আন্তর্জাতিকইউরোপ

পুতিনের ওপর ক্ষোভ থেকেই মস্কোয় হামলা

রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে গত শুক্রবার রাতের ভয়াবহ বন্দুক হামলায় নিহতের সংখ্যা বেড়ে গতকাল শনিবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা পর্যন্ত ১৩৩ জনে উঠেছে। এতে আহত হয়েছে ১৪০ জনের বেশি। এই ঘটনায় সন্দেহভাজন ১১ জনকে আটক করা হয়েছে, যাদের মধ্যে চারজনই হামলায় সরাসরি জড়িত বলে দাবি করেছে কর্তৃপক্ষ।

সশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের আফগানিস্তান শাখা ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএস-কে) দায় স্বীকার করলেও মস্কোর কেউ কেউ এর পেছনে ইউক্রেনের হাত থাকার কথা বলছে। আইএস ঠিক এখন কেন রাশিয়ায় এমন রক্তাক্ত হামলা চালাল তা নিয়ে জল্পনা চলছে।

গত শুক্রবার রাতে মস্কোর ক্রোকাস সিটি হলে ঢুকে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে এলোপাতাড়ি গুলি চালায় কয়েকজন হামলাকারী। তারা দাহ্য পদার্থ দিয়ে হলের কয়েকটি অংশে আগুনও ধরিয়ে দেয়। অনেকের মৃত্যু হয়েছে বিষাক্ত ধোঁয়ায় দম বন্ধ হয়ে। এটি কয়েক দশকের মধ্যে রাশিয়ায় সবচেয়ে প্রাণঘাতী হামলাগুলোর অন্যতম।

ইসলামিক স্টেটের বার্তা সংস্থা আমাক এক টেলিগ্রাম বার্তায় জানিয়েছে, আইএস যোদ্ধারা মস্কোর উপকণ্ঠে এই হামলা চালিয়েছে। তারা সেখানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে নিরাপদে নিজ ঘাঁটিতে ফিরে গেছে। শুক্রবারের হামলাকে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ‘বর্বর সন্ত্রাসবাদী কাজ’ বলে অভিহিত করেছেন।

তিনি বলেন, ‘যে এই হামলার আদেশ দিয়েছে তাকে শাস্তি পেতে হবে। সব অপরাধীকে অবশ্যই খুঁজে বের করা হবে।’ অনেক বিশ্বনেতাও এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। হামলার পর আটক ব্যক্তিরা ‘ইউক্রেনের মদদে’ সীমান্ত অতিক্রম করে সে দেশে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল বলে দাবি করেছে রাশিয়ার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা। তবে এই দাবিকে ‘অযৌক্তিক’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেছে কিয়েভ।

মার্কিন কর্মকর্তারা মনে করিয়ে দিয়ে বলেছেন, তাঁরা এ হামলার দুই সপ্তাহ আগেই এ বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। তাঁদের ভাষ্য, রাশিয়া মার্কিন প্রচারণা দাবি করে এতে কান দেয়নি।

আইএস-কের পরিচিতি
প্রাচীন ভূখণ্ড খোরাসান ছিল আজকের ইরান, তুর্কমেনিস্তান ও আফগানিস্তানের অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত। এ অঞ্চলের নামেই গড়ে উঠেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট-খোরাসান (আইএস-কে) শাখা। ২০১৪ সালের শেষ দিকে আফগানিস্তানে গোষ্ঠীটির উত্থান। ইসলামিক স্টেটের সবচেয়ে সক্রিয় আঞ্চলিক সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অন্যতম এটি। এই গোষ্ঠীটির হাতে আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন তালেবান ও মার্কিন বাহিনী উভয়েরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল।

তবে হামলার দায় স্বীকার করলেও এর সঙ্গে আইএসের সংশ্লিষ্টতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। কারণ এর আগেও এমন অনেক হামলার দায় গোষ্ঠীটি স্বীকার করেছে, যার সঙ্গে আসলে তাদের কোনো সম্পর্ক ছিল না। যদিও মার্কিন গোয়েন্দারাও দাবি করেছেন, মস্কোতে এই হামলার পেছনে আইএসের হাত রয়েছে।

কেন এই হামলা
বিশ্লেষকদের কারো কারো ভাষ্য, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরোধিতা থেকেই আইএস এ হামলা চালিয়েছে। স্বাধীন বৈদেশিক নীতি গবেষণা কেন্দ্র সোফিয়ান সেন্টারের বিশ্লেষক কলিন ক্লার্ক বলেন, গত দুই বছর ধরে আইএস-কে রাশিয়াকে নিয়ে ক্ষুব্ধ। প্রায়ই তারা পুতিনের সমালোচনা করে থাকে।

ওয়াশিংটনভিত্তিক উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক মাইকেল কুগেলম্যান বলেন, রাশিয়াকে মুসলিমবিরোধী কার্যকলাপে জড়িত হিসেবে দেখে থাকে আইএস-কে।

২০১৫ সালে রাশিয়ার অংশগ্রহণের পর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের পট পাল্টে যায়। এ সময় বিরোধী বাহিনী ও ইসলামিক স্টেটের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন দেন পুতিন।

আরব বসন্তের পর বাশার আল আসাদের কর্তৃত্ববাদী শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থী বিদ্রোহ জোরদার হলে ২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ বাধে। এর ধারাবাহিকতায় সিরিয়া ও প্রতিবেশী ইরাকের বড় অংশ দখল করে নিজস্ব কট্টর ইসলামী রাষ্ট্রের ঘোষণা দেয় আইএস। যদিও শেষ পর্যন্ত পশ্চিমা অভিযানের মুখে দখল করা ৯৫ শতাংশ অঞ্চলই হারিয়ে ফেলে তারা।

বিশাল রাশিয়ার ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলেও আইএসের একটি শাখা আছে। এটি মূলত রাশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত চেচনিয়া, দাগেস্তান, ইংগুশেতিয়া ও কাবারদিনো-বালকারিয়া এলাকায় কার্যক্রম চালায়। রুশ সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে চেচনিয়ার। ইসলামপন্থী বিদ্রোহের কারণে ২০০৭ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত চেচেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে রাশিয়ার বাহিনীর রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়। চেচনিয়ায় রুশ সেনারা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। এতে রুশবিরোধী মনোভাব বেড়ে যাওয়ার সুবাদে রাশিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সদস্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয় আইএস।

রাশিয়ার অভিযোগ, ইউক্রেনের নাকচ
রুশ গোয়েন্দা সংস্থা ফেডারেল সিকিউরিটি সার্ভিস (এফএসবি) এক বিবৃতিতে বলেছে, হামলার পর সন্ত্রাসীরা গাড়িতে চড়ে রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে যায়। বিশেষ অভিযান চালিয়ে হামলায় সরাসরি জড়িত চারজনকে রাশিয়ার ব্রিয়ানস্ক অঞ্চল থেকে আটক করা হয়। তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ইউক্রেনে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিল।

রাশিয়ার সন্ত্রাসবিরোধী ইউনিটের সদস্য সের্গেই গোনচারোভ বলেন, ‘হামলার সঙ্গে ইউক্রেনের সংশ্লিষ্টতা না থাকার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। অন্য কেউ হামলা চালাতে পারে, তবে আমার কোনো সন্দেহ নেই যে ইউক্রেনীয় নািসরা এই হামলায় প্ররোচনা দিয়েছে।’

তবে অভিযোগ অস্বীকার করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কির সহযোগী মিখাইলো পোদোলাক বলেন, মস্কোয় হামলার ঘটনায় ইউক্রেনের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

পুতিনের হুঁশিয়ারি
এদিকে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ‘সন্ত্রাসীরা আমাদের লোকজন ও শিশুদের নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে। তারা লুকাতে ও ইউক্রেনে পালাতে চেষ্টা করেছে। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী, ইউক্রেন থেকে সন্ত্রাসীদের জন্য সীমান্ত অতিক্রমের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।’

পুতিন বলেন, ‘হামলাকারীরা যে-ই হোক না কেন, কারা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে—আমি স্পষ্ট করে বলছি, আমরা তাদের খুঁজে বের করব এবং জড়িত প্রত্যেককে শাস্তি দেব।’

পুতিন আজ রবিবার জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করেছেন।

বিশ্বনেতাদের নিন্দা
এদিকে মস্কোর কনসার্ট হলে এই হামলার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। নিন্দা জানানো নেতাদের মধ্যে রয়েছেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ, চীনা প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং প্রমুখ। জাতিসংঘ, নিরাপত্তা পরিষদ, জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নিন্দা জানায়। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন মস্কোর হামলাকে ‘ঘৃণ্য ঘটনা’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের সন্ত্রাসের নিন্দা করে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন বলেছেন, কোনো কিছুই এ রকম কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দিতে পারে না।

সূত্র: বিবিসি, এএফপি, এবিসি নিউজ, স্পুৎনিক, আরটি, তাস

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension