বাংলাদেশে গণহত্যা চেয়েছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার
‘যুদ্ধবাজ’ হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার মারা গেছেন। তবে নিজের কূটচাল এবং বিশ্বজুড়ে হওয়া কুকীর্তির সঙ্গে নিজের সংশ্লিষ্টতার কারণে ইতিহাসে তিনি থেকে যাবেন। ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, পূর্ব তিমুর, বাংলাদেশের গণহত্যার মদদ দেওয়া কিসিঞ্জারের কীর্তি মুছে যাওয়ার নয়।
বাংলাদেশে পাকিস্তানি দখলদারদের পরিচালিত গণহত্যায় হেনরি কিসিঞ্জারের পূর্ণ সমর্থন ছিল। শুধু সমর্থন নয় সরাসরি সহায়তাও করেছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন কিসিঞ্জার। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের স্নায়ুযুদ্ধ চলমান। ভারতকে সোভিয়েতপন্থী ধরে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে মার্কিন মিত্র হিসেবে দেখার নীতি গ্রহণ করেছিলেন নিক্সন-কিসিঞ্জার।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী পরিচালিত হত্যাযজ্ঞকে ব্যাপকভাবে উপেক্ষা করেছিল যুক্তরাষ্ট্র। হাফপোস্টের প্রতিবেদনে বলা হয়, কিসিঞ্জার পাকিস্তানের কাছে অবৈধ অস্ত্র বিক্রির নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৯৭১ সালে বাঙালির বিরুদ্ধে নৃশংস দমন–পীড়নে এই অস্ত্র ব্যবহার করেছিল পাকিস্তান। ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা ঢাকায় ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে যে গণহত্যা চালায় সেসম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ধারণা ছিল কিসিঞ্জারের।
৮ জুলাই ১৯৭১, এদিন সকালে দিল্লি থেকে রাওয়ালপিন্ডিতে আসেন মার্কিন প্রেসিডেন্টের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার। সন্ধ্যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন তিনি। হেনরি কিসিঞ্জার ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের এই বৈঠকে কোনো প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন না।
একই দিন মার্কিন সিনেটের অধিবেশনে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ বলেন, ‘মার্কিন সরকারের পক্ষ থেকে আরও ২৬ কোটি ২৫ লাখ টাকার অস্ত্র পাকিস্তানে যাবে। কারণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ অস্ত্র পাঠানো বন্ধ করতে অস্বীকার করেছেন। নিক্সন প্রশাসন দক্ষিণ ভিয়েতনামের ওপর হস্তক্ষেপ করতে পছন্দ করেন। কিন্তু, পূর্ব পাকিস্তানে চলমান গণহত্যা বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেননি।’
আর্চার ব্লাডকে ‘চুপ’ করিয়ে দেওয়া হয়
মার্কিন কূটনীতিক আর্চার ব্লাড ১৯৭১ সালে ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্রের কনসাল জেনারেল ছিলেন। বাংলাদেশে পাকিস্তানি নৃশংসতার বিবরণ দিয়ে একের পর এক তারবার্তা যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান এই কূটনীতিক। তিনি পাকিস্তানিদের গণহত্যা, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে বার বার মার্কিন প্রশাসনকে হস্তক্ষেপের আবেদন জানান। কিন্তু কিসিঞ্জারের শীতলতা নিক্সনের কাছেই ঘেষতে দেয়নি এই আকুতি। এদিকে মানবতার বিপর্যয় কাছ থেকে দেখে বর্বতার পক্ষেই নিজ দেশের অবস্থান আর্চার ব্লাডকে হতাশ করে। এই অবস্থানের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে নৈতিক দেউলিয়াত্ব প্রদর্শনের অভিযোগ আনেন তিনি।
টেলিগ্রামে আর্চার ব্লাড বলেন, ‘গণতন্ত্র দমনের বিষয়ে আমাদের সরকার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। আমাদের সরকার নৃশংসতার নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।’
পাকিস্তান নিয়ে এমন মেমো পাঠানোর অল্প সময়ের মাথায় আর্চার ব্লাডকে ঢাকা থেকে ওয়াশিংটনে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। কিসিঞ্জারের পরামর্শে তাকে ওয়াশিংটনে অন্য একটি কূটনৈতিক পদে দায়িত্ব দেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন।
কিসিঞ্জারের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হাফপোস্টের এক দীর্ঘ প্রতিবেদনে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি এই ঘটনাও উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশে ‘রক্তস্নান’ চেয়েছিলেন কিসিঞ্জার
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার সমর্থক ছিলেন কিসিঞ্জার। প্রকাশিত মার্কিন দলিলেই আছে এর প্রমাণ। বাংলাদেশের দৈনিক সেবছর ৬ মার্চ প্রস্তুত করা এক দলিলে দেখা যায়, কিসিঞ্জার সুপরিকল্পিতভাবে ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য রক্তস্নান নীতির প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি এমনকি বলেছিলেন, ‘আমাকে শয়তানের পক্ষে ওকালতি (ডেভিলস অ্যাডভোকেট) করতে দাও।’
২০০১ সালে মার্কিন সাংবাদিক ক্রিস্টোফার হিচিন্স তার দ্য ট্রায়াল অব হেনরি কিসিঞ্জার বইয়ে একাত্তরের গণহত্যার জন্য কিসিঞ্জারের বিচার দাবি করেন।
এখন ওই মার্কিন দলিলই সাক্ষ্য দিচ্ছে যে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর সামরিক অভিযানকে নিরুৎসাহিত করাকে তিনি মার্কিন স্বার্থসংশ্লিষ্ট মনে করেননি। জেনারেল ইয়াহিয়ার সম্ভাব্য ‘রক্তস্নান’ নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে তিনি তার সহকর্মীদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট পরামর্শ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে উল্টো প্রশ্ন তুলেছিলেন যে ইয়াহিয়া রক্তস্নান নীতি গ্রহণ করলে যুক্তরাষ্ট্রকে কেন তার বিরোধিতা করতে হবে?