গল্পসাহিত্য

দেখা হবার পরে


বিপাশা মন্‌ডল


‘তোর সঙ্গে আমার অন্তত আরো সাত বছর আগে দেখা হওয়া উচিত ছিল।’

‘তুই কি এখন ভবিতব্যকেও নিয়ন্ত্রণ করতে চাচ্ছিস?’

‘নাহ্, খুব কষ্ট হয় মাঝে মাঝে, যখন চাই তোকে দেখতে পাই না, কথা বলতে পারি না, কতো কথা জমে থাকে!’

‘কথা জমলে জমবে, যখন দেখা হবে কথা হবে তখন বলবি।’

‘বিষয়টা ঠিক ওরকমও না, তোকে বোঝাতে পারবো না।’

আমরা দুজনে মাওয়া ব্রীজের কাছে রাস্তার পাশের একটা ছাপরা দেওয়া খাবারের দোকানে ভাত খাচ্ছি, ওর প্লেটে ইলিশ, আমার প্লেটে পাবদা, টেস্টে মনে হচ্ছে পাবদাটা চাষের মাছ। ও লাল টকটকে ঝোল দিয়ে ভাত মাখল। আমি প্রায় খাচ্ছি না। আজ দীপনের সামাজিক বিজ্ঞান পরীক্ষা। কেমন প্রশ্ন এসেছে কে জানে। সাড়ে ন’টায় ওকে স্কুলে ঢুকিয়ে দিয়ে এখানে চলে এসেছি। বাবলুর সঙ্গে আমার প্রায় চারমাস দেখা হয় না। শুধু ও নয়, আমিও ওকে খুব মিস করছিলাম। সোমা, দীপনের বন্ধু রায়ানের মা আমারও সহপাঠী বন্ধু, ও দীপনকে পরীক্ষা শেষে কোচিংয়ে পৌঁছে দেবে। ওরা ভাবছে অন্যসব দিনের মতো আজও আমি অফিসেই গিয়েছি।

টেবিলে গ্লাস ঠোকে বাবলু, ‘কী ভাবছিস?’

আমি জোর করে মুখে একটু হাসি ফুটিয়ে বলি, ‘কিচ্ছু না।’

মুখ কালো হয়ে যায় ওর, ‘মিথ্যে বলছিস! আমার সঙ্গে?’ ওর সঙ্গে মিথ্যে বলা যায় না, কীভাবে যেন আমার মনের সব কথা খোলা বইয়ের মতো পড়ে ফেলে।

অস্ফূটে বলি, ‘দীপন …।’

‘পরীক্ষা আগেরগুলো কেমন দিয়েছে?’

‘ভালো।’

‘এটাও ভালোই দেবে। তোরই তো ছেলে।’

‘তুই সবসময়েই আমাকে গ্লোরিফাই করিস। কী জরুরি কথা বলে ফেল।’

‘তুই জানিস না কী জরুরি কথা!’

আমি জানি, তাই চুপ করে যাই। এইসব কথার কোনো অর্থ হয় না। এইসব কথার কোনো শেষ নেই, শুরু থাকে কিন্তু শেষ নেই। আর জোর করে শেষ করতে চাইলে সেই শেষটা হয় ভয়ঙ্কর। বিছানায় অথবা কুরুক্ষেত্রে। দুটোরই শেষে থাকে ধ্বংস, তিক্ততা, অপরিমেয় শূন্যতা। তার চেয়ে এই ভালো। ন’মাসে ছ’মাসে হঠাৎ করে দেখা করি, যে কোনো একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে ভরপেট খাই। আবোল-তাবোল বকি কিছু সময়। একটা উষ্ণ আলো একটা ইনটেক্ট বাতাস একটা অচেনা মৃদু ঘ্রাণ আমাদের ঘিরে থাকে। আমরা একে অন্যের গায়ে গড়িয়ে পড়ি না, কিন্তু আমাদের অন্তরাত্মা থাকে সমর্পিত। আমরা হাত ধরে থাকি না, কিন্তু আমাদের চিন্তা একে অন্যকে জড়িয়ে থাকে। আমাদের স্বপ্নগুলো হাত ধরাধরি করে হাঁটে। ওর বোধহয় খুব খিদে পেয়েছে। হাত খুব দ্রুত চলছে থালার ওপরে।

ও দু’প্লেট এক্সট্রা ভাত নিল। ডান হাতে ঘড়ি পরে ও। চওড়া কব্জি, কেঁচোর মতো কিলবিলে রক্তনালী। দেখলেই বোঝা যায় প্রচন্ড শক্তি ওই হাতে। ঘড়িওয়ালা হাতের কব্জি নিয়ে কায়েস আহমেদ বেশ একটা অবদমনের গল্প লিখেছেন। কিন্তু শিপন যখন আদর করে কখনোই বাবলুর এই শক্তিশালী কব্জির কথা আমার মনে পড়ে না। শিপন কি সাইট থেকে ফিরেছে? একটা ফোন দেওয়া দরকার। ভাত খেতে খেতেই মোবাইলটা বের করি, ফোন ধরে না ও, বোধহয় মিটিংয়ে আছে। আড়চোখে দেখি বাবলু খুব ঈর্ষা চোখে আমাকে দেখছে, ও এমন কেন? ও যখন রুবিকে ফোন করে, গলে যাওয়া গলায় কথা বলে, কই আমি তো ঈর্ষা করি না। অবশ্য ঈর্ষা না করার অপবাদ আমার আছে, আমি নিজেকে শ্রেষ্ঠ ভাবি তাই অন্যকে ঈর্ষা করি না, এমনসব অদ্ভূত সৃষ্টিছাড়া অপবাদ।

শিপন ফোন না ধরায় বাবলু খুশি হয়। চোখ নাচিয়ে বলে, ‘কী রে, ধরছে না ফোন?’

আমার এসব ফালতু কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করে না। ঠাণ্ডা গলায় বলি, ‘তোর খাওয়া হলো? উঠবো আমি, ফেরার সময়ে অফিসে একটা ঢুঁ মেরে যেতেই হবে। কয়েকটা জরুরি ফাইল নেবো।’

ও কাতর গলায় বলে, ‘এখনই যাবি? কিছুই তো খেলি না, আমি অবশ্য সকালে খাই নি, ইচ্ছে করে, তোর সামনে পেট ভরে খাবো বলে, তোর সামনে আমার লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকতে খুব ভালো লাগে।’

‘এখনো ছেলে আছিস তুই?’

‘ছেলেই তো, তুই-ই বুঝতে পারিস না। এই মাছের ডিমটুকু খা, পদ্মার মাছের ডিম, খুব টেস্ট।’

আমি ওর অর্ধেকখাওয়া বাটিটা টেনে নিই, এবার প্লেটের ভাত কটা শেষ হয়। আসলেই মাছের ডিমটা অনেক স্বাদু ছিল।

বিল আমিই দিই। বাইরে আসি। শরতের আকাশে দু এক টুকরো সাদা মেঘ। ও একটা সিএনজি ভাড়া করে, সিএনজিতে ওঠার সময়ে ওর হাতে সামান্য ছোঁয়া লাগে আমার হাতের, হাতটা ঠান্ডা, নদীর খোলা বাতাসে বোধহয়। সিটে বসে নিচু স্বরে বলি, ‘কি বলবি বলছিলি, বললি না তো?’

‘থাক, বাদ দে,’

‘তুই কি চাস আমার কাছে, বলতো?’

বাবলু এবার একটু থতমত খেয়ে যায়, অস্থির গলায় বলে, ‘এমন মনে হচ্ছে কেন তোর?’

‘না, বলে ফেল, কী চাস তুই?’

‘বলবো?’

আমি এবার সরাসরি ওর চোখের দিকে তাকাই, আশ্চর্য সেখানে কোনো ভয়ের ছায়া খেলা করে না, স্বচ্ছ নির্মল প্রেমপূর্ণ একজোড়া চোখ। আমি জোর করে জোর গলায় বলি, ‘বলে ফেল।’

ও মৃদু গলায় বলে, ‘তুই আমার পাশে এভাবে কিছুক্ষণ বসে থাক, একটাও কথা বলিস না।’

আমি বাধ্য মেয়ের মতো ওর পাশে বসে থাকি। আমার ফোনে রিং বাজছে, বোধহয় শিপন, আলতো চাপে রিংটাকে সাইলেন্ট করে দু’হাতে ফোনটা ধরে স্থির বসে থাকি। সিএনজি ফাঁকা রাস্তায় খুব দ্রুত চলছে, বোধহয় ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ঢাকায় অফিসে পৌঁছে যাব।❐

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension