
বৈদেশিক ঋণের বোঝা
২০১১ সালে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণ-দেনার পরিমাণ ছিল ২৭ দশমিক শূন্য ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। মাত্র এক যুগের ব্যবধানে সেটি সাড়ে তিন গুণের বেশি বেড়ে ২০২৩ সালের মার্চে এসে দাঁড়িয়েছে ৯৫ দশমিক ৭১ বিলিয়ন ডলারে। এর মধ্যে সবশেষের মাত্র দুই বছরেই বেড়েছে ৩২ দশমিক শূন্য ৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (তথ্যসূত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক)।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে যেসব ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে, সেগুলোর আওতাধীন সমুদয় অর্থ ছাড় হলে এই দেনার পরিমাণ শিগগিরই আরও বহুলাংশে বেড়ে যাবে। তা ছাড়া শুধু বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি মোকাবিলার জন্য অতিসম্প্রতি যেসব উন্নয়ন প্রকল্পের অনুকূলে বৈদেশিক ঋণগ্রহণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, শেষ পর্যন্ত তা পাওয়া গেলে সেটিও উল্লিখিত ঋণ-দেনার পরিমাণকে উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়ে তুলবে। মোটকথা, বাংলাদেশের বর্তমান বৈদেশিক ঋণ-দেনার পরিমাণ ইতিমধ্যে এমন এক বিশাল আকৃতি ধারণ করেছে যে তা পরিশোধের প্রকৃত সামর্থ্য এ দেশের জনগণের আছে কি না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণগ্রহণের এ পরিমাণ হঠাৎ করেই এতটা বেড়ে গেল কেন? এর সবটাই কি যথাযথ প্রক্রিয়ায় যাচাই-বাছাই করে এসবের প্রয়োজন-অপ্রয়োজন তথা উপকার-অনুপকার নিরূপণ করে সেই অনুযায়ী গ্রহণ করা হয়েছে? এসব ঋণ যেসব প্রকল্প বা কর্মসূচির অনুকূলে গ্রহণ করা হয়েছে, সুদ-আসলে তা ফেরতদানের সামর্থ্য কি ওই সব প্রকল্প বা কর্মসূচির আছে? এসব ঋণগ্রহণের ক্ষেত্রে কি উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নেওয়া হয়েছে?
কিন্তু এসব ঋণের বিষয়ে সম্পাদিত চুক্তিগুলো কি রাষ্ট্রপতির কাছে পেশ করা হয়েছে কিংবা করা হয়ে থাকলে সেগুলো কি সংসদে উপস্থাপিত হয়েছিল? জাতীয় সংসদের অধিবেশন-কার্যক্রম যেহেতু অনেকটাই প্রকাশ্য, সেহেতু চর্মচক্ষুর অভিজ্ঞতা থেকে মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়, বৈদেশিক ঋণগ্রহণ নিয়ে সেখানে এ ধরনের কোনো আলোচনা কখনোই হয়নি। এর মানে হচ্ছে, বৈদেশিক ঋণগ্রহণ নিয়ে সব আমলেই সংবিধান লঙ্ঘিত হয়েছে ও হচ্ছে।
সৃষ্ট পরিস্থিতিতে অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন এবং ঋণগ্রহণ ও ঋণযুক্ত প্রকল্প অনুমোদনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও দপ্তরগুলো যদি বৈদেশিক ঋণের বিষয়টিতে যথার্থই কঠোর না হয়, তাহলে এ-সংক্রান্ত নিকট ভবিষ্যতের পরিস্থিতি খুবই ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।
অন্যদিকে, এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারত জাতীয় সংসদ। কিন্তু প্রায় একদলীয় জাতীয় সংসদে বিষয়টি কেউ আলোচনার জন্য উত্থাপন করবেন, এমন বাস্তবতা একেবারেই নেই। আর জাতীয় সংসদের বাইরে এ নিয়ে টুকটাক আলোচনা থাকলেও এ বিষয়ে জোরালো জনমত গড়ে তোলার মাধ্যমে সরকারকে সচেতন হতে বাধ্য করার মতো ব্যাপকভিত্তিক আলোচনারও ঘাটতি রয়েছে। অধ্যাপক মইনুল ইসলাম এ নিয়ে প্রায় একা আর কতটা লড়বেন? আসলে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ব্যতিরেকে এ ক্ষেত্রে আর কোনো চেষ্টাই তেমন কোনো কাজে আসবে বলে মনে হয় না।