আমাকেও একদিন বিয়ার অফার করতে পারো; তখন না হয় বিয়ার পান করতে করতে তোমার সব কথা শুনবো (সন্দ্রার মুখে তির্যক হাসি)।
আমাকে খোঁচা দিচ্ছ, সান্দ্রা?
আচ্ছা বাবা ঠিক আছে, তোমাকে বিয়ার দেই?
বিয়ার অথবা বিষ! তোমার যা খুশি দিতে পারো, আমি এক চুমুকে উজাড় করে দেবো!
আমার মাথা খারাপ করে দিও না হাসান, কাজ করতে দাও।
সান্দ্রা ভিতরে চলে গেল বিয়ার আনতে। পিছন থেকে হাসান সান্দ্রাকে দেখতে থাকেসান্দ্রা একটুও বদলায়নি, অথচ কেটে গেছে অনেক বছর।
বিয়ারে চুমুক দিয়ে আবার মৌরিচ্ছি ওর কথা ভাবতে থাকে হাসান। কেউ স্বেচ্ছায় যেটা ফেলে যায়, অন্য কেউ সারা জীবন কামনা করেও তার ছায়া মাড়াতে পারে নাএটাই কি নিয়তি? এটাই কি বৈপরীত্যের ঐক্য, না কি ঐক্যের বৈপরীত্য? কে এখন বলবে আমায়? যিনি বলতে পারতেন, সেই মহান দার্শনিক সক্রেটিস এখন মৃত। পৃথিবীর সাথে আমরা ছুটে চলেছি মহাজাগতিক অনন্ত অসীম অন্ধকারে; এখানে স্হির বলে কিছু নেই না সময়, না মৌরিচ্ছিও, না ভ্যালেন্তিনা, না হাসান। সবাই অস্হির এবং অপূর্ণ; অপূর্ণতাই পৃথিবী ও মানুষের চিরন্তন প্রকৃতি। তাই তো মানুষ যা পায়, তার মূল্য মানুষ বোঝে না, কিন্তু না পাবার আবেগের অনুভুতি মানুষকে তাড়া করে আমৃত্যু।
ভ্যালেন্তিনাকে আসতে দেখে হাসান; আগের চাইতে একটু ভারি হয়েছে তার শরীর, প্রজাপতির সেই চপলতা এখন আর নেই, এখন তাকে রমণী বলা যায়। সারাদিন এ্যালেনাকে শাসন করতে করতে চেহারায় ফুটে উঠেছে গাম্ভীর্য, চলার গতি হয়েছে স্লথ; এ্যালেনার মতো হাসানকেও সব সময় শাসনে রাখতে চায় ভ্যালেন্তিনা। ভ্যালেন্তিনার শিক্ষিকা সুলভ শাসন খুব উপভোগ করে হাসান, তাই সে মাঝে মাঝে স্বরচিত ভুল করে ভ্যালেন্তিনার উপদেশ মনযোগ সহকারে শ্রবণ করে। কিন্তু একটা জিনিষ হাসান ভালো করেই জানে, বান্ধবী অথবা বউ- কাউকেই কখনও মোটা বলতে নাই। কারণ, বললে কপালে যে দুঃখ নেমে আসে, তা পরিমাপ করার মতো কোন যন্ত্র এখনও আবিস্কৃত হয়নি পৃথিবীতে। হাসানও কখনও বলেনি, ‘ভ্যালেন্তিনা, তুমি কিন্তু মোটা হয়ে যাচ্ছো।’ যদিও হাসানের কাছে বহুবার এ সম্পর্কিত মতামত জানতে চেয়েছে ভ্যালেন্তিনা। আর প্রতিবার আধ্যাত্মিক কথা-বার্তা বলে হাসান পাশ কাটিয়ে গেছে।
হাসানের ঠোঁটে প্রেমিকার প্রগাঢ? চুম্বন এঁকে দিয়ে চেয়ারে বসে ভ্যালেন্তিনা। তিন বছর আগে এমনই এক সন্ধ্যায় এই বার আমিগোসে ভ্যালেন্তিনার সাথে পরিচয় হয়েছিল। ভ্যালেন্তিনা সে-দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলে, আচ্ছা হাসান, আমি যদি সে-দিন তোমার কাছে বিয়ার পান করতে না চাইতাম, তবে কী হতো?
কী আর হতো! আমি বুঝতেই পারতাম না, জীবনের মানে কী?
তা জীবনের মানেটা কী জনাব?
জীবনের মানে হলো, বার আমিগোসে বসে ভ্যালেন্তিনার সঙ্গে বিয়ার খাওয়া (দুজনেই হাসে)।
হাসান, তুমি সবকিছু নিয়েই মজা করো।
কেন, আমি কি কিছু ভুল বললাম? তোমাকে আমার কাছে এনে দেবার জন্য বিয়ার নামক বস্তুকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
ইতিমধ্যে ভ্যালেন্তিনাকে দেখে বিয়ার দিয়ে গেছে সান্দ্রা।
তোমার এই দার্শনিকতা শেষ হলে আমি কি একটা দরকারি কথা বলতে পারি?
বলো ভ্যালেন্তিনা। আগামীকাল এ্যালেনার জন্মদিন।
দুঃখিত ভ্যালেন্তিনা, আমার মনে ছিল না। ঠিক আছে, কাল সকালে তুমি এ্যালেনাকে নিয়ে এসো; আমরা একসাথে পছন্দ করে ওর জন্য উপহার কিনবো।
ধন্যবাদ হাসান, কিন্তু দয়া করে দামি কিছু দিতে যেও না, তা না হলে বাবা ভীষণ রাগ করবে।
আমার সব ব্যাপারেই তো তোমার বাবার সমস্যা; আমার কোন কিছুই তো তার পছন্দ না।
হাসান উত্তেজিত হয়ে পড়ে। ভ্যালেন্তিনা খুব ভালো করেই জানে, পরিচয়ের প্রথম থেকেই তার বাবার সাথে হাসানের একটা ব্যাক্তিত্বের সংঘাত লেগেই আছে; এবং এই অপ্রকাশিত ছায়া যুদ্ধে কেউই হার স্বীকার করতে রাজি না। যদিও হাসানের সাথে পরিচিত হবার পর থেকে হাসানের প্রতি সেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মনোভাব আর নেই সিনিওর ভিসকন্তির। উনি এখন হাসানকে না পারেন স্বীকার করতে, আর না পারেন করতে অস্বীকার। দুজনের এই ছায়া যুদ্ধের মাঝে ভ্যালেন্তিনা দাঁড়িয়ে আছে যুদ্ধ বিরতির সাদা পতাকার মতো।
হাসান, আজ তোমার প্রিয় জোছনার রাত, বিচে যাবে না?
তুমি সেটাই আমাকে মনে করিয়ে দাও ভ্যালেন্তিনা, যেটা আমি ভুলে থাকতে চাই।
মোটেও না, আমি শুধু তোমাকে জোছনা রাতের কথা বলেছি, আর কিছু নয় (হেসে উত্তর দেয় ভ্যালেন্তিনা)।
ঠিক আছে, আমি যাব। সাদা জোছনার সাদা বন্যায় ভেসে যাব আমি তোমার হাত ধরে, তার আগে আমাকে পান করতে দাও ভ্যালেন্তিনা, আজ আমি ভীষণ তৃষ্ণার্ত।
হাসান, তোমার কী হয়েছে? তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? তুমি কি অসুস্থ? (ভ্যালেন্তিনার চেহারায় চিন্তার ভাঁজ)
না ভ্যালেন্তিনা, আমার কিছু হয়নি; অসুখ আমার শরীরে নয়, অসুখ আমার মনে; আর আমি তো আমার মনের মালিক নই!
তবে তোমার মনের মালিক কে?
এই যে, আমার সামনে বসে আছে; নাম দেবী ভ্যালেন্তিনা। তুমি চাইলে তাকে আফ্রদিতিও বলতে পারো!
হাসান, এভাবে কষ্ট দিও না আমায়; আমি কিন্তু কেঁদে দেব!
দুঃখিত ভ্যালেন্তিনা, আজ আমি তোমারে কাঁদতে দেবো না, এই জোছনা রাতে তোমার চোখে কান্নার জল মোটেও মানাবে না।
[চলবে]