মুক্তমত

ব্রিকস এবং পশ্চিমা দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের গুরুত্ব

মো. মাজেদুল হক


বাংলাদেশ সাম্প্রতিক সময়ে সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাপের মধ্যে থাকলেও বিশ্বনেতাদের কাছে এখন অন্যতম বিকাশমান অর্থনীতির দেশ হিসেবে সুপরিচিত। বিগত এক দশকে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি প্রশংসাজনক। কিছু সূচকে এগিয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে বের করে উন্নয়নশীল দেশের তালিকায় নাম ওঠানোর জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টার ফলে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল থেকে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেতে যাচ্ছে। এই অর্জন সহজেই আসেনি। এর পেছনে রয়েছে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। আর এই উন্নয়ন সম্ভব হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে। ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের সুবিধা পাওয়া গেছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, জোট থেকে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অনেক বাধা থাকে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনেক নিয়ম মেনে অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্য করতে হয়। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে কোনো দেশ একা একা কাজ করে বিশ্ব বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সফল হতে পারবে না। নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আনা একার পক্ষে সম্ভব নয়। এর জন্য প্রয়োজন জোট। বিশ্বে এখন জি-৭ ও জি-২০ জোট খুবই শক্তিশালী। এরা উন্নত দেশের জোট। এ দুটি জোটের কর্মপরিধি ব্যাপক। এখন অনেক দেশ জি-৭ ও জি-২০-এর বিকল্প জোট তৈরি করতে যাচ্ছে। অনেকে করেছেও। সেগুলোর কর্মপরিধি সামনের দিনে বাড়বে।

২০০৬ সালে চারটি দেশ নিয়ে ব্রিকের যাত্রা শুরু হয়। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন। পরে ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যোগদান করায় ব্রিকের নাম হয় ব্রিকস। ব্রিকস প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে সদস্য দেশগুলোর মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। ব্রিকস আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য নিয়ে আসবে। এর ফলে ত্বরান্বিত হবে অর্থনৈতিক উন্নয়ন। ব্রিকস জোট গঠনের প্রস্তাব রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন থেকে প্রথমে এলেও চীন যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। চীন ব্রিকসের সদস্য সংখ্যা বাড়াতে চায়। বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, চীন ব্রিকসকে জি-৭-এর বিকল্প শক্তিশালী জোট হিসেবে বানাতে চায়। অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেছেন, পশ্চিমা দেশগুলোর চলমান আধিপত্য হ্রাস করার লক্ষ্যে ব্রিকসের সদস্য দেশগুলোর মধ্যে চীনের ভূমিকা লক্ষণীয়। আবার ব্রিকসের অন্য সদস্য ভারতের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলোর সম্পর্ক গভীর। আবার চীন ও ভারতের মধ্যে মাঝে মাঝে কূটনৈতিক সম্পর্কের ফাটল ধরে দুই দেশের সীমান্তবর্তী স্থানগুলোকে কেন্দ্র করে।

বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের সিংহভাগ আসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে। আবার আমদানির ক্ষেত্রে এশিয়ার দেশগুলো তালিকায় আছে। বাংলাদেশের মোট আমদানির ৪০ শতাংশ আসে ব্রিকসভুক্ত দেশ ভারত ও চীন থেকে। ব্রাজিল থেকেও আমদানির পরিমাণ লক্ষণীয়। এ কারণে সব দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা বাঞ্ছনীয়।

চীন চাইছে ব্রিকসের সদস্যসংখ্যা বাড়ুক। রাশিয়াও চীনের সঙ্গে একমত পোষণ করে। ব্রিকসের সদস্য হওয়ার জন্য বাংলাদেশও ইতিমধ্যে প্রস্তাব পেয়েছে। প্রস্তাব এসেছে জেনেভায় দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনাসভা থেকে। এর পরই পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, বাংলাদেশ অতি শিগ্গির ব্রিকসে যোগদান করবে। ইতিমধ্যে ব্রিকসে যোগদানের জন্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইন্দোনেশিয়া প্রস্তাব পেয়েছে। আরো কিছু দেশ— ইরান, আর্জেন্টিনা, মিশর, বাহরাইন, সিরিয়া, পূর্ব আফ্রিকা থেকে দুটি দেশ, পশ্চিম আফ্রিকা থেকে একটি দেশ প্রস্তাব পেয়েছে।

ব্রিকস জোটে যোগদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশ এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। ব্রিকস জোটের আগামী আগস্ট মাসের সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হিসেবে অনুমোদন পেতে পারে। বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম উৎস হলো প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো থেকে যদি বাংলাদেশ রপ্তানি আয় বাড়াতে পারে, সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে পারে, তাহলে ব্রিকসে যোগদান করা যুক্তিসংগত। অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য বিদেশি বিনিয়োগ খুবই প্রয়োজন। এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ মোট দেশজ উৎপাদনের ১ শতাংশের নিচে। এই অনুপাত দিয়ে অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশের অর্থনীতি আমদানিনির্ভর। আমদানি ব্যয় মেটাতে মাঝেমধ্যে হিমশিম খেতে হয়। এর জন্য প্রয়োজন রপ্তানি আয় বাড়ানো। ব্রিকস জোটে যেসব দেশ সামনের দিনে যোগদানের সম্ভাবনা রয়েছে, সেই সব দেশে বাংলাদেশ পণ্য রপ্তানি বাড়াতে পারলে ব্রিকস অর্থপূর্ণ হবে। এক্ষেত্রে এখন থেকে বাংলাদেশকে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে।

যেখানে ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলোতে পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার ৪২ শতাংশ, সেখানে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য প্রবেশ করানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। বিশ্বে মোট বাণিজ্যের মধ্যে ব্রিকস জোটভুক্ত দেশগুলো অবদান রাখে ১৮ শতাংশ এবং জিডিপিতে অবদান রাখে ৩২ শতাংশ। আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ব্রিকস জোট বৈশ্বিক জিডিপিতে ৫০ শতাংশের বেশি অবদান রাখার প্রতিজ্ঞা করেছে। ব্রিকসের লক্ষ্যগুলো বিশ্লেষণ করলে বলা যায় যে, উন্নয়নশীল দেশগুলো এই জোটে যোগদান করলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। ২০২১ সালে ব্রিকস জোটে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হয় ৩ দশমিক ৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। অপর পক্ষে এই জোটের পাঁচ দেশ থেকে বাংলাদেশ আমদানি করে ৩৫৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য। এই মুহূর্তে বাণিজ্য বাংলাদেশের অনুক‚লে নয়। ভবিষ্যতে কী হবে জানি না। তবে ব্রিকস কিছু দেশকে নতুন করে সদস্য করলে বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশকেও ব্রিকসের সদস্য হতে হবে।

বাংলাদেশ যদি ব্রিকসের সদস্য হয়, তাহলে ব্রিকস জোটের উদ্যোগে ২০১৫ সালে সৃষ্টি করা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) ব্যাপকভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে। বাংলাদেশ এনডিবির সদস্য হয় ২০২১ সালে। এ সময় উরুগুয়ে ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সদস্য হয়। এনডিবির জন্ম হয়েছে অনেক উদ্দেশ্য নিয়ে। সারা পৃথিবীতে এনডিবি কাজ করবে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বিকল্প হিসেবে। এমনকি এনডিবি বিভিন্ন মুদ্রায় ঋণ প্রদান করবে, যেখানে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ ঋণ দেয় শুধু ডলারে। এনডিবির নতুন প্রধান ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট দিলমা রওসেফ বলেছেন, এনডিবি ৩০ শতাংশ ঋণ দেবে স্থানীয় মুদ্রায়। যেসব দেশে বৈদেশিক মুদ্রার মজুত দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, সেই সব দেশের জন্য এনডিবির বিভিন্ন মুদ্রায় দেওয়া ঋণ উপকারে আসবে। বর্তমানে ব্রিকসের পাঁচটি প্রতিষ্ঠাতা সদস্য দেশে এনডিবি ৯৬টি প্রকল্পে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার ঋণ প্রদান করেছে। বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত ও স্মার্ট দেশ হিসেবে দেখতে চায়। এর জন্য প্রয়োজন অবকাঠামোগত উন্নয়ন। কর-জিডিপি অনুপাতের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ যেহেতু পিছিয়ে আছে, অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে করতে হবে। দশকের পর দশক বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ বাংলাদেশকে ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করছে, এখনও দিচ্ছে। কয়েক মাস আগে আইএমএফ ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ বাংলাদেশের জন্য অনুমোদন করেছে। আশা করা যাচ্ছে, এনডিবি বাংলাদেশকে সহজ শর্তে ঋণ দেবে এবং সুদের হার তুলনামূলক কম হবে। বিশ্বব্যাংকও সহজ শর্তে ঋণ দেয়, কিন্তু সুদের হার বেশি।

বাংলাদেশ সার্ক, ডি-৮, বিমসটেক জোটগুলোর সদস্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এই জোটগুলোর কার্যক্রম প্রশংসাযোগ্য নয়। সার্কের কার্যক্রম এখন পুরোপুরি স্থবির। আশা রাখি, বাংলাদেশ ব্রিকস জোটের সদস্য হলে অনেক ক্ষেত্রে উপকৃত হবে। বাংলাদেশে এখন ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা হয়েছে, যা ব্রিকসের সদস্য দেশগুলো বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যথেষ্ট উপকৃত হবে। তখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের কার্যক্রম হবে প্রশংসনীয়। বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশ ব্রিকসের সদস্য হওয়ার পর যাতে পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্কের ফাটল না ধরে। ব্রিকস জোটের দেশ চীন ও ভারত যে শূন্য শুল্কের সুবিধা অব্যাহত রাখবে, এই নিশ্চয়তা এখনো পায়নি। অথচ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশে বাংলাদেশ এখনো শুল্কমুক্ত সুবিধায় রপ্তানি পণ্য পাঠাচ্ছে। ব্রিকস জোট থেকে যদি সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ আসে এবং নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক থেকে সহজ শর্তে ঋণসুবিধা পাওয়া যায়, তাহলে বলব, ব্রিকস জোটে যোগদান করা হবে বাংলাদেশের জন্য সময়োপোযোগী সিদ্ধান্ত।

লেখক: অর্থনীতি বিশ্লেষক

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension