
মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য ১৫ মিনিট সময় দেয়া হয় কারামিকে
২২ বছর বয়সী কারাতে চ্যাম্পিয়ন মোহাম্মদ মেহদি কারামিকে মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য মাত্র ১৫ মিনিট সময় দেয়া হয়েছিল। এ বিষয়ে জানেন এমন সূত্রগুলো বিবিসিকে এসব তথ্য দিয়েছেন। মাহশা আমিনি নামের যুবতীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ বিক্ষোভের কারণে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের মাত্র ৬৫ দিন পরে ৭ই জানুয়ারি কারামিকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপগুলো বলেছে, লজ্জাজনক ও ভয়াবহভাবে ত্রুটিপূর্ণ বিচারে অভিযুক্ত করা হয়েছে তাকে। উল্লেখ্য, ওই প্রতিবাদ বিক্ষোভের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ইরানে এ পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে চার যুবকের। আরও ১৮ জনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেয়া হয়েছে। এসব রায়কে ত্রুটিপূর্ণ বলে অভিহিত করা হয়। একই বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন মেহদি কারামি।
বিবিসি লিখেছে, প্রতিবাদকারীদের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করতে এসব বিচারকে কিভাবে ব্যবহার করছে ইরান, কারামির কাহিনী তাই তুলে ধরে। এসব প্রতিবাদকারীর দাবি স্বাধীনতা এবং ধর্মীয় শাসকগোষ্ঠী থেকে মুক্তি।
মাহশা আমিনিকে ইরানের নৈতিকতা বিষয়ক পুলিশ হেডস্কার্ফ যথাযথভাবে না পরার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে গত বছর সেপ্টেম্বরে।
কয়েকদিন পরে তিনি পুলিশি হেফাজতে মারা যান। অভিযোগ উঠেছে, তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদে ফুঁসে ওঠে পুরো দেশ। নিন্দা জানায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও মানবাধিকার কর্মীরা। কিন্তু দেশের ভিতরে প্রতিবাদ বিক্ষোভকে ‘দাঙ্গা আখ্যায়িত’ করে তা উড়িয়ে দেয় কর্তৃপক্ষ। তারা সহিংস দমনপীড়ন শুরু করে। নওরয়েভিত্তিক বেসরকারি সংগঠন ইরান হিউম্যান রাইটসের মতে, এ পর্যন্ত নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা হত্যা করেছে কমপক্ষে ৪৮১ জনকে।
৩রা নভেম্বর রাজধানী তেহরানের পশ্চিমে কারাজ শহরে প্রতিবাদ বিক্ষোভ চলছিল। এদিন সেখানে আধাসামরিক বাহিনী বাসিজ ফোর্সের একজন সদস্যকে হত্যা করা হয়। এর সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয় মেহদি কারামিকে। পরে তার বিরুদ্ধে ‘করাপশন অন আর্থ’ অপরাধের অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। ওদিকে কারাজে রেভ্যুলুশনারি কোর্ট ৩০শে নভেম্বর তিনটি শিশুসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে এই হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ আনে।
ইরানে বিবাদীকে আইনি সহায়তা দেয়া হয়। কিন্তু এই ঘটনা ও গুপ্তচরবৃত্তির মতো মামলায় তাদের নিজেদের পছন্দমতো আইনজীবী অনুমোদন করা হয় না। পক্ষান্তরে বিচারবিভাগ অনুমোদিত তালিকার একজন আইনজীবীকে নিয়োগ দেয় আদালত।
আদালতে বিবাদীর পরিবারের সদস্য এবং সাংবাদিকদের উপস্থিত হতে দেয়া হয় না। ফলে রুদ্ধদ্বার বিচারে যা হয় তারা এডিট করা ফুটেজ বিচারবিভাগ প্রকাশ করে। এমনই একটি ভিডিওতে কারামিকে দৃশ্যত হতাশ দেখা যায়। তিনি ‘স্বীকার’ করেন বাসিজ সদস্যকে পাথর দিয়ে আঘাত করার অভিযোগ। কিন্তু আদালত মেহদি কারামির পক্ষে যে আইনজীবী নিয়োগ দিয়েছিল, তিনি এই যুক্তি চ্যালেঞ্জও করেননি, আপত্তিও করেননি। পক্ষান্তরে তিনি বিচারকের কাছে ক্ষমা করে দেয়ার প্রার্থনা জানান।
কারামি তখন নিজে বোকা হয়ে যান এবং বসে পড়েন। কারামিকে ৫ই ডিসেম্বর অভিযুক্ত করে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। তার সঙ্গে অন্য চার বিবাদীকেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। শিশুসহ অন্য আটজনকে কঠোর জেল দেয়া হয়। সাধারণত বিবাদীর পরিবারের সদস্যদেরকে কর্তৃপক্ষ নীরব থাকার জন্য চাপ দিয়ে থাকে। তা সত্ত্বেও কারামির পিতা মাশালাহ কারামি একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন ইতেমাদ পত্রিকাকে। মাশালাহ কারামি রাস্তায় প্যাকেটজাত টিস্যু ফেরি করে বিক্রি করেন। তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। বলেন, ওইদিন কান্নায় ভেঙে পড়ে তার ছেলে তাকে বলেছেন যে, তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। সে বলেছে- বাবা, তারা মামলার রায় দিয়েছে। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। মাকে কিছু বলো না।
পরে বিরোধীদের একটি গ্রুপ ‘১৫০০ তাসবির’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে যে, কারামিকে নির্যাতন করা হয়েছিল। জেলখানায় পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়েছিল। তাদেরকে তিনি বলেছেন, প্রহরীরা তাকে অচেতন অবস্থায়ও প্রহার করেছে। তারা মনে করেছিল, সে মারা গেছে। তার দেহ প্রত্যন্ত এক এলাকায় ফেলে আসে। পরক্ষণেই তাদের মনে হতে থাকে কারামি বেঁচে আছেন। পরিবারকে কারামি আরও বলেছেন, নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা প্রতিদিনই তার গোপনাঙ্গে নির্যাতন করেছে। তাকে বলাৎকার করার হুমকি দিয়েছে জিজ্ঞাসাবাদে।
ইরানের আইনি ব্যবস্থায় নিম্ন আদালত যখন কাউকে মৃত্যুদণ্ড দেয়, তখন তারা তা অনুমোদনের জন্য সুপ্রিম কোর্টে পাঠায়। সুপ্রিম কোর্ট মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন করলেও আসামীপক্ষ আপিল করতে পারে। কিন্তু কারামির পিতা বলেছেন, তিনি রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিয়োগকৃত আইনজীবীদের সঙ্গে অনেকবার যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কোনো সাড়া মেলেনি। এরপর তার পরিবার ইরানের সুপরিচিত মানবাধিকার বিষয়ক অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন আঘাসি’কে হায়ার করার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে প্রথমে নিম্ন আদালত পরে সুপ্রিম কোর্টে লিখিত অনুমতি চান আইনজীবী আঘাসি। কিন্তু প্রতিটি পর্যায়ে তার চিঠিকে উপেক্ষা করা হয়েছে।