
নাসরীন জাহান
বই নিয়েই লেখকের এক জীবন। বই পড়া আর বই লেখা, এটাই লেখকের নিয়তি, লেখকের আরাধ্য কাজ। সাহিত্যের জগৎজোড়া পাঠশালায় কত না স্বাদের বই। এসব বই জীবনভর পড়ে তো শেষ করা যাবে না কখনোই, আবার যে বইগুলো পড়া হয়েছে তার কথাও কি বলে শেষ করা যাবে? জীবনের অংশ হয়ে যাওয়া কিছু বই আর কয়েকজন লেখককে নিয়ে তো কিছু কথা বলাই যায়।
কৈশোরে, যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি, তখন ছিলাম রূপকথার জগতে আর পড়তাম শিশু-কিশোরদের বই। তখন সায়েন্স ফিকশন আমার তেমন পছন্দের ছিল না। তখন একদিন আমার বড় বোনের কাছ থেকে একটা বই আমার হাতে আসে। বইটি সায়েন্স ফিকশন ছিল কি-না জানতাম না। বইয়ের নাম ‘উভচর মানুষ’, লেখক আলেক্সান্দার বেলায়েভ। সেই বয়সে বইটি পড়ায় আমার চারপাশের জগৎটা কেমন যেন শূন্য হয়ে গেল। গল্পটা ট্র্যাজিক, একজন উভচর মানুষ, যে জল ও ডাঙা দুই জায়গায়ই বাস করে। পরে তার জীবনের করুণ পরিণতি হয় মৃত্যুর মাধ্যমে। তার মৃত্যু আমি কিছুতেই মেনে নিতে পারি নি। আমার দিন যায় না, রাত যায় না তার পরিণতির কথা ভেবে। আসলে আমি চরিত্রটির প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। প্রেমিকের মৃত্যুতে প্রেমিকার মনে যেমন বিরহের জন্ম নেয়, আমিও ঠিক একই রকম দুঃখের মাঝে পড়ে যাই। একটা মানুষ যে জলে বাস করে, ডাঙায়ও বাস করে; সে দেখতে আবার মানুষের মতোও না। ‘উভচর মানুষ’ পড়ার মাধ্যমে যেটা হলো- আমার মধ্যে স্বাভাবিক লেখার বাইরে অন্যরকম লেখার একটা সুপ্ত বীজ রোপিত হয়। বলা যায়, সুরিয়ালিজমের শিক্ষা আমি তখনই পাই। তখন আমি এ রকম অন্য স্বাদের বই খুঁজতে থাকি। যাদের বলতাম তারা সায়েন্স ফিকশন বই ধরিয়ে দিত। কিন্তু সায়েন্স ফিকশন আমার ওই অর্থে ভালো লাগতো না পড়তে।
ক্লাস নাইন-টেনে পড়ার সময় লেখালেখির ক্ষেত্রও পরিবর্তন হয়। ছড়া ছেড়ে গল্পে হাত দিই। তখন ‘দৈনিক বাংলা’র সাহিত্যপাতায় আমার প্রথম লেখা ছাপা হয়। সে সময় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র ‘চাঁদের অমাবস্যা’ আর ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ পড়ে আমি গভীর আচ্ছন্নতার মধ্যে পড়ে যাই। ‘কাঁদো নদী কাঁদো’ আমার কাছে ভীষণ রকমের বিমূর্ত লেগেছিল। সেই বিমূর্ততার মধ্যেও যে টান, যে আচ্ছন্নতা, যে ঘোর আছে- তা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। ‘চাঁদের অমাবস্যা’র দৃশ্য যেখানে পূর্ণিমা রাতে একটি মৃত মেয়ে বাঁশঝাড়ে পড়ে আছে, যে কিনা খুন হয়েছে। সাংঘাতিক একটা চিত্রকল্প। এই দৃশ্যটি আমাকে এখনও তাড়া করে বেড়ায়। তার ভাষা এত নৈর্ব্যক্তিক, এত দুধর্ষ- যা সচেতন পাঠকমাত্রই উপলব্ধি করতে পারেন। এরপর আমি তাঁর যত বই পেয়েছি, সবই পড়েছি ঘোরগ্রস্তের মতো।
সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্র পর আমাকে দারুণ জ্বরে আক্রান্ত করেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। মানিকের অতুলনীয় সৃষ্টির জগতে প্রবেশ করি ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র মাধ্যমে। এই বইটি আমার লেখক জীবনের অনেক বড় বাঁক হয়ে আছে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’ আমার মধ্যে ভীষণ তোলপাড় তৈরি করে। বলা চলে, একেবারে নাড়া খেয়ে গেলাম উপন্যাসটি পড়ে। মানুষের মনস্তত্বের চিত্রায়ণ যেভাবে করেছেন মানিক, তার আসলেই তুলনা নেই। ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসে হেরম্বের প্রেমিকা আনন্দ যখন ঘুরে ঘুরে আগুনে পুড়ে মারা যাচ্ছে, আমি হাঁ হয়ে সেই দৃশ্যকল্পের দিকে তাকিয়ে থাকি আর ভাবি কী লিখছেন মানিক- কীভাবে লিখতে পারেন একজন মানুষ এসব! এ কথা অবশ্যই বলবো যে, বাংলাসাহিত্যে মানিকের মতো এতটা প্রভাবিত আর কোনও লেখক আমাকে করতে পারে নি।
আমি সব সময় একটা কথা বলি, লেখকের গুরু কোনও মানুষ বা লেখক হতে পারেন না, লেখকের গুরু হচ্ছে ভালো বই। ওইটুকু বয়সেই আমি ভিন্ন টাইপের লেখা লিখতাম বলে স্কুলে পড়া অবস্থাতেই কবি আহসান হাবীব সাহিত্যপাতায় আমার লেখা ছেপেছিলেন। নতুন ধরনের ভিন্ন রকমের লেখা আমার পক্ষে লেখা সম্ভব হয়েছে এসব মহৎ সাহিত্যপাঠের মাধ্যমে। এসব বইয়ের কল্যাণে আমার নিজের লেখা আমূল বদলে গিয়েছিল।
ম্যাট্রিক পরীক্ষার পর পরই আমার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পর ঢাকায় এসে লালমাটিয়া কলেজে ভর্তি হই। তখন আশরাফের মাধ্যমে বেশ কয়েকজন লেখকের বই আসে হাতে। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন দস্তয়ভস্কি, তলস্তয়, অ্যাডগার অ্যালান পো, কাফকা। দস্তয়ভস্কির ‘ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট’ পড়ে মনে হলো যেন নতুন কিছু আবিস্কার করলাম। ওই বইটিও আমাকে ভীষণ আলোড়িত করে। পড়ার পর মনে হয়েছে এর আগে কোনও লেখা এমন নাড়া দিতে পারে নি আমাকে। বইটি শেষ করে প্রায় এক সপ্তাহের মতো আমি চলতে-ফিরতে পারি নি। আমার মনে হতো আমি অবশ হয়ে গিয়েছি। আমি খাবার খেতে পারতাম না। কোনও কিছুই ভালো লাগতো না। অ্যালান পোর গল্প প্রথম প্রথম মনে হতো হরর ধারার। পরে বুঝতে পারলাম, এসব হরর গল্প নয়। তার মধ্যে আছে অন্য জাদু। তার গল্প পড়ে শিহরিত হতাম। অ্যালান পোর লেখা দ্বারাও আমি প্রভাবিত। আমার লেখার মধ্যে যে ভুতুড়ে ছায়াচ্ছন্নতা, যে বিমূর্ততা- সে সব তার কাছ থেকেই এসেছে। কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ পড়ে মার্কেজ যেমন লেখক হওয়ার অনুপ্রেরণা পেয়েছেন, আমিও তেমনি কাফকার সৃষ্টির নানান দিক দ্বারা প্রভাবিত হয়েছি সময়ে সময়ে। কাফকার ‘মেটামরফোসিস’ গল্প পাঠ করার পর গ্রেগর সামসা আমাকে এতটা মোহাবিষ্ট করে যে, আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে ভুলে গিয়েছিলাম, খাবার খেতে পারি নি প্রায় সপ্তাহখানেকের মতো।
এভাবে ক্ষণে ক্ষণে নানান লেখকের হাত ধরে আমার পাঠাভ্যাস ও লেখার বাঁকবদল হয়েছে। নতুন নতুন লেখক এবং বইয়ের সঙ্গে পরিচিত হতাম, মনে হতো আর কোনও ধস বোধহয় আমার জীবনে ঘটবে না। কিন্তু পরক্ষণেই কোনও একজন লেখক এসে হয়ত আমাকে ধসিয়ে দিয়ে যেত। এভাবে নতুন নতুন বইয়ের লোভে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে যাওয়া শুরু করি। কেন্দ্রের ছাদে বসে তুমুল আড্ডায় মেতে উঠতাম আমরা কয়েকজন। ওরা ভীষণ বই পড়ত, একজন আরেকজনকে বই দিতো আর আলোচনায় মেতে থাকত। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিতে আমার লোভ হতো। সে আড্ডায় থাকত নয়জন ছেলে। তাদের মধ্যে আমি ছিলাম একমাত্র মেয়ে। যদিও ওরা ভোটাভুটির পর আমাকে তাদের আড্ডার সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। তাদের সঙ্গে এমনভাবে মিশতাম, যেন আমি মেয়ে নই, ওদের মতোই ছেলে। সপ্তাহে একদিন আমাদের বাসায়, আরেকদিন কেন্দ্রের ছাদে আমরা আড্ডা দিতাম। সবাই প্রতি সপ্তাহে নতুন নতুন গল্প লিখতাম। তারপর সবার গল্প পাঠের পর চুলচেরা আলোচনা হতো। তাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে, কথা বলে আমার সাহিত্যপাঠের ভাণ্ডার ভারী হয়েছে অনেক।
ওই সময় আমি মার্কেজের লেখার সঙ্গে পরিচিত হই। মার্কেজের লেখা পড়ে আমি দস্তুরমতো জাদুবাস্তবতার মধ্যে ডুবে যাই। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন আমাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল; মার্কেজও ঠিক তেমনি কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। তার ‘সরলা এরেন্দিরা ও তার নির্দয় ঠাকুমার করুণ কাহিনী’ গল্পটি আমার পুরো ভূমণ্ডল উল্টেপাল্টে দিল। গল্পের চরিত্র এরেন্দিরার ভুলে তার দাদির ঘরে আগুন লেগে যায়। তার দাদি সব ক্ষতিপূরণ শোধ করার জন্য তাকে বেশ্যাবৃত্তিতে নিযুক্ত করল। এরেন্দিরা প্রতিদিন কয়েকশ’ লোককে তার শরীরে ওঠায়। গল্পটি পড়ে আমি আভিভূত হই, ভাবি কীভাবে একজন লেখক এত স্বাভাবিকভাবে এসব লিখতে পারে। পড়ে মনে হয় এটা যেন অস্বাভাবিক কোনও ব্যাপার নয়। মার্কেজের ভাষা, মার্কেজের চিন্তা, গল্পের গাঁথুনি আমার ভালো লেগে যায়।
প্রিয় লেখকদের কালজয়ী গল্প-উপন্যাসের পাশাপাশি কয়েকটি চরিত্রও আমাকে মোহগ্রস্ত করে রেখেছে। যে চরিত্রগুলো ভালো লাগত, মনে হতো আমি তাদের দেখতে পাচ্ছি। প্রিয় চরিত্রের কথা বলতে চাইলে বিশেষভাবে দুটি নারী চরিত্রের কথা বলতেই হয়। একটি হলো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’র পুতুল, অন্য চরিত্রটি হলো তলস্তয়ের ‘আন্না কারেনিনা’র আন্না। বইটি পড়ে আমি মহা মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ি। চরিত্রগত দিক থেকেও নিজেকে আমার আন্নার মতোই মনে হয়। আমার মেয়ে যখন গর্ভে, তখন ‘আন্না কারেনিনা’ পড়ি। আমি আমার মেয়ের নাম রাখতে চেয়েছিলাম আনা। জন্মের পর এক সপ্তাহের মতো ওর নাম ছিল আনা! উপন্যাসের নায়িকা আন্না ছিল ভীষণ সুন্দরী, জীবনের এক জটিলতায় সে ট্রেনের নিচে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করে। আশরাফ বলল, তুমি কি উপন্যাস থেকে মেয়ের নাম আনা রাখতে চাইছ? তাকে বললাম- হ্যাঁ, আমি উপন্যাসটি দ্বারা ভীষণ আক্রান্ত হয়ে আছি। উপন্যাসে আন্নার করুণ পরিণতির কথা ভেবে আশরাফ কিছুতেই রাজি হয় নি ওই নাম রাখতে! এ ছাড়াও প্রিয় চরিত্রের মধ্যে আছে ‘দিবারাত্রির কাব্য’ উপন্যাসের হেরম্ব। আমি রীতিমতো তার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। আমি তাকে খুঁজতাম। আমার মনে হতো এই হেরম্ব উপন্যাসের কোনও চরিত্র নয়, এটা বাস্তব চরিত্র, হেরম্ব সত্যিই আছে!
বই আমার জীবনের একটি বড় অংশ। বই ছাড়া কিছু কল্পনা করা সত্যিই অসম্ভব। জীবনের এতগুলো বছর কাটিয়ে এসে পেছন ফিরে তাকাই যখন, দেখি প্রিয় লেখকদের প্রিয় বইগুলো আর প্রিয় মানুষ যাদের সংস্পর্শ ছাড়া এই আমার যেন কোনও অস্তিত্বই নেই। যে লেখকদের বইগুলো আমার লেখকসত্তা গড়ে দিয়েছে, আমি তাদের কাছে ঋণী। আমি ঋণী আমার বন্ধুদের কাছে, আমার স্বামী, আমার পরিবার- সবার কাছে আমি ঋণী।
লেখক: কথাসাহিত্যিক