
সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ২১ হাজার ৭৩২ টাকা বাড়লেও ধনী-দরিদ্রের বৈষম্যের গঁ্যাড়াকলে সমাজে এর উল্টো প্রভাব পড়েছে। তাই নিম্নবিত্তের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক মধ্যবিত্ত মানুষকেও এখন টিসিবির লাইনে দাঁড়াতে দেখা যাচ্ছে।
সংসার সামাল দিতে গিয়ে অনেককে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ পরিবারের বিভিন্ন বাজেট কাটছাঁট করতে হচ্ছে। অথচ একই সময় ধনীদের সম্পদ উচ্চহারে বেড়েছে। উচ্চ বৈষম্যের এ পরিস্থিতিতে টেকসই উন্নয়ন অসম্ভব বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন। এদিকে বাংলাদেশের মানুষের গড় মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান নিয়ে বরাবরের মতো এবারও বিতর্কের ঝড় উঠেছে। মাথাপিছু আয়ের পরিসংখ্যান তৈরিতে পদ্ধতিগত ত্রম্নটি রয়েছে বলেও অর্থনীতিবিদরা অনেকে অভিযোগ করেছেন। কেউ কেউ সরকারি পরিসংখ্যানের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, এক বছরে জাতীয় আয় যা আসে, সেটাকে অন্যতম ভিত্তি হিসেবে নিয়ে মাথাপিছু আয় বের করা হয়। সেজন্য পরিসংখ্যান তৈরির পদ্ধতিতে গলদ থেকে যাচ্ছে। মাথাপিছু আয় ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির যে প্রাক্কলন করা হয়েছে, তা প্রাসঙ্গিক তথ্য দিয়ে সমর্থিত নয় বলেও অর্থনীতিবিদরা দাবি করেছেন।
যদিও পরিকল্পনামন্ত্রী তা অযৌক্তিক বলে উড়িয়ে দিয়েছেন। সরকারের পরিকল্পনাবিদদের দাবি, কোনো দেশে যখন দ্রম্নত উন্নয়ন ঘটে, তখন স্বাভাবিকভাবেই বৈষম্য বাড়ে। সরকার বৈষম্য কমাতে দরিদ্রদের জন্য নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। তাই এ নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। তবে বাস্তবতা হলো, দেশজুড়ে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করতে এবং আয়বৈষম্য কমাতে সরকার নানা উদ্যোগ নিলেও এর সুফল অধরাই রয়ে গেছে।
অন্যদিকে করোনাকালীন এবং করোনাপরবর্তী সময়ে আয় কমে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের যখন নাভিশ্বাস উঠেছে, এ সময় সরকারি পরিসংখ্যানে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির তথ্য প্রকাশে বিভিন্ন মহলে চাপা ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ফেসবুক-ইউটিউব ও টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের বার্ষিক এই গড় আয়ের হিসাবের মধ্যে শত শত কোটি অবৈধ টাকার মালিক, বৈধ কোটি কোটি টাকার মালিক, চাকরিজীবী মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এবং অতিদরিদ্র মানুষ রয়েছেন। দেশের মোট জনসংখ্যার \হসঙ্গে আয়ের গড় ধরেই মাথাপিছু আয়ের হিসাব বের করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা নিয়েও মতানৈক্য রয়েছে।
উন্নয়ন সহযোগীসহ সবাই বলছেন দেশের জনসংখ্যা ১৮ কোটির বেশি, সেখানে বিবিএস বলছে সাড়ে ১৬ কোটি। জনসংখ্যা কম দেখানোর কারণে গড় মাথাপিছু আয় বেশি দেখা গেছে। জনসংখ্যার মূল হিসাবের গরমিল থাকার কারণে অন্য সব বাজেট ব্যবস্থাপনা, কৌশল প্রণয়ন ও অর্থনৈতিক হিসাবেও গরমিল দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ কারণর বিভ্রান্তিকর পরিসংখ্যান দিয়ে জাতীয় আয় বেড়ে গেলেও কখনো টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয় বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাদের ভাষ্য, সাধারণ মানুষের আয় বেড়েছে, নাকি কমেছে তা বোঝার জন্য কারো অর্থনীতিবিদ হওয়ার প্রয়োজন নেই। বাজারে জিনিসের মাত্রা ছাড়া মূল্য বৃদ্ধি, বাড়ি ভাড়া, তেল, গ্যাস, পানির দাম বেড়ে যাওয়ার হিসাব এবং মাস শেষে ফাঁকা ম্যানিব্যাগ দেখলেই যে কেউ তার নিজের বর্তমান অবস্থা বুঝতে পারছে। নিম্ন-মধ্যবিত্তরা এভাবেই তাদের হিসাব মিলাচ্ছে। তাই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির সরকারি পরিসংখ্যান নিয়ে এত বিতর্কের সৃষ্টি হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ডক্টর ফাহমিদা খাতুন বলেন, যেহেতু ধনী এবং নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে বৈষম্য বা ফারাক অনেক বেড়েছে। ফলে এখন যে মাথাপিছু আয় দেখানো হচ্ছে তা নিয়ে বিতর্ক থাকাটা স্বাভাবিক। তিনি মনে করেন, এই পরিসংখ্যানে দেশের মানুষের আয়ের প্রকৃত চিত্র পাওয়া যায় না। এর পেছনে যুক্তি দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশে দ্রম্নত ধনী এবং অতি ধনী হওয়ার সংখ্যা বেড়েই চলেছে। কিন্তু গরিব মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। একইসঙ্গে সমাজে বৈষম্য এবং মানুষের আয়ের ফারাক অনেক বেশি হচ্ছে। অথচ এই পরিস্থিতির প্রতিফলন সরকারি পরিসংখ্যানে বা হিসাবে আসছে না। সেজন্য তা মানুষের কাছে গুরুত্ব পাচ্ছে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। অর্থনীতিবিদরা বিভিন্ন সময়ে আলোচনায় বলেছেন, স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশে বৈষম্য বাড়লেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই বৈষম্য মাত্রা ছাড়া হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশেই ২০২০ সালে এত বেশি অতি ধনী মানুষের আবির্ভাব ঘটেছে, যা বিশ্বের আর কোনো দেশে ঘটে নি। এদিকে বিশ্বের অন্যান্য দেশে ধনী মানুষ বাড়লে তাদের বিনিয়োগে কলকারখানা গড়ে ওঠায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের কর্মসংস্থান হলেও বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্র দেখা গেছে। কেননা এ দেশের ধনী মানুষের মোট অর্থের একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। তারা কানাডাসহ বিভিন্ন উন্নত দেশে ফ্ল্যাট-বাড়ি-গাড়ি কেনার পাশাপাশি সেখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে মোটা অংকের পুঁজি বিনিয়োগ করছেন। ফলে দেশে ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য প্রতিবছর লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)-এর সাবেক গবেষণা পরিচালক অর্থনীতিবিদ ডক্টর এম আসাদুজ্জামান যায়যায়দিনকে বলেন, মাথাপিছু আয় বেড়েছে বলে দু’দিন আগে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে, তা সাম্প্রতিক সময়ের তুলনামূলক বিশ্লেষণ, যখন করোনা অনেকখানি কমে গেছে। তবে করোনাকালীন সময় কৃষি ও গার্মেন্টসহ অন্যান্য শিল্পখাতে তেমন বেশি ক্ষতি না হলেও সেবাখাতে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই সেবা খাতে সংশ্লিষ্টদের আয় কমেছে। কিন্তু সেবাখাতের আয় কমার বিষয়টি নিরূপণ জটিল হওয়ায় তা স্বাভাবিকভাবে বোঝা কঠিন। তাই এ বিষয়টি অনেকের কাছেই অস্পষ্ট।
ডক্টর আসাদুজ্জামান আরও বলেন, ধনী-দরিদ্রের চরম বৈষম্যের কারণে মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। কেননা মুষ্ঠিমেয় ধনী ব্যক্তির আয় বাড়লেও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় কমেছে। অথচ মাথাপিছু আয় নির্ধারণে তাদের গড় আয় হিসাব করা হয়েছে। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির বিষয়টি স্রেফ কাগুজে হিসাব দাবি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষক, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আবু আহমেদ যায়যায়দিনকে বলেন, কর্মসংস্থান না বাড়লে আয় বাড়ার কোনো সুযোগ নেই। করোনাপরবর্তী সময়েও দেশে সেভাবে কর্মসংস্থান বাড়েনি। তাই মাথাপিছু আয় বাড়ার প্রশ্ন ওঠে না। সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধিও বেশি দেখাচ্ছে দাবি করে এই অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, প্রাইভেট সেক্টরই বেশি কর্মসংস্থান করছে; এ ব্যাপারে সরকার ততটা তৎপর হয় নি। তবে বর্তমানে ব্যক্তিগত বিনিয়োগই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং কর্মসংস্থান বাড়ার যেমন সুযোগ নেই, তেমনি মাথাপিছু আয় বাড়ার পথেও প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান বু্যরোর (বিবিএস) ২০১৬ সালের তথ্য অনুযায়ী, দেশে দারিদ্র্যের হার ছিল ২৪.৩০ শতাংশ। তবে করোনা পরিস্থিতিতে সেই হিসাব আমূল বদলে গেছে। গত নভেম্বরে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) এবং ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) যৌথ গবেষণা বলছে, করোনার কারণে দেশে নতুন করে ২২.৯ শতাংশ মানুষ গরিব হয়েছে। নতুন ও পুরানো মিলিয়ে জনসংখ্যার ৪৩ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে। গরিব মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত কোটির বেশি।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলেছে, দেশে দারিদ্র্যহার ৩৫ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে পাঁচ কোটি ৭৭ লাখের বেশি। একইভাবে সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, দারিদ্র্যের হার দ্বিগুণ বেড়ে ৪২ শতাংশ হয়েছে।
বিআইজিডি ও পিপিআরসির সর্বশেষ জরিপ বলছে, দেশে করোনাকালে তিন কোটি ২৪ লাখ মানুষ নতুন করে দরিদ্র হয়েছে। চলতি বছরের মার্চে নতুন দরিদ্রের সংখ্যা ছিল দুই কোটি ৪৫ লাখ। অর্থাৎ গত ছয় মাসে ৭৯ লাখ মানুষ দরিদ্র হয়েছে। জরিপে দেখা যায়, মানুষের খাদ্যে ব্যয় কোভিডকালের তুলনায় কমে গেছে। বাড়তি এসব ব্যয় মেটাতে শহরের দরিদ্র ও গ্রামের মানুষকে ধারদেনা করতে হয়েছে। গ্রামে এই হার ৬২ শতাংশ, শহরে ৬০ শতাংশ।
এদিকে করোনার মধ্যেও কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ব্যাপক হারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, বর্তমানে কোটিপতির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে এক লাখ ২৩৯ জনে। ২০২১ সালের জুন শেষে কোটিপতি আমানতকারীর সংখ্যা ছিল ৯৯ হাজার ৯১৮ জন। অর্থাৎ তিন মাসে ব্যাংক ব্যবস্থায় নতুন কোটিপতির সংখ্যা বেড়েছে ৩২১ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈষম্যের কারণে কাঙ্ক্ষিত হারে দেশের দারিদ্র্য কমছে না। এই বৈষম্য যেমন আয়ের ক্ষেত্রে, তেমনি রয়েছে জীবন ধারণের নানা বিষয়ের ক্ষেত্রেও।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, শোভন কর্মসংস্থান তৈরি না হওয়ায় আয় বৈষম্য বেড়েছে। ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের গতি কমাটাও স্বাভাবিক। এদিকে ‘দ্রম্নত সম্পদ বাড়ছে ধনীর, হারাচ্ছে গরিব’ শিরোনামের প্রতিবেদনে বিবিএস-এর হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভের (এইচআইইএস) চূড়ান্ত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দেশের সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদের পরিমাণ বিগত ছয় বছরের ব্যবধানে দুই-তৃতীয়াংশ কমেছে।
এই সময়ে সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মানুষের সম্পদ বেড়েছে ২ শতাংশেরও বেশি। দেশে আয় বেষম্য নিরসন নিয়ে সম্প্রতি এক সেমিনারে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ডক্টর মইনুল ইসলাম মন্তব্য করেন, দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। তার মতে, ব্যাংক ঋণের লুণ্ঠিত অর্থের সিংহভাগ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। আর একটি বড় অংশ পাচার প্রক্রিয়ায় দেশের অর্থনীতিতে প্রবেশ করছে। এসব কারণেই আয় বৈষম্য বেড়ে বিপজ্জনক স্তরে পৌঁছে গেছে।