পাসপোর্ট ফি নিতে অনীহা, অজুহাত সার্ভার ডাউনের
আগামী মে মাসেই শেষ পাসপোর্টের মেয়াদ। তাই অনলাইনে ফরম পূরণ করে গত রোববার ব্যাংকে টাকা জমা দিতে গেলেন মিরপুর শেওড়াপাড়ার আলমগীর শরীফ। কিন্তু ফি জমা দিতেই যেন এক রাজ্যের ঝক্কি! শেওড়াপাড়ায় অবস্থিত কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখায় ফি জমা দিতে গেলে তাকে দেয়া হয় নানা অজুহাত। পরে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের রূপালী ব্যাংকের শেওড়াপাড়া শাখা ফি নিতে রাজি হলেও সব কার্যক্রম শেষ করতে সময় লাগে প্রায় ২ ঘণ্টা।
পাসপোর্টের ফি জমা নিতে বেসরকারি ব্যাংকের অনীহা বেড়েই চলেছে। সার্ভারে ধীরগতির কথা বলে এড়িয়ে যায় সব ব্যাংক। এটাকে আলগা ঝক্কি মনে করা হয়। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকে ফি জমার ক্ষেত্রে চাপ সবচেয়ে বেশি।
গ্রাহকরা বলছেন, পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে নানা ঝুট-ঝামেলার মধ্যে যুক্ত হয়েছে এই নতুন সংকট। ব্যাংকের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে সার্ভারে গিয়ে পূরণ করতে সময় লাগে। যার কারণে শাখা কর্তৃপক্ষ ফি জমা নিতে এড়িয়ে যায়।
দুর্ভোগে সেবাপ্রত্যাশী
মিরপুর শেওড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডে প্রথমে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে ঢুকে ডেপুটি ম্যানেজারের কাছে পাসপোর্ট ফি জমা নেয়া হয় কি না জানতে চান আলমগীর। তিনি বলেন, ৭ নম্বর কাউন্টারে জমা নেয়া হয়। ৭ নম্বর কাউন্টারে গেলে জানানো হয় ফি জমা নেয়া হতো, কিন্তু এখন সার্ভার সমস্যা করে।
একই এলাকার প্রিমিয়ার ব্যাংকে ফি জমার জন্য গেলে কর্তৃপক্ষ অপারগতা প্রকাশ করে। জানানো হয়, সার্ভারে সমস্যার কারণে এই সেবা দেয়া যাচ্ছে না।
আগে এখানে জমা দেয়া হলেও এখন কেন জমা নেবেন না জানতে চাইলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, দুই সপ্তাহ ধরে সার্ভারে সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য পাসপোর্ট ফি জমা নেয়া যাচ্ছে না। কবে থেকে সার্ভার ঠিক হবে জানতে চাইল তারা কিছু বলতে পারেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, সার্ভার সমস্যা নয়, একটু সময় লাগে বলেই কোনো কোনো ব্যাংক এই সেবা দিতে ইচ্ছুক নয়।
আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসে কথা হয় ফরিদ হোসেনের সঙ্গে। আল-আরাফাহ্ ব্যাংকের অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, গত সপ্তাহ আল-আরাফাহ্ ব্যাংকে ‘পাসপোর্ট রিনিও ফি’ জমা দিতে গেলে নেয়া হয়নি। তখন ব্যাংকে ভিড় থাকায় নানা অজুহাতে না করে দেয়া হয়। নিতেই হবে, এমন কোনো দায় নেই কারও মধ্যে।
পাসপোর্ট করতে আসা ফারহানা সুমি জানান, বেসরকারি ব্যাংকে ঝামেলার কারণে টাকা জমা নেয় না। তবে সরকারি সোনালী ব্যাংকে টাকা জমা দেয়া গেছে। বলেন, এই ব্যাংকে সময় লাগলেও অপারগতা প্রকাশ করে না কেউ।
একই অভিযোগ মোরশেদ আলমের। তিনি বলেন, ‘ফি জমা দেয়ার জন্য সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে গেলে তারা জানায় জমা দেয়া যাবে না। অগত্যা পাসপোর্ট অফিসে দালাল ধরে টাকা জমা দিয়েছি।’
জানা গেছে, প্রথমে পাসপোর্টের ফি শুধু রাষ্ট্রীয় সোনালী ব্যাংকে জমা দেয়া যেত। তারপর বেসরকারি ব্যাংকে জমা নেয়া শুরু হয় ২০১৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি থেকে। টাকা জমা দেয়ার ব্যাপারে বেসরকারি পাঁচটি ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তি করে বহির্গমন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তর। ব্যাংকগুলো হলো- প্রিমিয়ার, ঢাকা, ব্যাংক এশিয়া, ওয়ান ও ট্রাস্ট ব্যাংকে। অনলাইনে ক্রেডিট কার্ড ও মোবাইলের মাধ্যমেও পাসপোর্টের ফি এসব ব্যাংকে পরিশোধ করা যায়।
কিন্তু গুটিকয়েক ব্যাংক নির্দিষ্ট করে দেয়ার পর বাড়ে গ্রাহকের চাপ। ফলে ২০২১ সালে সরকার দেশের সব বাণিজ্যিক ব্যাংকে ট্রেজারি কার্যক্রম চালু করে। এতে যেকোনো ব্যাংকের যেকোনো শাখায় ট্রেজারি চালান, সরকারি চালান, ব্যাংক ড্রাফট ও পে-অর্ডারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে টাকা জমা দেয়ার নির্দেশনা দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
ব্যাংকের কেন অনীহা
বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মধ্যে প্রথম পাসপোর্টের টাকা জমা নেয়া শুরু করে ব্যাংক এশিয়া। ব্যাংকটির সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আরফান আলী বলেন, ‘ব্যাংক এশিয়ার সব শাখায় ও এজেন্ট ব্যাংকিং বুথেও পাসপোর্টের ফি জমা নেয়া হয়। বেসরকারি খাতে পাসপোর্টের টাকা জমা দিতে পাসপোর্ট বিভাগের মহাপরিচালকের সঙ্গে আলাপ করে আমরা চার-পাঁচটি ব্যাংক প্রথম এ-সংক্রান্ত চুক্তি করি। বর্তমানে শুধু ব্যাংকের শাখা নয়, এজেন্ট ব্যাংকিংয়েও এই ফি চালু করা হয়েছে।’
ইদানীং কোনো শাখায় সমস্যা করছে কি না জানতে চাইলে বলেন, এটা কিছু শাখার কর্মকর্তাদের অনীহার কারণে হচ্ছে। তারা মনে করে, বাড়তি খাটনি, বিষয়টা এ রকম।
সরকারি রূপালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, সার্ভার ব্যবস্থাপনায় নানা ঝক্কির কারণে টাকা নিতে অনীহা প্রকাশ করা হয়। তিনি বলেন, টাকা জমা দেয়ার ক্ষেত্রে পাসপোর্ট অফিসের সার্ভারে যুক্ত থাকতে হয়। সেখানেই যত সমস্যা। সময়ও লাগে অনেক।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে বেশি টাকা
ব্যাংকের শাখাগুলোতে যখন ফি নিতে অনীহা, তখন পাসপোর্ট অফিসের পাশে দোকানে টাকা জমা দেয়া যাচ্ছে মুহূর্তেই। দেখা গেছে, আগারগাঁও বাজারে ফটোকপি এবং কম্পোজ করা যায় এমন দোকানে পাসপোর্টের টাকা জমা নেয়া হয়। কিন্তু নেয়া হয় বাড়তি টাকা। পাসপোর্ট ফির চেয়ে বাড়তি দিতে হয় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ জমা দেয়া যায়। সময় লাগে মাত্র ৫ থেকে ৭ মিনিট।
দোকানিদের কাছে জানতে চাইলে বলেন, মোবাইলে অনলাইনে টাকা জমা দেয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি অর্থ দিতে হয়। ১২০ টাকা বাড়তি ফি দিতে হয়, যে কারণে বেশি অর্থ নেয়া ছাড়া উপায় থাকে না।
পাসপোর্ট-প্রতাশীরা বলেন, দোকান থেকে টাকা জমা দিতে গেলে ইচ্ছামতো টাকা দাবি করা হয়। নানা অজুহাত তৈরি করে নেয়া হয় বেশি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বক্তব্য
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক বলেন, ‘পাসপোর্টের এ চালান করা হয় সরাসরি অটোমেটেড চালান সিস্টেমের যে সার্ভার আইবাস সেখান থেকে। এ সার্ভারে লগ ইন করে টাকা জমা দেয়া হয়। ব্যাংক যদি আইবাস সার্ভারে লগ ইন না করতে পারে, তাহলে টাকা জমা নিতে পারবে না। আইবাস সার্ভার সমস্যার বিষয়টা তারা বলতে পারবে।’ তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশেই এই ফি সরাসরি সরকারের খাতে যায়। ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের এ সেবা দিতে বাধ্য।
পাসপোর্ট ফি কত?
বর্তমানে ই-পাসপোর্টের যুগে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। তিন রকমই পাসপোর্ট মূলত ৪৮ ও ৬৪ পাতার। যেমন- ‘অতি জরুরি’, ‘জরুরি’ ও ‘সাধারণ’। ৫ বছর ও ১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হারে ফি জমা দিতে হবে।
পাঁচ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ৪৮ পাতার ‘অতি জরুরি পাসপোর্ট’ দুই দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। ‘জরুরি পাসপোর্ট’ সাত দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৩ হাজার ৫০০ টাকা।
পাঁচ বছর মেয়াদি ৬৪ পাতার ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৫ হাজার ৫০০ টাকা। ‘জরুরি পাসপোর্ট’ সাত দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭ হাজার ৫০০ টাকা। ‘অতি জরুরি পাসপোর্ট’ দুই দিনে পেতে ফি দিতে হবে ১০ হাজার ৫০০ টাকা।
১০ বছর মেয়াদি ই-পাসপোর্টের ক্ষেত্রে ৪৮ পাতার ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৫ হাজার টাকা। ‘জরুরি পাসপোর্ট’ সাত দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭ হাজার টাকা। ‘অতি জরুরি পাসপোর্ট দুই দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৯ হাজার টাকা।
১০ বছর মেয়াদি ৬৪ পাতার ‘সাধারণ পাসপোর্ট’ ১৫ দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৭ হাজার টাকা। ‘জরুরি পাসপোর্ট’ সাত দিনে পেতে ফি দিতে হবে ৯ হাজার টাকা। ‘অতি জরুরি পাসপোর্ট’ দুই দিনে পেতে ফি দিতে হবে ১২ হাজার টাকা।
তবে এ ফির সঙ্গে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট জমা দিতে হবে।