নির্বাচিত কলাম

নৈতিকতাহীন এক কৃষ্ণ প্রতিভা

মফিদুল হক


হেনরি কিসিঞ্জারের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে লিবারেল মার্কিন সাময়িকী দ্য নেশন ২৩ মে ২০২৩ সংখ্যার প্রচ্ছদে বার্থডে কেকের ছবি এঁকেছিল, যেখানে জন্মদিনের কেক বেয়ে নেমে আসছিল রক্তধারা—চিলির, পূর্ব তিমুরের, আর্জেন্টিনা, কম্বোডিয়া ও বাংলাদেশের রক্তের ছোপ। বিশ শতকের এই ‘যুদ্ধাপরাধী’কে মহাজ্ঞানী মহামান্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে উচ্চ বেদিতে বসানোর সব আয়োজন ম্লান হয়ে যায় ইতিহাসের পাঠ গ্রহণকালে।

মহাজ্ঞানী তিনি বটে, সেই সঙ্গে ছিলেন জ্ঞানপাপী এবং সব জেনেশুনে যে মানুষেরা পাপের যজ্ঞের পুরোহিত হয়ে ওঠে, তখন যে ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা সংঘটিত হয়, সেই পরিচয় রেখে গেছেন হেনরি কিসিঞ্জার। তাঁর মৃত্যুবন্দনায় চারপাশ মুখরিত হওয়ার মধ্যে আমরা স্মরণ করব সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচেন্সকে, মৃত্যুর স্তোত্র পাঠ করব তাঁর গ্রন্থ ‘দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার’ থেকে।

ক্রিস্টোফার হিচেন্স বিভিন্ন দেশে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে হেনরি কিসিঞ্জারের যোগসাজশের স্বরূপ তুলে ধরেছেন। তাতে উঠে এসেছে বাংলাদেশের গণহত্যার বিষয়টিও। ‘বাংলাদেশ : একটি গণহত্যা, একটি ক্যু এবং একটি হত্যা’ শিরোনামের অধ্যায়ে ক্রিস্টোফার হিচেন্স বাংলাদেশ ও শেখ মুজিবের প্রতি কিসিঞ্জারের বিদ্বিষ্ট মনোভাব এবং মার্কিন নীতিতে তাঁর প্রতিফলনের বিবরণ দিয়েছেন। কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন কিভাবে গণহত্যাকারী পাকিস্তানের পক্ষ নিয়েছিলেন সেটা ছাড়াও মুজিব হত্যায় তাঁর সংশ্লিষ্টতার দিকটি ক্রিস্টোফার হিচেন্স মেলে ধরতে চেয়েছেন।

তিনি লিখেছেন, ১৯৭৪ সালের নভেম্বরে মাত্র আট ঘণ্টার সংক্ষিপ্ত সফরে কিসিঞ্জার ঢাকা এসেছিলেন এবং সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন তিন মিনিটের জন্য। সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, তিন বছর আগে তিনি কেন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিলেন। এ প্রশ্নের উত্তর দিতে কিসিঞ্জার অসম্মতি প্রকাশ করেন। হিচেন্স লিখেছেন, ‘কিসিঞ্জারের ঢাকা ত্যাগের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, আমরা এখন এটা জানি, মার্কিন দূতাবাসের একাংশ ঢাকায় সামরিক কর্মকর্তাদের সঙ্গে গোপনে সভা করতে শুরু করে, যারা মুজিবের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান করার পরিকল্পনা করছিল।


একাত্তরে বাংলাদেশে গণহত্যাকারীদের পক্ষে নিক্সন-কিসিঞ্জার প্রশাসন যে ভ্রান্ত ও গর্হিত নীতি গ্রহণ করেছিল তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য মার্কিন বিদ্বৎসমাজে বিভিন্ন সময় দাবি উঠেছে। মার্কিন সিনেটে সম্প্রতি বাংলাদেশে গণহত্যা হওয়ার বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। বিগত বছরের ২৫ মার্চ ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গণহত্যা স্মরণ অনুষ্ঠানে প্রদত্ত ভাষণে জেনোসাইড ওয়াচের প্রতিষ্ঠাতা এবং ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব জেনোসাইড স্কলার্সের সাবেক সভাপতি গ্রেগরি স্ট্যানটন বলেছিলেন, ‘মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের প্রস্তাব আমাদের সমর্থন করা উচিত। কেন উচিত আমি সেটা বলছি। বাংলাদেশের গণহত্যাকালে আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছে।

হেনরি কিসিঞ্জার ও রিচার্ড নিক্সন গোপনে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করেছিলেন এই গণহত্যা চালিয়ে যেতে। আমরাও এই অপরাধে অপরাধী; এবং সে কারণে আমাদের নৈতিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এখন সময় হয়েছে অপরাধ স্বীকার করার।’

এখানে উল্লেখ করতে হয় বিশিষ্ট বাঙালি অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের কথা। অসহযোগ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে আসন্ন সংঘাতের আশঙ্কায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে সাধারণ নাগরিকের জীবন বাঁচাতে উদ্যোগী হয়ে তিনি বিশ্বের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির কাছে চিঠি পাঠান। পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে তিনি হেনরি কিসিঞ্জারকে চিঠি দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, ‘সদিচ্ছাসম্পন্ন সব মানুষের কাছে আমি আবেদন জানাচ্ছি এবং আপনি তেমন একজন মানুষ, যিনি আমেরিকায় উচ্চ পদে আসীন রয়েছেন, আপনার সহযাত্রী অপর মানবগোষ্ঠীকে সম্ভাব্য নিষ্ঠুর আঘাত থেকে রক্ষার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিন।’

এই চিঠির জবাব মেলেনি, খান সারওয়ার মুরশিদের প্রত্যাশা কিসিঞ্জার পূরণ করেননি। পরে সারওয়ার মুরশিদ লিখেছিলেন, ‘কিসিঞ্জারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৬০ সালে হার্ভার্ড এবং টোকিওতে তাঁরই আয়োজিত দুটি সেমিনারে। সে পরিচয় একটু ঘনিষ্ঠ হয় ১৯৬২-৬৪ সালে হার্ভার্ডে অবস্থানকালে। নৈতিকতার সঙ্গে সম্পূর্ণ সম্পর্কহীন, মানবিক বিবেচনা দ্বারা সম্পূর্ণ অবিচলিত এই কৃষ্ণ প্রতিভার সঙ্গে আমার যথার্থ পরিচয় হয় অনেক পরে—১৯৭১ সালে, আমি যখন ১৬ মার্চ চিঠিটি লিখি কিসিঞ্জার তখন ক্ষমতার শিখরে, বিশ্ব ব্যাপারের নিয়ামক বিধাতাদের একজন, নিজের মহিমা প্রতিষ্ঠার সর্পিল পথে স্বচ্ছন্দ গতি।’

অসাধারণ এক বাংলায় কিসিঞ্জার-চরিত বিশ্লেষণ করেছেন খান সারওয়ার মুরশিদ। তিনি মনে করতে পারেন এই কিসিঞ্জারই হার্ভার্ডের ক্যাফেটেরিয়ায় লাঞ্চ করতে করতে তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সহস্রাধিক মাইলের দূরত্ব দিয়ে বিচ্ছিন্ন দুটি ভূখণ্ড নিয়ে স্বাভাবিক রাষ্ট্র কিভাবে হতে পারে। সব জেনে-বুঝেই গণহত্যাকারী পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার।

পশ্চিম দুনিয়া যে জ্ঞানকাঠামো দাঁড় করিয়েছে, যে অভিজ্ঞান থেকে রাষ্ট্রীয় ও সমাজনীতি তৈরি করেছে এবং সেখানে উদারনৈতিক আদর্শ, মানবিক মূল্যবোধ ও সভ্যতার সংগ্রামের যেসব তাত্ত্বিক ভিত দাঁড় করানো হয়েছে, সেই মতাদর্শের বরেণ্য পণ্ডিত হেনরি কিসিঞ্জার। রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয়ে তিনি মার্কিন বিদেশনীতি প্রভাবিত করেছেন দীর্ঘকাল। এ ক্ষেত্রে তাঁর অবদান নানাভাবে কীর্তিত হয়েছে, অন্যদিকে যেসব জাতি রক্ত দিয়ে এই জ্ঞানতত্ত্বের অনৈতিকতার মূল্য পরিশোধ করেছে তাঁদের কণ্ঠ প্রায়শ অস্বীকৃত ও অশ্রুত থেকে গেছে। আজ গাজায় ইসরায়েল রাষ্ট্র ও তার সমরশক্তির নিষ্ঠুর প্রয়োগের বাস্তবতায় পশ্চিমি দেশগুলোর ভূমিকা এবং তথাকথিত আলোকিত মানসের অন্তঃসারশূন্যতা পরস্ফুিট হয়ে উঠেছে। এই পটভূমিকায় হেনরি কিসিঞ্জারকে বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া দরকার।

মৃত্যুকালে পশ্চিমি গণমাধ্যমের কিসিঞ্জার বন্দনায় মুখরিত হওয়ার পাশাপাশি, তাঁর মিথ্যার মুখোশ সটানে খুলে ফেলুক মানবতাবাদী চিন্তকসমাজ—এটাই হবে আমাদের প্রত্যাশা। গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের জন্য তাঁর বিচারের দাবি কিসিঞ্জার এড়িয়ে যেতে সমর্থ হলেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে, কিন্তু ইতিহাসের কাছে তাঁকে দায়বদ্ধ করাবার লড়াই থেকে কখনো বিরত হবে না নমপেন, হ্যানয়, দিল্লি, বুয়েনস এইরেস, সান্টিয়াগো ও ঢাকা। কখনো রুদ্ধ হবে না ন্যায় ও সত্যনিষ্ঠ বিশ্ব নাগরিকদের কণ্ঠ, একদিন ইতিহাসের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হবে এই ‘সম্পূর্ণ নৈতিকতাবর্জিত কৃষ্ণ প্রতিভাকে’। সফল মার্কিন কূটনীতিক হিসেবে প্রশস্তির বন্যায় ভেসে যাওয়া হেনরি কিসিঞ্জারের শবযাত্রায় যেন উচ্চারিত হয় কালের যাত্রার ধ্বনি, গণহত্যাকারীর বিচারের দাবি।

লেখক: প্রাবন্ধিক, গবেষক, ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension