মুক্তমত

ফোর্থ অব জুলাই: ব্যক্তির বিকাশে আমেরিকা

শাহ্ জে. চৌধুরী


আজ ‘ফোর্থ অব জুলাই’ আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। আমেরিকা যে স্বাধীনতা লাভ করেছে- আজকে তার ২৪৭তম বছর হলো। আমরা সকলেই জানি, স্বাধীনতা হলো অন্যের কোনো কাজে বাধা বা হস্তক্ষেপ না করা এবং নির্দিষ্ট একটি সীমার মধ্যে থেকে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করা। নির্দিষ্ট এই সীমাটি হলো অন্যের সমস্যা না করা। মানে হলো স্বাধীনতা হলাে এমন সুযােগ-সুবিধা ও পরিবেশ, যেখানে কেউ কারও ক্ষতি না করে সকলেই নিজের অধিকার ভােগ করে। স্বাধীনতা ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়তা করে এবং অধিকার ভােগের ক্ষেত্রে বাধা অপসারণ করে।

অন্যের যাতে কোনো রকম ক্ষতি না হয় সেটি নিশ্চিত করে আপনি নিজের ইচ্ছেমতো চলতে পারবেন। আর সেটি নিশ্চিত করতে তৈরি করা হয়েছে আইন, লেখা হয়েছে সংবিধান। সংবিধান দেশের সকল নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা করে। শুধু আমেরিকা নয়, বিশ্বের সব দেশের সংবিধানই স্ব স্ব দেশের নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা করে। সেকারণে নাগরিকের স্বার্থ রক্ষা বিষয়টি নিশ্চিত করতে তৈরি করা হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। এই সংস্থা যদি সৎ হন তাহলে নাগরিকরা আইনের সুফল পাবেন। যদি সৎ না হন তাহলে ভোগান্তির স্বীকার হবেন। উদাহরণ হিসেবে আপনারা আমেরিকা ও বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তুলনা করতে পারেন।

১৭৭৬ সালের ৪ জুলাইতে স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল এবং তখন এক সার্বভৌম আমেরিকান যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম হয়েছিল। তাহলে ৪ জুলাইয়ের আগে আমেরিকা কি ছিল? উত্তর হলো, আমাদের মতোই ইংল্যান্ডের উপনিবেশ ছিল।
৪ জুলাই ১৭৭৬ সালে পেনসিলভেনিয়া প্রাদেশিক আইনসভায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র স্বীকার করে নেওয়া হয়। এর মাধ্যমে গ্রেট ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধরত ১৩ টি মার্কিন উপনিবেশ নিজেদের ব্রিটিশ শাসনের বাইরে স্বাধীন ও সার্বভৌম হিসেবে ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্র নামে নতুন রাষ্ট্র গঠন করে। আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক ছিলেন জর্জ ওয়াশিংটন। তিনি আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্টও ছিলেন। জর্জ ওয়াশিংটন ছিলেন ভার্জিনিয়ার ইংরেজ উপনিবেশের এক জমিদারের ছেলে। তার যখন একুশ বছর বয়স, তখন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। তিনি ইংরেজ ঔপনিবেশিকদের অত্যাচার নির্যাতনের বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে ব্যাপক আন্দোলন শুরু করেন। ১৭৭৪ – ৭৫ সালে কন্টিনেন্টাল কংগ্রেস নামে আমেরিকা মহাদেশীয় সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশনে তিনি জাতীয় সৈন্যদল গঠনের দায়িত্ব পান। ইংল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের অধীন আমেরিকার ১৩ টি উপনিবেশ এর মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তথা বাণিজ্যিক বিরোধ এবং উভয়ের মধ্যকার ক্রমবর্ধমান দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যই তৈরি করেছিল এ যুদ্ধের পটভূমি। ব্রিটিশরা কর আরোপের কারণে মূলত এই যুদ্ধ শুরু হয়। এই করকে মার্কিনীরা বেআইনি হিসেবে দেখত। জর্জ ওয়াশিংটনের নেতৃত্বে এভাবেই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা।

বিশ্বের ইতিহাসকে আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ খুব গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ছিল স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জয়যাত্রার দিন। এদিনে অবাধ বাণিজ্য ও পুঁজিবাদের বিকাশ শুরুর দিনও বটে। আর ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা ও ধর্ম পালন করতে পারার স্বাধীনতার স্বীকৃতি। শোষণ অবিচারের মূলোৎপাটনই ছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধের ফলাফল। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধটিই প্রথমবারের মতো ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কোনো উপনিবেশ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে জয়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধ থেকেই ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের পরাজয় শুরু হয়েছিল।

এখন যদি প্রশ্ন ওঠে, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা কতটা স্বাধীন- তাহলে এর উত্তরটি কি হবে? অনেকেই আমেরিকার বন্দুকধারীদের নির্বিচার গুলিতে রোজই মানব হত্যার দিকে দিকে আঙুল তুলছে। আঙুল তোলাও দরকার, কেননা স্বাধীনতা মানে নিজের যা খুশি তা করা নয়, অন্যের ক্ষতি করে নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে থেকে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী থাকা। সাম্প্রতিক কালের এই বন্দুকধারীরা স্বাধীনতার এই সংজ্ঞাটি মানছেন না। সেকারণে অবশ্যই তাদের দিকে আঙুল তুলতে হবে, তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় ইমিগ্রেন্ট্রের দেশ। নিউ ইর্য়কের একজন অধিবাসী হিসেবে বলছি, এখানকার আইনকানুন ও বিচার ব্যবস্থা কিছুটা ব্যতিক্রম। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যারা বাস করেন তারা সকলেই কিছু ফান্ডামেন্টাল রাইটস্‌ বা মৌলিক অধিকার ভোগ করেন। এই মৌলিক অধিকার আইন ও সংবিধানে নিশ্চিত করেছে। এদেশের কোনো নাগরিকের অধিকারের ওপর এদেশের সরকার বা আইন কিংবা আমেরিকান সংস্থার হস্তক্ষেপ বেআইনি। কাউকে তার বর্ণ, ধর্ম,অথবা জন্মস্থানের ভিত্তিতে কোনো ধরনের বৈষম্য করা যায় না। এমন কি আমেরিকায় কারও বসবাসের বৈধ কাগজপত্র না থাকলেও সে আইন তার সবধরনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বাধ্য। আমেরিকার সংবিধানে নাগরিক অধিকারগুলোই মানবাধিকার। এখানে আলাদা কোন মানবাধিকার বিষয়ক ধারা নেই।

ব্যক্তির বিকাশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান দুটি, একটি হলো শিক্ষা এবং অপরটি অর্থনীতি। দেশে কোনো একক জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা নেই। প্রতিটি রাজ্যই তার শিক্ষা কাঠামো স্বাধীনভাবে নির্ধারণ করে। শিক্ষার অর্থায়ন পাবলিক, নিয়ন্ত্রিত এবং ফেডারেল, রাজ্য এবং স্থানীয় পর্যায় থেকে করা হয়। উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুললোর বেশিরভাগই বেসরকারি। ফেডারেল সরকার প্রায়ই শিক্ষা ব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ করে না। আমেরিকার শিক্ষা ব্যবস্থার লক্ষ্যটিই হলো সামাজিক ভেদাভেদ দূর করে শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণ করা।

আর অর্থনীতি নিয়ে বলার মতো বিশেষজ্ঞ আমি নই। একজন বিশেষজ্ঞ থেকে ধার করে বলি, ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের সবচেয়ে বৃহত্তম জাতীয় অর্থনীতি এবং শিল্পায়নের প্রতীক। বিশ্ব রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে এবং বিশ্বের তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় এর বিশেষ প্রভাব অনস্বীকার্য। পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ শিখরে অবস্থানরত এই দেশটির সম্পদ, উচ্চ জীবনযাত্রার মান, প্রথম পরাশক্তি এবং বিশ্ব-মানের পরিষেবার প্রাপ্যতার কারণে, অনেক আমেরিকানসহ পৃথিবীর অনেকেই বিশ্বাস করে যে সুযোগ, স্বপ্ন অর্জন এবং সত্যিকারের মানুষ হিসাবে বসবাসের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে ভালো দেশগুলোর মধ্যে একটি।’

তবে স্বাধীনতার প্রধান নিরিখটা আসলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি। শ্রমের সঠিক অর্থনৈতিক মূল্যায়ন হলেই অর্জিত স্বাধীনতা সার্থক হয়েছে বলা যাবে। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো পৃথিবীর প্রায় কোনো দেশই জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। তেমনি শ্রমের সঠিক অর্থনৈতিক মূল্যায়নও করতে পারে নি। বিবিসি এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনগোষ্ঠীর ছয় ভাগের এক ভাগ দারিদ্র্য-পীড়িত। …তাদের পরিবার প্রতি গড় আয় কমে গেছে।’

অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী ও সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির সাবেক প্রফেসর অ্যাংগাস ডিটন বছর কয়েক আগে এক নিবন্ধে লিখেছিলেন, ‘ক্যাথরিন এডিন ও লিউক শায়েফার যুক্তরাষ্ট্রের কয়েক মিলিয়ন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের ভয়ঙ্কর রূপ তুলে ধরেছেন, যারা বস্তুত গ্রাম ও শহর এলাকায় দৈনিক মাত্র ২ ডলারে দিনাতিপাত করেন।

অসুখটা সেই পুরনোই- অল্প কিছু মানুষ অত্যধিক ধনী আর তাদের সেবক হয়ে রয়েছে বাদবাকি জনগোষ্ঠী। ভেঙে পড়েছে মধ্যবিত্তের সামাজিক অবকাঠামো। শ্রমিক শ্রেণী তো চিরকালই বিপর্যস্ত। এই বিপর্যস্ত অবস্থা এখন বিধ্বস্ত হয়েছে – এসবের সবই সত্য। তবুও জিজ্ঞাসা থেকে যায়, আমেরিকার নাগরিকেরা আসলে কেমন আছে? সকল নাগরিকের কথা আমি একলা যদি বলতে যাই সেটি সমীচীন হবে না। আমি আমার কথা বলি। আমি থাকি নিউ ইয়র্কে। আমাকে কখনও আমার ছেলেয়েদের লেখাপড়া নিয়ে ভাবতে হয় নি। ভাবতে হয় না এখনও। আর সকল বাবা-মায়েদের মতো আমার ছেলেমেয়েরাও আমার অহংকার। তাদের শিক্ষা, তাদের মূল্যবোধ, তাদের মানবিকতা নিয়ে আমি ও আমার স্ত্রী গর্ব করি। ছেলেমেয়েদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান তিনটি- প্রথমটি নিজের পরিবারের শিক্ষা, দ্বিতীয়টি যে সমাজে সে বাস করে সে সমাজের চারপাশের মানুষদের কাছ থেকে পাওয়া শিক্ষা এবং শেষেরটি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে ২৫ হাজার বিপ্লবী আমেরিকান মারা যান। এছাড়াও ২৭ হাজার ব্রিটিশ ও জার্মান সেনার মৃত্যু হয়। এতজন মানুষের জীবনের বিনিময়ে প্রাপ্ত আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে লেখা হয় স্বাধীনতার বাণী- ‘প্রতিটি মানুষই সমান এবং একই সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি’। এই কথাটিই মানুষে মানুষে ভেদাভেদ করতে নিরুৎসাহিত করে। আমেরিকায় যারা বাস করেন তারা সেটি বিশ্বাসও করেন। আর যার যা কিছু- সেটি নিজেকেই অর্জন করতে হয়।

সবাইকে ‘ফোর্থ অব জুলাই’-এর শুভেচ্ছা।

লেখক: সম্পাদক, রূপসী বাংলা

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension