প্রধান খবরযুক্তরাষ্ট্র

বেকারত্ব বাড়ছে যুক্তরাষ্ট্রে

বেকারত্ব বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের সমস্যা। এ দেশের বহু তরুণ-তরুণী পছন্দমাফিক চাকরি পান না। শিক্ষাজীবন শেষ করে পুরোপুরি ঘরে বসে থাকা তরুণ-তরুণীর সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। বর্তমানে এই একই সমস্যায় ভুগছে বিশ্ব মোড়ল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও। আটলান্টিকের পারের দেশটিতে এমবিএ পাশ করা ছাত্রছাত্রীদের কাজ পেতে রীতিমতো কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে।

সম্প্রতি বেকারত্বের এমন এক ভয়াবহ সমস্যা নিয়ে একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় সংবাদসংস্থা ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’।

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হার্ভার্ড, স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়ার্টনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান থেকে ডিগ্রিপ্রাপ্তরাও কাজ পাচ্ছেন না। ফলে বেকারত্ব বৃদ্ধি পাওয়ায় পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।

‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, গত বছর হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের এমবিএ স্নাতকদের ২৩ শতাংশ পড়াশোনা শেষ করার তিন মাস পরেও চাকরি পাননি। ২০২২ সালে এই সংখ্যাটি ছিল ১০ শতাংশ। কিন্তু ২০২৩ সালে এক লাফে সেটি বেড়ে ২০ শতাংশে গিয়ে পৌঁছায়।

বিশ্বের বেকারত্ব নিয়ে একটি সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)।

আইএলও প্রকাশিত ‘গ্লোবাল এমপ্লয়মেন্ট ট্রেন্ডস ফর ইয়ুথ ২০২৪’ শীর্ষক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে সারা দুনিয়ার তরুণ শ্রমশক্তির ১৩ শতাংশ কোনো কাজ পাননি। অর্থাৎ বিশ্বজুড়ে মোট বেকার তরুণ তরুণীর সংখ্যা ছিল ৬.৪৯ কোটি।

২০২০ সালের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের রিপোর্টে আবার দাবি করা হয়, প্রতি চারজন পেশাদারের মধ্যে একজন চাকরি পাচ্ছেন। পরবর্তী পাঁচ বছরে সেই পরিস্থিতির যে খুব একটা বদল হয়েছে, এমন নয়।

বিষয়টি নিয়ে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর কাছে মুখ খুলেছেন হার্ভার্ড বিজনেস স্কুলের ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অ্যালামনি রিলেশনসের অধ্যক্ষ ক্রিস্টেন ফিটজপ্যাট্রিক।

ক্রিস্টেন বলেছেন, চাকরির বাজার যে দুর্দান্ত ভালো, তা একেবারেই বলা যাবে না। এখন আর সঠিক দক্ষতা থাকলেই কাজ পাওয়া যাচ্ছে, এমনটা নয়। কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে হার্ভার্ডের ছাত্র বা ছাত্রীদের আলাদা নজরে দেখার ব্যাপারে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে না অনেক নামিদামি সংস্থা।

হার্ভার্ডকে বাদ দিলে ওয়ার্টন এবং স্ট্যানফোর্ডের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা চাকরি না পাওয়া এমবিএ পড়ুয়ার সংখ্যা যথাক্রমে ২০ এবং ২২ শতাংশ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’। এছাড়া নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টার্ন স্কুল অব বিজনেসের স্নাতকদের মধ্যে প্লেসমেন্টের সংখ্যা ক্রমশ কমছে বলে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য খ্যাতনামা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পড়ুয়াদেরও চাকরি পাওয়া দিন দিন কঠিন হচ্ছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের বুথ স্কুল এবং নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কেলগ স্কুল অফ ম্যানেজমেন্টে বেকার স্নাতকদের সংখ্যা তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। স্নাতকের ডিগ্রি পাওয়ার তিন মাস পরেও চাকরি পাননি কেলগের ১৩ শতাংশ শিক্ষার্থী।

‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ জানিয়েছে, হঠাৎ করে কাজের বাজার খারাপ হওয়ায় দ্বিমুখী সমস্যায় ভুগছে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমত, এর জন্য ধীরে ধীরে আর্থিক মন্দার কবলে পড়ছে দেশ। দ্বিতীয়ত, যুব সমাজের একটি বড় অংশকে গ্রাস করছে মানসিক সমস্যা।

যুক্তরাষ্ট্র একজন এমবিএ স্নাতক চাকরি জীবনের শুরুতেই উচ্চ বেতন পেয়ে থাকেন। তাদের গড় প্রারম্ভিক বেতন ১.৭৫ লক্ষ ডলার বলে জানা গেছে। এমন লোভনীয় চাকরির বাজার খারাপ হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণের কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ। তাদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি সংস্থাগুলি কর্মী হ্রাস করছে। ফলে নামিদামি প্রতিষ্ঠানের এমবিএ স্নাতকেরা পাচ্ছেন না চাকরি।

২০২৩ সালে বিপুল সংখ্যায় কর্মী ছাঁটাই করে গুগল, মাইক্রোসফট, ম্যাককিনসে এবং বিসিজির মতো মার্কিন বহুজাতিক টেক জায়ান্ট সংস্থা। একই রাস্তায় হেঁটেছে ইকমার্স সংস্থা অ্যামাজনও। ২০২০ সালের করোনা মহামারিতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিকে বড় ধাক্কা দিয়েছিল। তারপর থেকেই কর্মী নিয়োগ নীতিতে পরিবর্তন আনে সেখানকার অধিকাংশ টেক জায়ান্ট সংস্থা।

কর্মী সঙ্কোচনের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স বা এআই) ব্যাপক ব্যবহারের কথা বলেছেন বিশ্লেষকদের একাংশ।

তাদের কথায়, টেক সংস্থাগুলো বর্তমানে আরও উন্নত কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরির দিকে নজর দিয়েছে। এআইকে কাজে লাগিয়েই সেরে ফেলছে যাবতীয় কাজ। ফলে ছোট হচ্ছে চাকরির বাজার।

এ বিষয়ে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর কাছে কর্মী নিয়োগ নীতি বদল নিয়ে মুখ খুলেছে যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকটি টেক জায়ান্ট সংস্থা। তারা জানিয়েছে, ভবিষ্যতে আর ক্যাম্পাস থেকে মিলবে না চাকরি। বিষয়টি নিয়ে কয়েক বছর আগে তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন মার্কিন ধনকুবের ইলন মাস্ক। ‘দক্ষতা গুরুত্বপূর্ণ, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি নয়,’ বলেছিলেন টেসলা-কর্তা।

বিশ্লেষকেরা জানিয়েছেন, বর্তমানে শুধুমাত্র ব্যবসায়িক জ্ঞান থাকা এমবিএ স্নাতকেরা আর কাজের বাজারে অগ্রাধিকার পাচ্ছেন না। বরং প্রযুক্তিগত দক্ষতা থাকলে তবেই মিলছে চাকরি। এর অর্থ হল, নিয়োগকারী সংস্থার কাছে ঐতিহ্যবাহী এমবিএ শিক্ষার্থীর কোনো মূল্য নেই। কাজের বাজারে দর বাড়াতে এর পাঠ্যসূচিতে ব্যাপক পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন তারা।

হার্ডার্ভ, স্ট্যানফোর্ড এবং ওয়ার্টনের মতো ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানের এমবিএ শিক্ষার্থীদের বড় অংশই ঋণ নিয়ে পড়তে আসেন। আর তাই ক্যারিয়ারের ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয় তাদের। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক পরিকল্পনা করতে পারেন না তারা। স্নাতক ডিগ্রি পাওয়ার পর বেকার থাকার নেপথ্যে একে অন্যতম বড় কারণ হিসাবে উল্লেখ করেছে ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’।

হার্ভার্ডের ক্রিস্টেন বলেছেন, এই পরিস্থিতি দ্রুত বদলে যাবে, এমনটা নয়। আমাদের বিকল্প রাস্তা খুঁজে বার করতে হবে। বর্তমানে একটি এআই টুল নিয়ে কাজ করছে আমেরিকার এই জনপ্রিয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এর সাহায্যে কোন শিক্ষার্থীর কোন ধরনের চাকরির জন্য আবেদন করা উচিত, তার সুপারিশ পাওয়া যাবে বলে জানিয়েছেন ক্রিস্টেন।

সংবাদ সংস্থা ফোর্বস জানিয়েছে, কম বেতনে কাজ পেতে এমবিএ স্নাতকদের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। যারা উচ্চ বেতনের প্রত্যাশা করছেন, তাদেরই ডিগ্রি পাওয়ার পর বেকার থাকতে হচ্ছে। তবে কাজের বাজারে দক্ষতা যে ডিগ্রিকে ছাপিয়ে গিয়েছে তা নিয়ে সহমত পোষণ করেছে ফোর্বস।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension