মুক্তমত

বঙ্গবাজার ট্র্যাজেডি ও আমাদের উদ্বেগ

শাহরিয়ার মোহাম্মদ ইয়ামিন


‘নগর পুড়লে দেবালয় কি এড়ায়?’ চোখের সামনেই যখন দাউদাউ করে স্বপ্নগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়, ঈদকে সামনে রেখে বিভিন্ন জায়গা থেকে কষ্ট করে ধারদেনা করা ‘বিনিয়োগ’ যখন মুহূর্তেই নাই হয়ে যায়, তখন নিজেকে কীভাবে সামাল দেওয়া যায় তা ভেবে পাচ্ছি না। তবে, এই ভয়াবহ আগুন নিয়ন্ত্রণে পানির অন্যতম উত্স ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ হলের পুকুর। একসঙ্গে প্রায় ২০টা পাম্প বসিয়ে পানি সরবরাহ করা হয় যা অগ্নিনির্বাপণে মুখ্য ভূমিকা রাখে। ভাগ্যিস বিশ্ববিদ্যালয় আঙিনায় এখনো দুই-চারটি পুকুর আছে। মাঝখানে দেখলাম বিমানবাহিনী হেলিকপ্টারে হাতিরঝিল থেকে বালতি করে পানি আনছে যা অনেকটা মশা মারতে কামান দাগানোর মতো। আজকে শহীদুল্লাহ হলের এই পানির উত্স না থাকলে আগুনের লেলিহান শিখা আরো কত ভয়াবহ হতো, আরো কত স্বপ্ন পুড়ে ছারখার হতো, কবে নাগাদ আগুন নিয়ন্ত্রণে আসত, তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু, দুঃখের বিষয় কী জানেন? কখনো শুনব এসব পুকুর ভরাট করে নতুন ভবন তুলছে। এ রকম পুকুর ভরাট করে দালানকোঠা নির্মাণ করতে বহু দেখেছি। অথচ, এটাও যে প্রকৃতি ও ইকোসিস্টেমের অন্যতম একটা উপদান তা কেউ-ই ভাবে না, কেয়ারই করে না।

এই ঢাকা সম্পূর্ণরূপে বাসযোগ্যতা হারিয়েছে অন্তত এক যুগ আগেই। একটা শহর কতটা অপরিকল্পিত, অনিয়ন্ত্রিত ও অনিয়মে ভরপুর তা বর্ণনাতীত। এই শহরের আলো-বাতাস, পানি থেকে শুরু করে মাটি পর্যন্ত সবই দূষিত। এটি একটি ঝুরঝুরে ভঙ্গুর শহর। বিশ্বাস করেন, পুরান ঢাকা গেলে মনে হয়, এই বুঝি কোনো বিল্ডিং ধসে পড়বে মাথার ওপর। এই শহরের অন্তত ৮০ শতাংশ ভবন ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড’ বহির্ভূত। তার বেশির ভাগই অযোগ্য ঠিকাদারদের দ্বারা তৈরি করা। এই শহরে যদি তুরস্ক-সিরিয়ার মতো একটা ভূমিকম্প হয়, এটি মৃতুপুরীতে পরিণত হবে। এমনকি ইমার্জেন্সি রেসপন্স এবং রিকোভার কার্যক্রম পরিচালনার মতো জায়গা থাকবে না, সুযোগ থাকবে না। এতটাই ঘনবসতি, অপরিকল্পিত, অরক্ষিত!

নগরায়ণ যে অনিয়ন্ত্রিত হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, পরিবেশ বিপর্যস্ত হচ্ছে, তাতে কয়েক দশক পরেই মানুষ পালাতে বাধ্য হবে শুধু নিজেকে বাঁচাতে, ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। এর পরও অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে—এই শহরকে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো উদ্যোগ নেই, উত্কণ্ঠা নেই। বেশকিছু মন্ত্রণালয়ের কাজ, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং শিল্পকারখানাগুলোকে আশপাশের শহরগুলোতে প্রতিস্থাপন করলে কিছুটা চাপ কমত। সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়া তাদের রাজধানী জাকার্তা থেকে সরিয়ে বোর্নিও দ্বীপে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এর আগেও বেশকিছু দেশ যেমন—নাইজেরিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার, কাজাখস্তান, মিশর, ব্রাজিল ইত্যাদি দেশ তাদের রাজধানী সরিয়ে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে। অতএব, ঢাকাকে বাঁচাতে হলে এটি প্রতিস্থাপন বা বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই।

যাহোক, আমরা যদি একটু লক্ষ করি, এ পর্যন্ত যতগুলো ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটেছে যেমন পুরান ঢাকার নিমতলী, চকবাজার থেকে বনানী, সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি, নারায়ণগঞ্জের গার্মেন্টস, গুলশানের ডিএনসিসি মার্কেট, প্রতিটি অগ্নিকাকাণ্ডের ঘটনায় অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে আমাদের জাতীয় অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। বছরের পর বছর এসব চোখের সামনে দেখলেও এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনা ঘটলেই যত সব আমাদের দৃষ্টি কাড়ে। এই যে বঙ্গবাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়ছিল অনেক বার। কিন্তু, কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, ফলে হাজার মানুষের স্বপ্ন, বেঁচে থাকার অন্যতম উত্স মুহূর্তেই শেষ।

সাধারণত কোনো স্থান বা ভবনকে পর্যাপ্ত অগ্নিপ্রতিরোধক করতে হলে আগুন লাগার সম্ভাব্য কারণগুলো সম্পূর্ণভাবে দূর করাই অগ্নিনিরাপত্তা বিধানের সবচেয়ে কার্যকর উপায়। এটা হলো প্রতিরোধ। এর সঙ্গে সঙ্গে পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থাও রাখতে হবে। মূলত, এই দুইয়ের সমন্বয়েই তৈরি হয় একটি পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থা। এই ঘটনায় অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় হলো, বঙ্গবাজারের পাশেই ফায়ার সার্ভিসের সর্ববৃহত্ ইউনিট। প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে আগুনের সূত্রপাতের সময় তারা পর্যাপ্ত পানি বা ইকুইপমেন্ট যেমন—এক্সটিংগুইশার, স্প্রিঙ্কলার ইত্যাদি নিয়ে যায়নি। পর্যাপ্ত পানিও রিজার্ভ ছিল না। পরে পানির উত্স সন্ধান এবং সংযোগ দিতে দিতে ততক্ষণে আগুন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।

তো আগুনের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে বিল্ডিং কোড মেনে চলার বিকল্প নেই। এছাড়াও, আগুন ও ধোঁয়া যাতে ছড়াতে না পারে সে জন্য পর্যাপ্ত ফায়ার সেপারেশন ও ধোঁয়া নির্গমন পথের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমেই আশপাশ থেকে দাহ্য বস্তু বা সহজেই জ্বলে ওঠার মতো জিনিসপত্র সরিয়ে ফেলতে হবে। যথাসম্ভব আগুনে অক্সিজেনের উত্স বন্ধ করতে হবে। সর্বোপরি, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসনের যথাযথ মনিটরিং এবং কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। কোনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থান চিহ্নিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব তা নিরাপদ করতে হবে। সুরক্ষা ও ফায়ার সার্ভিস খাতে ব্যয় করে উন্নত বিশ্বের মতো আরো সমৃদ্ধ করা দরকার। পাশাপাশি, কিছুদিন পর পর হঠাত্ হঠাত্ যে ভয়াবহ আগুনের সূত্রপাত হয়, এর পেছনে প্রত্যক্ষ হিউম্যান প্ররোচক কোনো কিছু বা কেউ জড়িত কি না বা নির্দিষ্ট কোনো গোষ্ঠী এজেন্ডা বাস্তবায়নে এমন সূক্ষ্মভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে কি না সে বিষয়ে কঠোর তদন্ত করা সময়ের দাবি।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension