একুশেমুক্তমত

মহান একুশে ফেব্রুয়ারি: পেছন ফিরে দেখা

শাহ্‌ জে. চৌধুরী


দুশ’ বছর নিজেদের শাসন চালাবার পর ব্রিটিশরা যখন ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল তখন ভারতবর্ষকে ভেঙে দু টুকরো করা হলো। আসলে করা হলো তিন টুকরো। তৃতীয়টি তখন দৃশ্যমান নয়। কেননা উত্তেজনা তখন দ্বিজাতি তত্ত্ব নিয়ে। এই দুই জাতির এক জাতি হলে হিন্দু ও মুসলমান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষেরা। যদিও সেই মধ্যযুগেই কবি বড়ু চণ্ডীদাস বলেছিলেন, ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। আর সে কবিতা পড়েন নি- সেই তখন থেকে এখন পর্যন্ত এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবু সেই ১৯৪৭-এ মানুষকে ছাপিয়ে সবার উপরে ধর্মই বড় হয়ে গেল। একটি দেশকে ভেঙে দুটা দেশ বানিয়ে দেওয়া হলো- ভারত ও পাকিস্তান।

মানচিত্রকে কেটে দু ভাগ করে পাকিস্তান নামে দেশটা বানাবার তাড়াটি দিয়েছিলেন মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্‌। এবং পাকিস্তানের পক্ষে জনমত তৈরি করতে জিন্নাহর প্রধান অস্ত্রটির নাম ধর্ম। জিন্নাহ একটি অসম্ভব ও অবাস্তব দাবি তুললেন। বললেন, মুসলমানদের জন্যে আলাদা রাষ্ট্র চাই। একটি দেশে কেবলমাত্র একটি নির্দিষ্ট ধর্মের মানুষই বাস করবে- এই ভাবনাটি একটি অস্বাভাবিক ভাবনা। কিন্তু রাজনীতি তো সকল যুগেই সংকীর্ণ, ফলে সেসময় জিন্নাহর এই মতবাদকে সমর্থন করবার লোকের অভাব দেখা গেল না। তার ওপর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষের লোকেরা গায়ের জোরও দেখিয়ে দেওয়ার হুমকি দিতে লাগল, ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’। মানে হলো, যদি পাকিস্তান না দাও তবে লড়াই বাধবে। লড়াই বেধেও ছিল- সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা। এই দাঙ্গা হয়ত গৃহযুদ্ধের রূপ নিত যদি না পাকিস্তান করে দেওয়া হতো।

সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক রক্তারক্তি হলো। অবশেষে আলোচনার টেবিলে বসা হলো মানচিত্র নিয়ে। মানচিত্রে দাগ কেটে পাকিস্তানের সীমারেখা আঁকা হবে। আরব সাগর দক্ষিণ দিক আর ওমান উপসাগরীয় উপকূল ঘেঁষে পূবে রাখা হলো ভারত। উত্তর-পশ্চিমে থাকল আফগানিস্তান, তাজিকিস্তান। হয়ে গেল পাকিস্তান। তখন জিন্নাহ বললেন, তাঁর পূর্ব বাংলাকেও চাই কেননা পূর্ব বাংলা মানুষ মুসলমান। আলোচনার টেবিলের সকলে স্তম্ভিত। এই লোক বলে কি! প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষা আর সংস্কৃতির জাতিসত্তাকে মিলিয়ে এই লোক পাকিস্তান রাষ্ট্র বানাবে! কিন্তু উপায় ছিল না। নইলে ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ হুমকিতে আরও রক্তারক্তি ঘটবে। আর এদিকে পূর্ব বাংলার লোকেরাও দেখা গেল মুসলমান রাষ্ট্রের পক্ষে থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে চাইছে। এখানেও কম রক্তারক্তি হয় নি।

এরপর পূর্ব বাংলা হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। পূর্ব তো পূর্ব হয়েই থাকল। শুধু বাংলা থেকে পাকিস্তান হওয়ার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজের জন্মস্থান, পৈত্রিক ভিটেমাটি ছেড়ে পাড়ি জমালো পাশের দেশে- এদেশের হিন্দুরা পালাতে লাগল ভারতে আর ভারতের মুসলমানেরা পালিয়ে আসতে লাগল দুই পাকিস্তানে। পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হলো, মারা পড়ল শত শত মানুষ।

প্রতিষ্ঠিত হলো পাকিস্তান। এবং পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর দেখা গেল কবি চণ্ডীদাসই সঠিক আসলে- ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’। প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বের দু ভূখণ্ড নিয়ে রাষ্ট্র গঠিত হলেও ভিন্ন ভাষা ও সংস্কৃতির জাতিসত্তা আসলে তেল আর জলের মতো, মিশছে না মোটেও। ১৯৪৭ সালে দৈনিক আজাদী পত্রিকায় উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করবার পক্ষে
সে বছরই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করলেন। পাকিস্তানের প্রথম মুদ্রা, ডাকটিকেট, ট্রেনের টিকেট, পোস্টকার্ড ইত্যাদি থেকে বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দু ও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়। শুরু হলো বিতর্ক হলো। বাঙালীরা তখন নিজের ভাষা ও সংস্কতির কথা ভাবতে লাগল, বলতে লাগল। ঢাকায় ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভ করলেন।

১৯৪৮ সালের মার্চ পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে রেসকোর্স ময়দানে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এক সমাবেশে স্পষ্ট ঘোষণা করেছিলেন যে ‘উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা’।

জিন্নাহর ঘোষণাকে অনেকেই নতুন রাষ্ট্র সম্পর্কে বাঙালীর স্বপ্নভঙ্গের সূচনা বল মনে করেন। কিন্তু জিন্নাহ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে শুরু থেকে অনমনীয় মনোভাব প্রকাশ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ মারা যান। কিন্তু জিন্নাহর মৃত্যুর পরেও রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নানা রকম প্রস্তাব, পাল্টা প্রস্তাব চলতে থাকে। ১৯৫২ সালের শুরু পর্যন্ত বাঙালীরা জোরালোভাবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু সম্পর্কে তাদের বিরুদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত করে গেছেন। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় সফরে এসে খাজা নাজিমুদ্দিন পল্টনে এক সমাবেশে জিন্নাহর কথাই পুনরাবৃত্তি করেন। সেসময়ও প্রতিবাদে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান ওঠে। বাংলাভাষার সম-মর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে ঢাকা শহরে মিছিল, সমাবেশ ইত্যাদি বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, সেদিন ছিল ১৩৫৮ বঙ্গাব্দের ৮ ফাল্গুন। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল করে। মিছিলটি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছাকাছি এলে পুলিশ ১৪৪ ধারা অবমাননার অজুহাতে মিছিলে গুলি চালায়। গুলিতে মারা যান বাদামতলী কমার্শিয়াল প্রেসের মালিকের ছেলে রফিক, সালাম, এম. এ. ক্লাসের ছাত্র বরকত ও আব্দুল জব্বারসহ অনেকে। এছাড়া ১৭ জন ছাত্র-যুবক আহত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশে বিদ্রোহের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে ওঠে। ২২ ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র, শ্রমিক, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও সাধারণ জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে পূর্ণ দিবস হরতাল ও সভা-শোভাযাত্রাসহ পালন করে। ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে শহীদ হন শফিউর রহমান শফিক, রিক্সাচালক আউয়াল এবং অলিউল্লাহ নামক এক কিশোর। ভাষা আন্দোলনের শহীদ স্মৃতিকে অম্লান করে রাখার জন্য মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে রাতারাতি ছাত্ররা গড়ে তোলে শহীদ মিনার। এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়।

সবশেষে বলতে চাই, যে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো, সে বাংলাদেশে আমরা বাংলা ভাষাভাষী মানুষেরা কোন্‌ অবস্থান দিয়ে রেখেছি এখন?

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension