প্রধান খবরভারত

মোদি কেন বিবিসির তথ্যচিত্র দেখাতে চান না

শাহ্‌ জে. চৌধুরী


বিশেষ ক্ষমতা ব্যবহার করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে নিয়ে বিবিসির তথ্যচিত্রের সম্প্রচার বন্ধ করেছে দেশটির ডানপন্থী সরকার। ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় মোদির নেতৃত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছে ওই তথ্যচিত্রে।

দুই পর্বের ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোশ্চেন’ শীর্ষক তথ্যচিত্রকে ‘প্রোপাগান্ডা’ হিসেবে উল্লেখ করে এর ভিডিও ও লিংক সরাতে ইউটিউব ও টুইটারকে নির্দেশ দিয়েছে ভারত সরকার। এমনকি ভারতের এক বিশ্ববিদ্যালয়ে তথ্যচিত্রটি দেখানোর সময় বাধা দেয় সরকারি কর্তৃপক্ষ। আয়োজক ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়ে বিদ্যুৎ ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার অভিযোগও উঠেছে।

দেশটির অন্যান্য অংশেও তথ্যচিত্র প্রদর্শনীর আয়োজন বাধাপ্রাপ্ত হওয়ার খবর মিলেছে। এদিকে সরকারি নির্দেশনা না মেনে বিরোধী দলীয় নেতা, সংবাদকর্মী এবং অধিকারকর্মীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তথ্যচিত্রটির লিংক শেয়ার করে যাচ্ছেন।

২০০২ সালে গুজরাটে কী হয়েছিল?
ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) অন্তর্দ্বন্দ্ব নিরসনে ২০০১ সালের শেষদিকে গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় নরেন্দ্র মোদিকে। তখন পর্যন্ত তিনি ‘রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের’ (আরএসএস) গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। ইউরোপীয় ফ্যাসিবাদী দলগুলোর অনুকরণে ১৯২৫ সালে এই সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠা করে বিজেপি। ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে গড়তে চেয়েছিল আরএসএস, দেশটির ২০ কোটির বেশি মুসলমান যেখানে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হবেন।

২০০২ সালের ফেব্রুয়ারিতে এক ট্রেন অগ্নিকাণ্ডে ৫৯ জনের মৃত্যু হয়। উত্তর প্রদেশের অযোধ্যাফেরত অনেক হিন্দু তীর্থযাত্রী ছিলেন সে ট্রেনে। মুসলমান দোকানীরা গোধরা স্টেশনে ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয় বলে মোদি নেতৃত্বাধীন রাজ্য সরকার অভিযোগ করে বসে। তবে ২০০৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের এক কমিটি জানায়, ট্রেনে আগুন ধরেছিল দুর্ঘটনাক্রমে।

এদিকে গোধরা স্টেশনের খবর ছড়িয়ে যাওয়ায় গুজরাটজুড়ে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। মুসলমানদের ওপর তাণ্ডব চালায় ধর্মান্ধ হিন্দুরা।

দুই হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করা হয়, যাদের সিংহভাগ মুসলমান ছিলেন। অনেক নারী ধর্ষণের শিকার হন। ভারতের ইতিহাসে এমন ধর্মীয় গণহত্যার নজির কম। এদিকে রাষ্ট্র হিসেবে গুজরাটের কপালেও দুর্নাম কম জোটেনি।

যুক্তরাজ্যসহ অনেক বিদেশি রাষ্ট্র সে সময় মোদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা বন্ধ করে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রে মোদির ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞাও দেয়া হয়।

এদিকে গণহত্যায় মোদি ‘হিন্দু হৃদয়সম্রাট’ উপাধি পেয়ে বসেন। আরএসএস ও বিজেপিতে তার মর্যাদা বাড়তে থাকে। ২০১৪ সাল পর্যন্ত গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হতে সে বছর নয়া দিল্লিতে যান তিনি।

বিবিসির তথ্যচিত্রটি কী নিয়ে?
গুজরাট দাঙ্গায় পুলিশকে নিষ্ক্রিয় থাকতে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী মোদি নির্দেশ দেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে ৫৯ মিনিটের তথ্যচিত্রে।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গোপন নথির উদ্ধৃতি করেছে বিবিসি। বেনামী সূত্রের বরাত দিয়ে বলেছে, পুলিশের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে দেখা করে মোদি মুসলমানদের ওপর হামলায় পুলিশকে বাধা দিতে বারণ করেন। সে সঙ্গে হামলাকে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রণোদিত’ বলা হয়েছে, যার লক্ষ্য মূলত ‘হিন্দু অধ্যুষিত এলাকা থেকে মুসলমানদের বিতাড়িত করা’। দাঙ্গায় নরেন্দ্র মোদিকে সরাসরি দায়ী করা হয়েছে তথ্যচিত্রে।

ভারতে তথ্যচিত্রটি নিষিদ্ধের পর বিবিসি এক বিবৃতিতে বলে, তথ্যচিত্র তৈরিতে ‘সর্বোচ্চ সম্পাদকীয় নীতিমালা মেনে যথাযথভাবে গবেষণা করা হয়েছে’।

তা ছাড়া সূত্র হিসেবে অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ও বিশেষজ্ঞের মতামত নেয়া হয়েছে বলেও জানায় বিবিসি, এমনকি বিজেপির ভেতর থেকেও মতামত নেয়া হয়।

বিবিসি বলেছে, ‘আমরা ভারতীয় সরকারকে তথ্যচিত্রে উত্থাপিত বিষয়বস্তু নিয়ে মতামত জানানোর সুযোগ দিয়েছি। তবে তারা মন্তব্য করতে রাজী হয়নি।’

মোদি কেন তথ্যচিত্রের প্রচার বন্ধ চান
গুজরাট দাঙ্গা থামাতে ব্যর্থতার অভিযোগ বারংবার অস্বীকার করে এসেছেন মোদি। দাঙ্গায় মোদি এবং অন্যদের ভূমিকা তদন্তে বিশেষ তদন্তদল গঠন করে সুপ্রিম কোর্ট। ২০১২ সালে জমা দেয়া ৫৪১ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করার মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানানো হয়।

পরের বছর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে মোদিকে বিজেপির প্রার্থী হন। ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়ী হন মোদি। ২০১৯ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সংসদে ফেরেন।

২০১৪ সাল থেকে মোদির বিজেপি এবং আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ডানপন্থী দল মিলে হিন্দু আধিপত্যবাদী প্রচারণা চালিয়ে গেছে।

সুতরাং গুজরাট দাঙ্গা নিয়ে বিদেশি স্বনামধন্য কোনো গণমাধ্যমের তৈরি তথ্যচিত্রে মোদি প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা সরকারের সমালোচনা বন্ধ করার চেষ্টারই অংশ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিবিসির তথ্যচিত্রের সমালোচনা করছে মোদি সমর্থকেরা। এটাকে ‘ঔপনিবেশিক’ এবং ‘শ্বেতাঙ্গ’ প্রোপাগান্ডা বলছে তারা।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী গত সপ্তাহে এক সংবাদ সম্মেলনে তথ্যচিত্রের সমালোচনা করে বলেন, ‘পক্ষপাতিত্ব ও বস্তুনিষ্ঠার অভাব এবং ঔপনিবেশিক মানসিকতার অকপট প্রভাব চরমভাবে দৃশ্যমান।’

এদিকে বিবিসির তথ্যচিত্রটি মোদি ভারতীয়দের দেখতে দিতে চান না জেনে অবাক হয়েছেন ভারতের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মোহাম্মাদ সাজ্জাদ। সরকারি নিশেধাজ্ঞাকে অসঙ্গতিপূর্ণ উল্লেখ করে আল জাজিরাকে তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গায় মুসলমানদের শিক্ষা হয়েছে বলে বিবৃতি দিয়েছেন। তবু, যেহেতু বিবিসির তথ্যচিত্রে মোদি অত্যন্ত বিরক্ত, এর একমাত্র বিশ্বাসযোগ্য কারণ হতে পারে বিশ্বের সামনে তিনি এক ধরনের ভাবমূর্তি তুলে ধরতে চাচ্ছেন।’

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension