বাংলাদেশভারত

তিস্তাসহ অমীমাংসিত ইস্যু দ্রুত সুরাহার আশ্বাস ভারতের

‘প্রতিবেশী প্রথমে’ নীতির আলোকে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ইস্যুতে বহুমুখী সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বের সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার বার্তা দিয়েছে বন্ধুদেশ ভারত। আসন্ন জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সম্মানিত অতিথি হিসেবে স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় আছে দিল্লি। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আমদানিতে বাংলাদেশকে সহযোগিতারও আশ্বাস দিয়েছে পরীক্ষিত ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী।

এদিকে বহুল আলোচিত তিস্তাসহ অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত হত্যা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনাসহ অমীমাংসিত ইস্যুগুলো দ্রুত সুরাহার পাশাপাশি রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ভারতের সহায়তা চেয়েছে বাংলাদেশ।

ভারতের নতুন পররাষ্ট্র সচিব বিনয় মোহন কোয়াত্রার সঙ্গে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকের (ফরেন অফিস কনসালটেশন- এফওসি) পর আজ বুধবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব (সিনিয়র সচিব) মাসুদ বিন মোমেন সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান।

মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘এফওসিতে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বাংলাদেশের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিবেশী ও গুরুত্বপূর্ণ বন্ধু হিসেবে ভারতের কাছে অনিষ্পন্ন ইস্যুগুলো নিষ্পত্তিতে সহায়তা চেয়েছি। জবাবে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ভারতের নিকটবর্তী প্রতিবেশীর নীতির আওতায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার লাভ করে। বাংলাদেশ ভারতের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং অঞ্চলের সর্ববৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার উল্লেখ করে আমাদের সঙ্গে কাজ করার বিষয়ে তার সরকারের গভীর আগ্রহের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।’

গতকাল মঙ্গলবার রাতে প্রথম দ্বিপক্ষীয় সফরে ঢাকা আসেন ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব। বুধবার দুপুরে দু’দেশের ফরেন অফিস কনসালটেশনের আগে দুই পররাষ্ট্র সচিব দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেন। দুপুরে তার সম্মানে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের দেওয়া মধ্যাহ্ন ভোজে অংশ নেন বিনয় মোহন। এরপর তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সঙ্গে তাদের কার্যালয়ে পৃথক সাক্ষাৎ করেন।

বুধবার রাতে তার সম্মানে ভারতীয় হাইকমিশনারের দেওয়া নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। ১৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার সকালে ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিবের বিশেষ ফ্লাইটে দিল্লির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার কথা রয়েছে।

তিস্তা চুক্তিসহ অনিষ্পন্ন বিষয় নিষ্পত্তির জন্য ভারতের কাছে আহ্বান জানানো হয়েছে জানিয়ে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘তিস্তাসহ সব আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টনের বিষয়ে দ্রুত চুক্তি সম্পাদনের ওপর গুরত্ব পুনর্ব্যক্ত করি এবং সমাধানের জন্য ভারতের নিবিড় সহযোগিতার প্রত্যাশা করেছি। সেই সঙ্গে গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় কুশিয়ারা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে স্বাক্ষরিত চুক্তির বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নিতে ভারতকে বলেছি।’

তিনি বলেন, ‘তিস্তা চুক্তি নিয়ে অনেকদিন ধরে আলোচনা করছি। তাদের কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের মধ্যে সমস্যাটি এখনো আছে। এরপরও তারা কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ২০২৬ সালে গঙ্গা চুক্তির মেয়াদ শেষ হবে। চুক্তিটি নবায়নের বিষয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। আগামীতে দুই পক্ষ হয়তো প্রাক-চুক্তি পর্যালোচনার জন্য বসবে।

সেপ্টেম্বরে ভারত যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
আগামী সেপ্টেম্বরে ভারতে অনুষ্ঠেয় জি-২০ সম্মেলনে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এই তথ্য জানিয়ে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সেপ্টেম্বরে জি-২০-এর মূল সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে এবং আমরা যাওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত করেছি।’

সীমান্ত হত্যা শূন্যে আনার প্রত্যয়
দুদেশের সীমান্তে হত্যা আগের চেয়েও উল্লেখযোগ্য হারে কমলেও তার শূন্যে নামিয়ে আনতে দুইপক্ষ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, এফওসিতে আন্তঃসীমান্ত অপরাধসহ সীমান্তে অপরাধমূলক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে চলমান প্রচেষ্টা আরও জোরদারে রাজি হয়েছে দুই দেশ। সীমান্তে চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি-বিএসএফের ভূমিকা বাড়ানো নিয়েও আলাপ হয়েছে। তাহলে সীমান্ত হত্যাও কমে আসবে।

নেপাল-ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানিতে সহযোগিতা
এক প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বিন মোমেন ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি আগামী দিনে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে জানিয়ে বলেন, ‘বর্তমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের প্রয়োজনীয় জ্বালানি সরবরাহে আমরা গুরুত্ব দিয়েছি। ভারত থেকে জ্বালানি আমদানি করতে বাংলাদেশ এবং ভারতের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন উদ্যোগে নিয়ে আলোচনার পাশাপাশি ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আনার বিষয়েও ভারতের সহযোগিতা চেয়েছি।’

ভারতের পক্ষ থেকে সহযোগিতার আশ্বাস মিলেছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বাংলাদেশের সঞ্চালন লাইনের সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। বিদ্যুৎ সীমান্ত পর্যন্ত নিয়ে এলেও সেটিকে বাংলাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে কিছু কাজ করতে হবে। সঞ্চালন লাইনের সমস্যার কথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে জানাব। যাতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ট্রান্সমিশন লাইনের সক্ষমতা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।’

জঙ্গি প্রসঙ্গে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামে অস্ত্র পাচার ও জঙ্গি প্রশিক্ষণের বিষয়ে ভারতের কাছে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছে বাংলাদেশ। আমরা জানিয়েছি, সরকার কোনো ধরনের উগ্রবাদকে প্রশ্রয় দেয় না। আমরা যখন খবর পেয়েছি কিছু তরুণ তাদের পরিবার থেকে চলে গেছে এবং পরবর্তীতে যখন পুলিশের কাছে খবর এলো, বান্দরবনে তারা প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। তখন কিছু অভিযান পরিচালনা করা হয় এবং বেশ কয়েকজনকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাদের পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান চলছে।

‘আমরা ব্যাখ্যা করেছি যে কোনো প্রেক্ষাপটে এই অভিযানগুলো পরিচালনা করা হয়েছে। এর একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ফল হচ্ছে সেখানকার বম গোষ্ঠীর কিছু লোক ভয় পেয়ে মিজোরামের দিকে চলে গেছে। সংখ্যাটি সে রকম বেশি না। তবে এটি তাদের জন্য রাজনৈতিক সমস্যার তৈরি করেছে। আমরা বলেছি যে বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে নিতে আমরা আগ্রহী। যদি সাহায্য প্রয়োজন হয় সেটি আমরা দেব। ভারত আমাদের ব্যাখ্যায় আশ্বস্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে এ ধরনের অভিযানের ফলে বেসামরিক লোকেরা যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সে বিষয়ে আমরা আরও যত্নবান থাকব বলেও জানানো হয়েছে।’

বাণিজ্য বাধা নিরসনে সম্মত
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বাধাগুলো দূর করতে দুই দেশ সম্মত হয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘ভারত বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তর বাণিজ্য অংশীদার। ভারত থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ করেছি। এ ছাড়া দুই দেশের মধ্যে যে কমপ্রিহেনসিভ পার্টনারশিপ এগ্রিমেন্ট বা সেফা সেটা সম্পাদনের জন্য আলোচনা দ্রুত সময়ের মধ্যে করার বিষয়ে আলোচনা করেছি। আর ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক ও আঞ্চলিক পর্যায়ে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বৃদ্ধি করতে আমাদের চলমান প্রচেষ্টা এবং কার্যক্রম বেগবান করতেও আমরা একমত হয়েছি।’

মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বৈঠক প্রসঙ্গে মাসুদ বিন মোমেন বলেন, ‘মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে ভারত অনুরোধ করেছে এবং আমরা সাড়া দিয়েছি।’ গত সেপ্টেম্বরে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফরের সময়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়েছিল জানিয়ে তিনি বলেন, ‘দুই পক্ষের যে উন্নয়ন কার্যক্রম ও ত্রিপুরায় যে কাঁটাতারের বেড়ার কাজ কিছুটা বাকি আছে, সে বিষয়ে যে সমঝোতা হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সেটা যাতে সমাধান করা যায় সেটির বিষয়ে তারা বসেছিল। আমার ধারণা অচিরেই এই কাজ শুরু হবে।’

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension