জীবনশৈলী

প্যান্টের পকেটে মোবাইল, কমতে পারে শুক্রাণুর গুণমান!

তুমি বন্ধ্যা! বাবা হতে পারবে না। আমাদের জীবনে সন্তান নেই। চরম হতাশায় বলছেন স্ত্রী। বিশ্বের দম্পতির ৫০ ভাগ সন্তানহীনতার দায় পুরুষের। বন্ধ্যা পুরুষ! চাইলেও বাবা হতে পারে না। তাই অক্ষমতা ঢাকতে স্ত্রীর দিকে আঙুল তোলাও অর্থহীন। মেল ইগোকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে গবেষণা এই সত্য স্পষ্ট করেছে যে, স্বাভাবিক পুরুষের মধ্যে প্রায় ১৫ শতাংশ বন্ধ‌্যাত্বের শিকার। বিশ্বে সন্তানহীন দম্পতিদের মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ ক্ষেত্রে বন্ধাত্বের কারণ পুরুষের সঠিক শুক্রাণু তৈরির অক্ষমতা। প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে পৃথিবী জুড়ে পুরুষের বীর্যের গুণমান হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু এর কারণ কী? বীর্যের গুণগতমান হ্রাস পাওয়ার কারণ নানাবিধ। তার মধ্যে জিনগত ত্রুটি, পরিবেশের প্রভাব এবং জীবনচর্চা ও খাদ‌্যাভ‌্যাসে ব্যাপক বদল।

জিনগত ত্রুটি কী?
শুক্রাণু উৎপাদনের প্রতিটি পর্যায় অনেকগুলো জিনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। শুক্রাণুর সামগ্রিক গঠন ও চলনক্ষমতা জিন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এই জিনগুলির একটি বা একাধিক সঠিকভাবে কাজ না করলে গঠনগত ত্রুটি যুক্ত অথবা চলচ্ছক্তিহীন শুক্রাণু তৈরি হয়। এইসব শুক্রাণু কিন্তু ডিম্বাণু নিষেকে অক্ষম। জিনগত ত্রুটি থাকলে সেক্ষেত্রে চিকিৎসা করে নিরাময়ের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। তখন একজন চিকিৎসককে আই ভি এফ (ইনভিট্রোফার্টিলাইজেশন), আইসিএসআই (ইনট্রাসাইটোপ্লাজমিক স্পার্ম ইনজেকশন), আইইউটি (ইনট্রাইউটেরাইন-স্পার্ম ট্রান্সফার) ‘ডোনারের থেকে শুক্রাণু সংগ্রহ’ ইত‌্যাদি পদ্ধতির সাহায‌্য নিতে হয়। এ তো গেল স্থায়ী বন্ধ্যাত্ব।

পরিবেশ কীভাবে বন্ধ‌্যাত্বকে প্রভাবিত করে?
পরিবেশের প্রভাব পুরুষের শুক্রাণু উৎপাদনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কর্মক্ষেত্রে অত‌্যধিক উষ্ণতাযুক্ত পরিবেশ, বিভিন্ন বিকিরণ যেমন এক্স রে, আল্ট্রা ভায়োলেট রে, অক্সিঅ‌্যাসিটিলিন শিখা ইত্যাদি এমন মারাত্মক রশ্মি ছাড়াও বিভিন্ন রকম রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে এলে শুক্রাণু উৎপাদন ব‌্যাহত হতে পারে।

কয়েকবছর আগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জুওলজি বিভাগের সমীক্ষায় ধরা পড়ে বর্ধমান ও বীরভূমের চাষিরা যারা কমবয়স থেকে চাষের কাজে রাসায়নিক সার ব‌্যবহার করেন, তাদের অধিকাংশই বন্ধ‌্যাত্বের শিকার!

প্রাত‌্যহিক জীবনে আমরা পরিবেশের এমন কিছু রাসায়নিক পদার্থের সংস্পর্শে আসি যেগুলো আমাদের হরমোনের মাত্রার তারতম‌্য ঘটিয়ে শুক্রাণু উৎপাদনকে ব‌্যাহত করে। এদের এন্ডোক্রাইন ডিসরাপটিভ কেমিক‌্যাল বলা হয়, সংক্ষেপে (ইডিসি)। এরা বিভিন্নভাবে পুরুষের শরীরে প্রবেশ করে ও নানাবিধ অসুবিধা সৃষ্টি করে। বন্ধ‌্যাত্ব তার মধ্যে অন‌্যতম।

জীবনচর্চা কীভাবে বন্ধ‌্যাত্বের সঙ্গে যুক্ত?
এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ পরিসর। দৈনন্দিন বেঁচে থাকার প্রতিটি মুহূর্তে আমরা নানাবিধ পরিস্থিতি ও অভ‌্যাসের মধ‌্য দিয়ে যাই যেগুলো শুক্রাণু উৎপাদনকে ব‌্যাহত করতে পারে। গবেষণায় দেখা গিয়েছে, কর্মক্ষেত্রে মানসিক চাপ পুরুষের বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ।

এছাড়াও সিগারেট ও মদ্যপানের অভ‌্যাস, ফাস্ট ফুড, অত‌্যধিক কফি খাওয়া। হেরোইন, গাঁজা, ড্রাগ পুরুষের বন্ধ্যাত্ব দ্রুত ডেকে আনে। একটানা বসে কাজ করা, কোলের উপর ল‌্যাপটাপ রেখে কাজ করা, প‌্যান্টের পকেটে দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ফোন রাখা, আঁটসাঁট অন্তর্বাস সারাদিন পরে থাকা ইত‌্যাদির প্রভাব সরাসরি শুক্রাণু উৎপাদনের উপর পড়ে ও বীর্যের গুণগত মানকে কমিয়ে দেয়।

ল‌্যাপটপ বা মোবাইল কীভাবে ক্ষতি করে?
পুরুষের অণ্ডকোষ দু’টি শরীরের বাইরে স্ক্রোটাম নামক একটি চামড়ার থলির মধ্যে থাকে। একটি নির্দিষ্ট তাপমাত্রার ভিতর অণ্ডকোষের ভিতরে থাকা সেমিনিফরোস নালিতে শুক্রাণু বা স্পার্ম উৎপাদন হয়। তাপমাত্রা নির্দিষ্ট মানের উপরে গেলেই শুক্রাণু উৎপাদকারী সংবেদনশীল কোষগুলির মৃত্যু ঘটতে থাকে। কোলের উপর ল‌্যাপটপ রেখে কাজ করলে, ল‌্যাপটপ থেকে উৎপন্ন উত্তাপ ও বিকিরণ সরাসরি অণ্ডকোষকে প্রভাবিত করে। একইরকমভাবে পকেটের মোবাইল এর বিকিরণ ও চৌম্বক ক্ষেত্র শুক্রাণু উৎপাদনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। খুব আঁটসাঁট অন্তর্বাসও স্ক্রোটামের তাপমাত্রা বাড়িয়ে শুক্রাণু উৎপাদন ব্যাহত করে।

খাদ‌্যাভ‌্যাস ও পুরুষ বন্ধ‌্যাত্ব
অস্বাস্থ‌্যকর খাবার, বিশেষ করে ফাস্ট ফুড এক্ষেত্রে খুব ক্ষতিকর। অতিরিক্ত শর্করাযুক্ত পানীয়, আলু, ফ‌্যাটযুক্ত মেয়োনিজ ও চিজ, পাঁঠার মাংস ইত‌্যাদি শরীরে ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলে ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস তৈরি করে। দীর্ঘ গবেষণায় দেখা গিয়েছে যে এই জাতীয় খাদ‌্যগুলির জন্য শুক্রাণু চলৎক্ষমতাহীন হয়ে পড়ে, বীর্যে শুক্রাণুর সংখ‌্যা দ্রুত হ্রাস পায় এবং বীর্যের অন‌্যান‌্য সূচকগুলো খুব খারাপ হয়ে যায়।

সিগারেট, অ‌্যালকোহল বা কফি ক্ষতিকারক?
সিগারেটে প্রায় ৪৭০০ প্রকার মিউজেনিক পদার্থ থাকে যা শুক্রাণুর গঠন, সংখ‌্যা, স্বাস্থ‌্য এবং ডিএনএ-ভাঙনের জন‌্য দায়ী। দিনে ১০টির বেশি সিগারেট খাওয়া এই ক্ষতির মাত্রা উল্লেখযোগ‌্যভাবে বৃদ্ধি করে। দৈনিক মদ‌্যপানে অভ‌্যস্ত পুরুষদের মধ্যে সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছে যে ৮ শতাংশের বীর্যের গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে। কফির মধ্যে থাকা ক‌্যাফাইনও একইভাবে শুক্রাণু উৎপাদন পদ্ধতি ব‌্যাহত করে। তবে পরিমিত কফি সেবনে এই ক্ষতির সম্ভাবনা কম।

এই অবস্থায় করণীয়?
বয়ঃসন্ধির সময় থেকেই অভিভাবকদের একটি কিশোরকে এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে।
নেশার বস্তু এড়িয়ে চলা।
স্বাস্থ‌্যকর খাদ‌্যাভ‌্যাস গড়ে তোলা।
অপেক্ষাকৃত ঢিলেঢালা পোশাক পরা।
অধিক সময় অন্তর্বাস না পরে থাকা।
দৈনিক শরীর চর্চা করা।

একটু দায়িত্বশীল ও সচেতন হলেই ‘মেল ইগো’তে মনে হয় খুব বেশি আঘাত লাগবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে একটি সুস্থ‌ সন্তান জন্ম দেওয়ার জন‌্য বাবার দায়িত্ব মায়ের থেকে কোনও অংশে কম নয়। সুত্র সংবাদ প্রতিদিনের।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension