মুক্তমতশ্রদ্ধাঞ্জলি

মোসাম্মাৎ রফিকা বেগম

মাহমুদ রেজা চৌধুরী


এই নামের সাথে পরিবারের বাইরে আর কেউ পরিচিত না। সুদূর কলকাতা থেকে একসময় বরিশালের এক গণ্ডগ্রামের গৃহবধূ হয়ে আসেন এই অসাধারণ গুণী নারী। তাঁর আদিবাস ছিল কলকাতার মুর্শিদাবাদ জেলায়। এই উপমহাদেশের অন্যতম ব্যক্তিত্ব ও সম্রাট টিপু সুলতানের বংশধারী নারী। বাংলা একেবারেই বলতে পারতেন না। পড়াশোনাও করেন নাই তেমন। তবু অনেক গুণের অধিকারী ছিলেন। একসময় সেই গ্রামের একজন প্রভাবশালী জমিদার এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর নজরে পড়েন, মুসাম্মাৎ রফিকা বেগম।

হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী তাঁকে বিয়ে করে নিয়ে আসেন বরিশালের উলানিয়া গ্রামে। এরপর থেকেই মুসাম্মাৎ রফিক বেগম এই পরিবারেই বলতে গেলে কৈশোর থেকেই ছিলেন, হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর এই সুন্দরী বউ। সেই সুবাদে এলাকার সবাই রফিকা বেগমকে চিনতেন, একজন বিদেশী নারী পাশাপাশি দারুণ চৌকস ও খুবই সুন্দরী নারী হিসাবেও।

মোসাম্মাৎ রফিকা বেগম বিয়ের পরে তাঁর স্বামীর ঘরে এসে দেখলেন, তিনি এদের কারোর কোনো ভাষাই বোঝেন না। স্বামী ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী অবশ্য মোসাম্মাৎ রফিকা বেগমের ভাষা বুঝতেন। বলতেও পারতেন। তাই স্বামীর সাথে তাঁর যোগাযোগে কোনো অসুবিধাই হতো না। জমিদার বাড়ির সবার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে কিছুটা অসুবিধা হলেও, রফিকা বেগমের আচার, ব্যবহার এত সুশৃংখল ছিল খুব অল্প সময়ে তাঁর অনেক ভক্ত হয়ে যায় সেখানে। প্রথম, প্রথম দিকে রফিকা বেগম তাদের সাথে আকার ইঙ্গিতেই কথা বলতেন। তারপর অবশ্য ধীরে ধীরে ভাষা শেখা হয়ে যায় তাঁর।

রফিকা বেগমের স্বামী, হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী দারুন দাপুটে পুরুষ ছিলেন। কংগ্রেস এবং স্বদেশী রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন নেতা পর্যায়। হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর ব্যক্তিগত বন্ধু ছিলেন, নেহেরুর পিতা মতিলাল নেহেরু। পরে হাজি সাহেব মতিলাল নেহেরুর রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করেন। এছাড়াও তখনকার ভারত উপমহাদেশের বিখ্যাত অনেক নেতার সাথে হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর সক্ষতা ছিল অত্যন্ত আন্তরিক। বরিশাল জেলায় কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত। সেই সুবাদে অনেক মানুষ আসতেন উলানিয়ার জমিদার বাড়িতে। রফিকা বেগম, ধীরে ধীরে বাংলা ভাষা শেখার পর, কলকাতায় গেলে, রাজনৈতিক নেতা মওলানা মোহাম্মদ আলী, ও শওকত আলীর উর্দু ভাষণের বাংলা তরজমা করে আরও পরিচিত হয়ে যান নানান মহলে। এই ব্যাপারে তাঁর স্বামীর সহযোগিতা এবং উৎসাহ ছিল বেশ।

রফিকা বেগমের সংসারে তাঁর একটা বড় কাজ ছিল, প্রতিদিন স্বামীর রাজকীয় কিছু নাস্তা তৈরি করার। শোনা গেছে, তাঁর স্বামী সকালে রোজ এক গ্লাস করে বাদাম পেস্তার শরবত খেতেন। তারপর পরোটা, গরুর মাংসের রেজালা ও নানা পদের হালুয়া ও ফলাফল ছিল হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর প্রাতরাশ। এইসব উপস্থিত ও তৈরি করতেও দক্ষ ছিলেন মোসাম্মাৎ রফিক বেগম। বউয়ের হাতের রান্না ছাড়া হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী নাকি খেতেন না। হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী দীর্ঘ দিন বিছানায় শয্যাশায়ী ছিলেন, পারকিনসন রোগের কারণে । ওই সময় রাজনীতিতেও ভীষণভাবে যুক্ত থাকার কারণেও হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরীর জমিদারি থেকেও আয় কমে যায়।

মৃত্যুর আগে প্রায় নিঃস্ব হয়ে যান হাজি সাহেব। পাক-ভারতের স্বাধীনতার মাত্র এক বা দুই বছর আগেই হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী ইন্তেকাল করেন। মোসাম্মাৎ রফিফা বেগমের বয়স তখন চল্লিশের নিচে। তাঁর রূপ এবং গুণের জন্য ওই এলাকার অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি, রফিকা বেগমকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু রফিকা বেগম তাতে রাজি হন নাই। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রফিকা বেগম তাঁর সন্তানের কারণেই একজন বিধবা নারী হিসেবেই জীবন কাটিয়েছেন সন্তানের কাছে।

রফিকা বেগম সারা জীবন অত্যন্ত কঠোর একটা নিয়ম এবং শৃংখলার মধ্যে চলেন। বিশেষ করে যারা রফিকা বেগমকে কাছে থেকে দেখেছেন, তাদের কাছে এই নারীর ব্যক্তিত্ব, চালচলন, সময় জ্ঞান, সবার উপরে তাঁর প্রতিটা কাজ নিজ হাতে করার। এই গুণগুলো ছিল শিক্ষণীয়। রফিকা বেগমের কোনো কন্যা সন্তান ছিল না। তবে বেশ কয়েকটা মেয়েকে রফিকা বেগম নিজের মেয়ের মতো করে বড় করেছেন। লেখাপড়া শিখিয়েছেন। কঠোরভাবে শাসন করেছেন। পরিশেষে ভালো ও উপযুক্ত ঘড় দেখে বিয়ে দেন। রফিকা বেগম জীবিত থাকাকালীন ওঁদের দু একজন রফিকা বেগমকে দেখতে আসতো সব সময়। রফিকা বেগম তাঁর স্বামীর কারণে এক মাস জেল খেটেছেন ব্রিটিশ সরকারের। অসুস্থ স্বামীর সেবার জন্য হাজি ওয়াহেদ রেজা চৌধুরী তাঁর বউকেও জেলে তাঁর সাথে রাখার জন্য সরকারের কাছে অনুরোধ করলে ব্রিটিশ সরকার তখন তা মেনেও নেয়। মোসাম্মৎ রফিকা বেগমের এই ঘটনার পর আশেপাশে অনেকেই রফিকা বেগমের সাহসের প্রশংসা করেন।

রফিকা বেগম তাঁর পিতৃ মাতৃকুল থেকেও নানান সময় অনেক সাহায্য পেতেন তাঁর স্বামী হাজি রেজা চৌধুরী যখন বিছানায় শয্যাশায়ী। স্বামীর মৃত্যুর পর সন্তান মানুষ করেছেন অনেক কষ্ট করে। তখন তাদের পারিবারিক আয় কমে যায় অনেক। মাঝে সরকার জমিদারিত্ব অনেকের রহিত করে নেয়। একটা প্রাচুর্যের সংসার থেকে হঠাৎ করে ছিটকে পড়েন রফিকা বেগম। তবে কখনই তাঁর আত্মবিশ্বাস এবং চেষ্টা থেকে বিরত হন নাই। খুবই ধার্মিক নারী ছিলেন। রফিকা বেকমের নাতির মুখে শোনা, তার দাদুকে তিনি কখনই বসে নামাজ পড়তে দেখেন নি। দাঁড়িয়ে নামাজ পড়তেন সবসময়। হাতে তাসবিহ থাকত সবসময়ই। কঠোর নিয়ম মেনে চলতেন তাঁর জীবনের একেবারে শেষ সময় পর্যন্ত তাঁর সব কাজে।

রফিকা বেগমের অভ্যাস ছিল দুপুড়ে জোহরের নামাজের পরপরই লাঞ্চ করার। লাঞ্চের পর কিছুক্ষণ শুয়ে উর্দু গল্পের বই পড়তেন বেশ। বইগুলো নাতিকে দিয়েই আনাতেন নিউ মার্কেট থেকে। তারপর আসরের নামাজ শেষে মেপে তিন আঙ্গুল সমান চা খেতেন। রাতে এশার নামাজের পরপরই তাঁর রাতের খাওয়া শেষ হয়ে যেত। মিষ্টি, কলা, হালুয়া। এসব রফিকা বেগমের রাতের খাবারের পর নিয়ম করে খাবার অভ্যাস ছিল। আরও পছন্দ করতেন সকালে বাখোরখানি ও পনির।

রফিকা বেগম তাঁর ছেলের সাথে কথা বলতেন সাধারণত উর্দুতে। তবে অধিকাংশ সময় মা ও ছেলে নাকি কথা বলতেন, প্রাইভেটলি। তাঁদের কথার সময় কেউ পাশে থাকত না। কারণ কি, সেটা জানা যায় নাই। ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলার সময় রফিকা বেগম থাকতেন তাঁর ছেলের আজিমপুর কলোনির বাসায়। শেষের দিকে যখন যুদ্ধের প্রায় শেষ সময়। রফিকা বেগমের নাতির মুখ থেকে শোনা, তখন কলোনির সবাই নিজের ফ্ল্যাট ছেড়ে চলে যান বিভিন্ন নিরাপদ জায়গায়। রফিকা বেগম যেতে চান নি। মাকে ছেড়ে ছেলেও যেতে চায় নি। প্লেনের বোমাবর্ষণ, চারিদিকে গোলাগুলির আওয়াজ। তবু বাড়ি ছেড়ে কোথাও যান নাই মা ও বেটা। রফিকা বেগমের সন্তান তাঁর মাকে খুবই ভয় করতেন এবং শ্রদ্ধা করতেন। শ্রদ্ধার কারণে ভয়। এই শিক্ষাটা রফিকা বেগমের নাতি ওর বাবার কাছ থেকেই পায়।

একদিনের কথা মনে পড়ে, কে যেন কোনো কারণে রফিকা বেগমের সাথে দেখা করতে আসেন এক পাক সেনা অফিসার। সেই সেনা অফিসার, দূরসম্পর্কের আত্মীয়তার সূত্রে রফিকা বেগমের কাজিন ছিলেন, পরে জানা‌ যায়। সেনা অফিসার বাসায় আসেন সিভিল পোশাকে। রফিকা বেগমের সাথে অনেকক্ষণ বসে কথা বলেন। রফিকার নাতির শুধু মনে আছে, সেই সেনা অফিসারের সাথে তার দাদি কথা বলেন সম্পূর্ণ চোস্ত উর্দুতে। দূর থেকে দাঁড়িয়ে রফিকার নাতি দেখল, সেনা অফিসার তার দাদিকে পায়ে ধরে সালাম করেন। দৃশ্যটা ওই সময় অত্যন্ত অন্যরকম ছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য রফিকা বেগম বাড়ির কাউকেই সেই সেনা অফিসার সম্পর্কে আর কিছু বলেন নি। অফিসার যাওয়ার সময় রফিকা বেগম বলেছেন, ‘বেটা, খোদাকে ওয়াস্তে তুম সব আদমি বান যাও পেহলে। মুশকিল আহসান হো জায়গা’। রফিকার নাতির সেই কথাটা এখনও মনে আছে।

আজকে এতগুলো বছর পর রফিকা বেগমের নাতির দাদুর কথা মনে পড়ে। আসলে আমরা মানুষ হলাম কই! মানুষ হলে হয়ত এত সমস্যা আমাদের হতো না আজকে। মানুষ হবার চেষ্টা থেকে আমরা দূরে সরে গেছি কেবল কিছু বস্তুগত চাহিদার কারণেও হয়ত বা। সমাজে মোসাম্মাৎ রফিকার প্রয়োজন আজকেও অনেক বেশি। নাতি ওর দাদুর এই কিছু কথা ভাবতে ভাবতেই একটু অন্যমনস্ক হয়। মনে, মনেই বলে, দাদু, তুমি চলে গেছো অনেক দূরে, সময়ের নদী দুকুল ছাপায়ে কাঁদে ছলছল সুরে।

Show More

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button

Adblock Detected

Please, Deactivate The Adblock Extension