মিয়ানমারে যুদ্ধের তীব্রতায় বেড়েছে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মংডু শহরকে কেন্দ্র করে দেশটির সেনাবাহিনী ও বিদ্রোহী আরাকান আর্মির মধ্যে তীব্র লড়াইয়ের মধ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের অনেকেই দালালদের মাধ্যমে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করছেন বা চেষ্টায় আছেন বলে কক্সবাজারের জনপ্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
৩ সেপ্টেম্বর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন করে আট হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কথা জানানো হলেও জনপ্রতিনিদের ধারণা, প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি। এ ছাড়া হাজার হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টায় আছেন বলেও তারা খবর পাচ্ছেন।
উখিয়া ও টেকনাফের স্থল ও নৌ পথে সীমান্তের অন্তত ৩০টি পয়েন্ট দিয়ে এসব রোহিঙ্গার অনুপ্রবেশ ঘটছে।
তবে এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন ও বিজিবি বলছে, সীমান্তের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে। অনুপ্রবেশের চেষ্টাকারীদের ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, “অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের একটি অংশ ক্যাম্পে প্রবেশ করলেও অনেকেই উখিয়া-টেকনাফের বিভিন্ন বাসা ভাড়া নিয়ে অবস্থান নিচ্ছে। বাংলাদেশে ঢুকে পড়ার জন্য রাখাইন রাজ্যের বিভিন্ন পয়েন্টে লাখের কাছাকাছি রোহিঙ্গা জড়ো হয়ে রয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে সব চেয়ে বেশি রোহিঙ্গা জড়ো রয়েছে হোয়াইক্যং সীমান্তের ওপারের মিয়ানমারের প্যারাংপুরু নামের এলাকায়।”
টেকনাফের রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা ১৬ আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী পুলিশ সুপার মাইন উদ্দিন বলেন, “কিছুসংখ্যক রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ঢুকে পড়েছে। ক্যাম্পে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।”
মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গা এবং সেখানে থাকা তাদের স্বজনদের বরাতে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, মংডু শহরের নিয়ন্ত্রণ নিতে তীব্র সংঘাত চালিয়ে যাচ্ছে আরাকান আর্মি। একই সঙ্গে সরকারের সেনাবাহিনী শহরটি ধরে রাখতে প্রতিরোধ অব্যাহত রেখেছে।
এর জেরে এক সপ্তাহ ধরে আকাশ পথে বিমান হামলা চালানো হচ্ছে। তীব্র লড়াইয়ের কারণে বিস্ফোরণের বিকট শব্দে কাঁপছে টেকনাফের সীমান্ত এলাকা। এতে টেকনাফের সীমান্তবর্তী এলাকার মানুষ ঘুমহীন আতঙ্কের মধ্যে রয়েছে।
এর মধ্যে শনিবার রাত থেকে রোববার সকাল পর্যন্ত বিকট বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে উঠে টেকনাফ সীমান্ত।
সাবরাং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুর হোসেন বলেন, “শুক্রবার রাত দেড়টা থেকে শুরু হয় এই বিকট বিস্ফোরণের শব্দ। মংডু শহরে সরকারি বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের তুমুল যুদ্ধ চলছে। ওই শহরে বিজিপি ও সেনাবাহিনীর দুটি ব্যাটালিয়ান দখলে দেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বিদ্রোহী আরকান আর্মি সদস্যরা। ব্যাটালিয়ান দুইটি রক্ষা করতে বিজিপি ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা মর্টারশেল ও মিসাইল হামলা চালাচ্ছে। এসবের বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ।”
টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আমিন জানিয়েছেন, “আকাশে বিমানের চক্কর, মর্টারশেল ও শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমার বিস্ফোরণে এপারের ঘরবাড়ি কাঁপছে। এতে ঘুমহীন রাত এবং আতঙ্কের মধ্যে আছে সাধারণ মানুষ। টিকতে না পেরে রোহিঙ্গারা এদিকে আসছেন।”
সীমান্তের বাসিন্দা ও জনপ্রতিনিধিদের দেওয়া তথ্য বলছে, অগাস্ট মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত টেকনাফের জাদিমোরা (এ এলাকা দিয়েই বেশি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঘটেছে), দমদমিয়া, কেরুনতলি, বরইতলি, নাইট্যংপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাজিরপাড়া, মৌলভীপাড়া, নয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ, জালিয়াপাড়া, মিস্ত্রিপাড়া, ঘোলারচর, খুরেরমুখ, আলীর ডেইল, মহেষখালীয়াপাড়া, লম্বরী, তুলাতলি, রাজারছড়া, বাহারছড়া উপকূল, উখিয়ার বালুখালী, ঘুমধুম সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ হচ্ছে।
মংডুর উত্তরের প্যারাংপুরু ও দক্ষিণের ফাদংচা এলাকায় জড়ো থাকা রোহিঙ্গারা দালালদের সহায়তায় অনু্প্রেবেশের চেষ্টা রেখেছে।
শুক্রবার ভোরে টেকনাফের একটি সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার। তারা একটা পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছিলেন ক্যাম্পে প্রবেশের জন্য।
তাদের সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, মংডু শহরের দলিয়াপাড়া ও সুদাপাড়া এলাকা এখন রোহিঙ্গা শূন্য। সেখানে উভয় পক্ষ শক্তিশালী গ্রেনেড-বোমা, মর্টারশেলের পাশাপাশি ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। যুদ্ধবিমান থেকেও বোমা নিক্ষেপ করা হচ্ছে। তাতে অনেক মানুষ হতাহত হচ্ছেন। প্রাণরক্ষায় যে যে দিকে পারছেন পালাচ্ছেন।
রোহিঙ্গারা দাবি করেছেন, তারা দালালদের জনপ্রতি ২০ হাজার টাকা দিয়েছেন।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তানভীর হোসেন বলেন, “সম্প্রতি রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের খবর এসেছে। নতুন করে কয়েকটি রোহিঙ্গা পরিবার বিভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অবগত রয়েছে।”
এ ছাড়া রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তে বিজিবি সদস্যরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছে বলে জানান তিনি।
টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আদনান চৌধুরী বলেন, “সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের ঘটনা ঘটছে। অনুপ্রবেশের সময় বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গাকে নাফ নদী থেকে পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে নাফ নদী ও সীমান্তে টহল জোরদার করা হয়েছে।”
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেন, “৫ অগাস্টের আগে-পরে বাংলাদেশের সরকার পতন পরিস্থিতিতে আট হাজারের মত রোহিঙ্গা অনুপ্রেবশ করেছে। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বলেছে। এর পরেও কিছু রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের তথ্য পাওয়া গেলেও তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।”
বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মহিউদ্দীন আহমেদ জানিয়েছেন, “সীমান্তে বিজিবি কঠোর এবং সর্তক অবস্থানে রয়েছে। যারা অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছে তাদের প্রতিহত করে ফিরে দেওয়া হচ্ছে।
অনুপ্রবেশের সুনিদিষ্ট কোনো তথ্য বিজিবির কাছে নেই বলে জানান তিনি।