
আতাউস সামাদ জীবনে ও পেশায়
সম্পাদনা: জাকির হোসেন
প্রচ্ছদ: ধ্রব এষ, প্রকাশনা: বিজয় প্রকাশ,
দাম: ৫০০ টাকা।
আতাউস সামাদ। বরেণ্য সাংবাদিক। নিরপেক্ষ ছিলেন না তিনি। ছিলেন মানুষের পক্ষে। আমাদের সমাজে ও পেশায় শ্রদ্ধা ও সমীহ করার মতো যে গুটি কয়েক মানুষের নাম নেওয়া যায়, আতাউস সামাদ ছিলেন তাঁদের মধ্যে বিশিষ্টতম। তিনি ছিলেন আপাদমস্তক সাংবাদিক, আরও নির্দিষ্ট করে বললে আজীবন সত্যানুসন্ধানী রিপোর্টার। বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতায় তিনি ছিলেন এ দেশের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। খবরের পেছনের খবর খুঁজে বের করাই ছিল তাঁর সাধনা।
গেল শতকের পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নেওয়ার আগেই আতাউস সামাদ দৈনিক আজাদ-এ সাংবাদিকতা শুরু করেন। তারপর সংবাদ হয়ে পাকিস্তান অবজারভার-এ। ৭৫ বছরের জীবনে ৫৫ বছরই তিনি কাটিয়েছেন সাংবাদিকতা পেশায়; একটি দিনের জন্যও বিরতি নেননি; কখনো সংবাদপত্রে, কখনো বার্তা সংস্থায় কখনো বা বেতারমাধ্যমে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন পরম নিষ্ঠা ও সততায়।
পাকিস্তান আমলে সদা প্রতিকূল পরিবেশে সাংবাদিকতার পাশাপাশি তিনি সাংবাদিক সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। সত্তরের দশকের শুরুতে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আতাউস সামাদ এবং সভাপতি প্রখ্যাত লেখক ও সাংবাদিক শহীদুল্লা কায়সার। তাঁদের ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন কিংবা দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও একসঙ্গে ইউনিয়নের কাজ করতে অসুবিধা হয়নি। তখন সাংবাদিকতা পেশায় দলবাজি ও সুবিধাবাদিতা এভাবে জেঁকে বসেনি।
ষাটের দশকের শেষ দিকে বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলন, সাংবাদিকতা ও গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা একই সূত্রে গ্রথিত হয়ে যায়। ১৯৬৮-৬৯ সালে একদিকে চলছিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচার; অন্যদিকে আইয়ুববিরোধী গণ-আন্দোলন। পতনোন্মুখ স্বৈরশাসক আত্মরক্ষার কৌশল হিসেবে বিরোধীদলীয় নেতাদের গোলটেবিল বৈঠকে আহ্বান জানালে তাঁরা জানিয়ে দেন, আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ছাড়া তাঁরা এ বৈঠকে বসবেন না। কিন্তু তিনি তো বিচারাধীন বন্দী। আইয়ুব খান তাঁকে প্যারোলে মুক্তির প্রস্তাব দেন। এ সময় সামরিক ট্রাইব্যুনালে আগরতলা মামলার বিচার চলছিল। শেখ মুজিব চাইছিলেন মওলানা ভাসানী তাঁর মুক্তির দাবিতে আন্দোলন করুন এবং সেই বার্তাটি তাঁর কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন আতাউস সামাদই। এর পরই গণ-আন্দোলন গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা শুরুর আগ মুহূর্তে আরও অনেকের মতো আতাউস সামাদও গিয়েছিলেন ৩২ নম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে দেখা করতে। তখন দলীয় নেতা-কর্মীরা প্রায় সবাই চলে গেছেন। আতাউস সামাদ পরবর্তী কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে চাইলে শেখ মুজিব তাঁকে বলেছিলেন, ‘যা, স্বাধীনতা দিয়ে দিলাম। এখন এটি রক্ষা করা তোদের দায়িত্ব।’
এইভাবে বলতে থাকলে ফুরাবে না সে গল্প। একটা গ্রন্থ হয়ে যাবে। সেই কাজটিই করে ফেলেছেন সাংবাদিক ও গবেষক জাকির হোসেন। বরেণ্য সাংবাদিক আতাউস সামাদকে একটি স্মারক গ্রন্থ করেছেন। আতাউস সামাদকে নিয়ে লিখেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট মানুষ। এঁরা সকলে কেবল সংবাদপত্ররই নয়, বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। ফলে ব্যক্তি আতাউস সামাদকে নিয়ে তাঁদের লেখাগুলো আর ব্যক্তি আতাউস সামাদে সীমাবদ্ধ থাকে নি, হয়ে উঠেছে ইতিহাস। গেল শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে এই শতাব্দীর দশ শতক পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস। লেখাগুলো কেবল আতাউস সামাদের পেশাগত জীবনের শাসক শ্রেণী, রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তিবিশেষের বিপরীতে তাঁর গণমুখী, দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চৈতন্যর কথাই বলে নি, একই সঙ্গে বলে গেছে সমসাময়িক বাংলাদেশের ইতিহাস। সে কারণে গ্রন্থটি রাজনীতি সচেতন পাঠকদের অবশ্য পাঠ্য হয়ে উঠেছে।